নাট্যকার সেলিম আল দীনের মৃত্যুদিন আজ। তাঁর নাটকে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল শিকড়সংলগ্ন বঙ্গীয় জনপদ। দৃশ্যকাব্যগুলো সেজেছিল বর্ণিল ভঙ্গিমায়। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখা লিখেছেন তাঁর পরের প্রজন্মের আরেকজন নাট্যকার।
নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিগলিত হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এটি একটি রাজনৈতিক, করপোরেট অর্থনৈতিক দুনিয়ার প্রকল্প। কত বড় লেখককে তুমি ডুবাইলা, কত মাঝারি লেখককে তুমি ভাসাইলারে...তা একটু চোখকান খোলা রাখলে প্রতিবছরই চোখে পড়ে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ দুনিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতার সমীকরণে একটি ভালো অবস্থানে থাকলে সাহিত্যে বাংলা ভাষায় একটি নোবেল পুরস্কার আসত। ধরা যাক, পুরস্কারের জন্য দুটি নাম যাচ্ছে; তাঁরা হতে পারতেন—আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও সেলিম আল দীন। বাস্তবিকই পুরস্কারটি ঘরে তুলে আনার মাহেন্দ্রক্ষণে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাদ পড়তেন, তা জিতে আনতেন সেলিম আল দীন। সেলিম আল দীন বিষয়ে আশার কথা এটি, নিরাশার কথাও এটিই।
বড় বড় তকমা কমিটি লেখায় ভাষার যে মহিমা আরোপের কথা বলেন, ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত আর্তি আর আধ্যাত্মিকতা মুসাবিদা করার মানদণ্ড জারি করেন, সেলিম আল দীন যে অবলীলায় তা উতরে যাবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সেলিম আল দীন—একমাত্র সেলিম আল দীনই বাংলা ভাষায় নাটককে কবিতার উচ্চতায়, পেইন্টিংয়ের মার্গে তুলে আনেন। কেবল নাটকের কথাই বলছি কেন, একটি জনপদের একদম অন্তর্লীন প্রাণের স্পন্দমান নৈঃশব্দ্যের কথাটি এমনভাবে তুলে আনা যায়, যা বাংলা গান ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে আর দেখিনি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন সাঁই, ভবা পাগলা, রাধারমণ দত্ত, জালাল খাঁ যে দার্শনিক অন্বেষা যুক্ত করেন, তা কেবল গানেই তুলে আনতে পেরেছেন। এমনকি নাট্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও তার ঘাটতি দেখি। সেলিম আল দীনের আসল কীর্তি এখানে যে গানের বাইরে অন্য একটি মাধ্যমে—নাটকে তিনি বাংলা জনপদের দার্শনিক জিজ্ঞাসার শৈল্পিক ফয়সালার খোঁজ করেন, যার দীপ্তি ও ব্যাপ্তি অনন্য।
সেলিম আল দীন—একমাত্র সেলিম আল দীনই বাংলা ভাষায় নাটককে কবিতার উচ্চতায়, পেইন্টিংয়ের মার্গে তুলে আনেন। কেবল নাটকের কথাই বলছি কেন, একটি জনপদের একদম অন্তর্লীন প্রাণের স্পন্দমান নৈঃশব্দ্যের কথাটি এমনভাবে তুলে আনা যায়, যা বাংলা গান ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে আর দেখিনি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন সাঁই, ভবা পাগলা, রাধারমণ দত্ত, জালাল খাঁ যে দার্শনিক অন্বেষা যুক্ত করেন, তা কেবল গানেই তুলে আনতে পেরেছেন। এমনকি নাট্যকার হিসাবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও তার ঘাটতি দেখি। সেলিম আল দীনের আসল কীর্তি এখানে যে গানের বাইরে অন্য একটি মাধ্যমে—নাটকে—তিনি বাংলা জনপদের দার্শনিক জিজ্ঞাসার শৈল্পিক ফয়সালার খোঁজ করেন, যার দীপ্তি ও ব্যাপ্তি অনন্য।
কিন্তু তাঁর বাংলা মানস সীমাবদ্ধতার তীব্র সূত্রে আটকা পড়ে যখন তিনি এই বাংলা ঘরানায় পৃথিবীর অসুখ ছাড়াতে ‘নিমজ্জন’-এর ভেতর এক দাওয়াই হাজির করেন। ‘নিমজ্জন’ নাটকে এই সমরমুখী দুনিয়ার আগুন নেভানোর জন্য তিনি আশা করেন, জাতিসংঘ শান্তির বাণী নিয়ে হাজির হবে। এই বিপুল, দুর্নিবার অন্যায়ের সামনে জাতিসংঘ সোজা হয়ে দাঁড়াবার ন্যূনতম ব্যক্তিত্বও তো রাখে না। জাতিসংঘ কমলকুমার মজুমদার বিরচিত পিঞ্জরে বসিয়া শুক—কেবল শোকপ্রস্তাব নিতে জানে!
একের পর এক উত্তীর্ণ নাটক নিয়ে মঞ্চে, কখনোবা টেলিভিশনে হাজির হয়েছেন সেলিম আল দীন। ‘গ্রন্থিকগণ কহে’, ‘আয়না’, ‘লাল মাটি, কালো ধোঁয়া’—যেকোনো বিবেচনায় মঞ্চনাটকের গাঢ়তা ও গূঢ়ৈষা রাখে। মঞ্চনাটকে সেলিম আল দীনের সাফল্য অর্গলহীন। আরেকটি ‘চাকা’ নাটক বিশ্বনাটকে কোথাও আছে বলে মনে করি না, ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘হাতহদাই’, ‘হরগজ’, ‘স্বর্ণবোয়াল’, ‘ধাবমান’, ‘বনপাংশুল’—বাংলা ও বিশ্বনাটকে যুগ যুগ জীয়ে।
এই বৈশ্বিক প্রকল্প ছাড়া সেলিম আল দীন ধর্মকে রাষ্ট্রের বাইরে ব্যক্তিগত চর্চার জায়গায় রাখার কথা ভাবতেন—যা একদম ঠিক, তিনি তা-ও বলতেন, রাষ্ট্র বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলে জনগণের ওপর হামলে পড়ে। সেলিম আল দীনকে এখনো বলার সুযোগ পেলে হয়তো বলতাম, রাষ্ট্র দুর্বল হলেও মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। তিনি হয়তো ভাবতেন, রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ঘটনা, কিন্তু রাষ্ট্র আসলে আর দূরে নয়, রাষ্ট্র বেডরুমে ঢুকে পড়েছে, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনেও রাষ্ট্র অষ্টপ্রহর কর্তব্যরত।
এবার বলি, রাষ্ট্র সম্পর্কে, বিশ্ব রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার সম্পর্কে সেলিম আল দীনের চিন্তার এই গড়নের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার হয়তো জিতে নিয়ে আসতেন।
নোবেল পুরস্কার জিতে আনার গুণ ও ঔদার্য সেলিম আল দীনের ছিল। তাই তাঁকে কিছুটা পর পর লাগে, লালন সাঁইজির বাণী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মর্ম তিনি বাংলা নাটকের নকশি কাঁথায় তুলে আনেন, এখানেই তাঁকে বড় আপন আপন লাগে!
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com