গল্প

লাশ

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

একটু আগে কারওয়ান বাজার থেকে উঠেছি লাব্বাইক বাসে৷ কপালটা কী ভালো, সিট পেয়েছি জানালার পাশে। রাস্তা পুরো ফাঁকা। বাসেও তেমন লোকজন নেই। একটু পরই বুঝলাম, কপাল আসলে খুব একটা ভালো না। কারণ, জানলাটা খোলা যায় না। সিট বদলাব কি না ভাবছি, হঠাৎ খামারবাড়ি থেকে একটা লোক উঠে আমার পাশে এসে বসল। মরা মানুষের বাসে ওঠার কথা নয়। কিন্তু এই লোকের গা থেকে একদম মরা মানুষের গন্ধ আসছে।

মনে হলো, মাত্র আল মারকাজুল থেকে গোসল শেষ করে বাসে উঠেছে লোকটা। বাসের টিমটিমে আলোয় লোকটাকে দেখে মনে হলো, বেটা আসলেই মরা। চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে। মুখটা চকচক করছে। চোখ বন্ধ। আর কী তীব্র গন্ধ! চা–পাতা আর কর্পূরের মিশ্র গন্ধে মুহূর্তেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল আমার৷ মনে হলো জিজ্ঞেস করি, ভাই মনে হয় মারা গেসেন, তা–ই না? কেমনে মারা গেলেন? ঘটনা ঘটল কখন? এখন যান কই?

কিন্তু সাহস পেলাম না। একটু পর হেলপার এসে ভাড়া চাইল। লোকটা না তাকিয়েই তাকে ১০ টাকার নোট ধরিয়ে দিল। অমনি তাকে ‘এইডা কী দিলেন?’ বলে ঝাড়ি দিল হেলপার। 

ওই বেটা কি বোঝেনি যে এই লোক মারা গেছে! হেলপার আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘যাইবেন কই?’

‘মাজার রোড।’ চোখ বন্ধ করেই জবাব দিল লোকটা।

‘আর ১০ টাকা দেন। ২০ টাকা ভাড়া।’

‘ফারামগেট থেইকা মাজার রোড ২০ টাকা কবেত্তে? আমি কি আজকা নতুন যাইতাসি? তোমার চার্ট কই? দেখাও।’ ঘুরে তাকাল লোকটা। লাশ হলেও তার কথায় যুক্তি আছে। ভেবে দেখলাম, বাঙালি এমন চিজ, মরে গেলেও বাসভাড়া নিয়ে গ্যাঞ্জাম করে। কিন্তু এই মড়া মাজার রোডে যাবে কেন? নিশ্চয়ই বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে যাবে। এহ, গন্ধটা আরও চেপে বসল নাকে। নেমে যাব নাকি? কল্যাণপুরে এসে পড়েছে বাস। ঢুকল পাম্পে, তেল নেবে। হঠাৎ একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল আমাদের বাসের পাশে। দুটো লোক অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমেই দিল দৌড়। এক দৌড়ে এসে উঠল আমাদের বাসে। হেলপার চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হইসে ভাই?’

‘আরে, আমগো গাড়ি থেইকা একটা লাশ পালাইসে। ওইটারে খুঁজতাসি।’ জবাব দিল লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাসে উঠে আসা একজন।

ঘটনা তাহলে সত্যি! কল্পনা না! ঠিকই ভেবেছিলাম আমি। পাশের লোকটাই মনে হয় সেই পলাতক লাশ!

আমি উঠে দাঁড়াইতেই লাশটা আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ভাই, প্লিজ... কিছু বইলেন না। এরা আমারে ধইরা নিয়া যাবে।’

কী ঠান্ডা লোকটার হাত! আমার হাত–পা, পুরো শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে গেল, ভয়ে নাকি ওই লোকের স্পর্শে বুঝলাম না। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের লোকগুলা মনে হয় গন্ধ পেয়েছে। না পাওয়ার কোনো কারণই নেই। এতক্ষণ কেন কেউ টের পায়নি, সেটাই এক রহস্য। লোক দুটো ধীরে ধীরে এসে পড়ল আমাদের সিটের সামনে। এসে আঁতকা আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, ‘বের হ বেটা। অনেক জ্বালাইছস।’

চিৎকার করে তাদের বললাম, ‘আরে ভাই, আমি না, আমি তো বাঁইচা আছি, বিশ্বাস করেন!’

দুই লোকের একজন হেসে হেসে আমাকে বলল, ‘প্রথম প্রথম সবাই এমন কথাই কয়।’