চিত্রকলার দুনিয়ায় সালভাদর দালিকে পাবলো পিকাসো ও অঁরি মাতিসের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তবে স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন, বিশেষ করে চিন্তাভাবনা ও আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ ও পরাবাস্তববাদী প্রভাবের কারণে নিজের চিন্তার জগতের মতো দালির শিল্পের জগৎও স্বতন্ত্র ছিল। কৈশোরে দালির মা মারা যান, তাই বাপের কাছে মানুষ হয়েছিলেন অভিমানে, অনুরাগে ও বিরাগে। পেশায় নোটারি আর ধর্মে অবিশ্বাসী বাপের প্রভাব তাঁর মনন গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। যদিও ‘পৈতৃক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করে আর জয়ী হয়, সে-ই প্রকৃত বীর’—ফ্রয়েডের এ কথা কখনো ভুলতেন না দালি। কৈশোরেই জ্ঞানের প্রতি সতৃষ্ণ দালি বাবার লাইব্রেরিতে নন্দনতত্ত্বের বই বেশি নাড়াচাড়া করতেন আর তাতে লক্ষ করতেন ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার নানা প্রমাণ। স্কুলের সেই প্রথম বছরে শিক্ষক দন ত্রায়েতের দালিকে বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে একটা মেয়েলি ব্যাপার।’ বিষয়টা তাঁকে ভাবাত তখন থেকে। এই সূত্রে দালি পরীক্ষা করেছেন ভলতেয়ারের অভিধানগ্রন্থও। আর ফ্রেডরিখ নিৎসে পড়তে গিয়ে কিশোর-মনে পেলেন ভীষণ চোট: ‘ঈশ্বর মৃত’—এমন ঘোষণায়। জরাথুস্ট্রের মাধ্যমে নিৎসে দালিকে আরও নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দিলেন। আর সে কারণে বাপে-বেটায় বিচ্ছেদও ঘটে; ঘরছাড়া হন একসময়। নিৎসের ব্যক্তিত্ব, খ্রিষ্টধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি দালিকে করে তুলেছিল নিৎসে-সুলভ নির্বিকার, জীবনবিমুখ ও উদাসীন; এমনকি বাহ্যিক চেহারা অনুকরণেও। তখন থেকে জুলফি বাড়তে দিয়েছেন ঠোঁটের কোনা পর্যন্ত। এ সময়টাকে দালি নিজের ‘আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ে’র কাল বলে স্বীকার করেছেন। মাত্র সাত বছর বয়সে যে দালি হতে চেয়েছিলেন নেপোলিয়ন, তারুণ্যে এসে স্থিত হন চিত্রকলায়; প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকলেন একে একে। এরই মধ্যে ফ্রয়েডের প্রভাবে যৌনতার চিত্রকল্প আর প্যারিসের পরাবাস্তববাদীদের দলে যোগ দিয়ে শিল্পের আঙ্গিকে আনলেন নানা নতুনত্ব। বদলে যায় দালির দুনিয়া আর আলোচনায় আসেন ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে।
পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে দালি বুঝেছিলেন, কোনো ধরনের যৌক্তিক নান্দনিক বা নৈতিক বাধা ছাড়াই চিন্তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু ছবি আঁকতে গিয়ে দেখতে পেলেন অন্য সব পরাবাস্তববাদী আদপে বুর্জোয়া–চরিত্রের লোক। বাস্তব আর যুক্তির জগতের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে এঁরাও অক্ষম। সুতরাং দালির সিদ্ধান্ত, আর যা-ই হোক, এটি শিল্প ও সাহিত্যের দল হতে পারে না। পরাবাস্তববাদের প্রবক্তা আঁদ্রে ব্রেতোঁকে চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন পিতা ভাবলেও তিনিও দালির পরাবাস্তববাদী ছবি মেনে নিতে পারেননি। কারণ, দালি ছবিতে মল ও পায়ুর চিত্র সংযোজন করেছেন। মনোবিশ্লেষণ আর পরাবাস্তববাদী দিক থেকে ছবিতে বর্জ্যের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আন্দোলনে এটা পরিত্যাজ্য বিবেচিত হয়। অথচ কী নিদারুণ ঘটনা দেখলেন দালি—যৌনাঙ্গ আঁকা যাবে, পায়ু আঁকা যাবে না—যদিও স্ত্রী-পায়ু সিদ্ধ তাঁদের কাছে! দালি পরাবাস্তববাদীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হলেন, নিজেও সরে এলেন এঁদের থেকে। কিন্তু এর আগে-পরে নিজের অভিজ্ঞতাকে চরম ও স্ববিরোধী পরিণতির দিকে নিয়ে যান দালি, বাস্তবে যা পরাবাস্তববাদী ধারণার বিপরীত। যেমন ব্রেতোঁ যেখানে ধর্ম সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করতেন, দালি সেখানে নতুন ধর্মচিন্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। দালির ধর্মচিন্তা নিষ্ঠুরতা, ধর্ষকাম ও মানসিক বিকলনপূর্ণ ছিল। ধর্মের এই ধারণাগুলো দালি পেয়েছিলেন আগস্ট কোঁৎ পড়ে। দালির ভাবনার মূলে হচ্ছে পরাবাস্তব জগৎ যদি সত্য হয়, তাহলে সেখানে অতীন্দ্রিয় ও ধর্মের বিষয় অনুপস্থিত থাকতে পারে না।
মাত্র সাত বছর বয়সে যে দালি হতে চেয়েছিলেন নেপোলিয়ন, তারুণ্যে এসে স্থিত হন চিত্রকলায়; প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকলেন একে একে। এরই মধ্যে ফ্রয়েডের প্রভাবে যৌনতার চিত্রকল্প আর প্যারিসের পরাবাস্তববাদীদের দলে যোগ দিয়ে শিল্পের আঙ্গিকে আনলেন নানা নতুনত্ব। বদলে যায় দালির দুনিয়া আর আলোচনায় আসেন ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে।
বিশ্বসৃষ্টির দালিনীয় তত্ত্ব নির্মাণে ব্যস্ত দালির ছবিগুলো তখন পাগলাটে কর্মকাণ্ডে ভরপুর ছিল। ছবিতে বৈপরীত্যের প্রকাশকে তিনি জন্মগত বৈপরীত্য-চেতনা বলে মনে করতেন। ক্যানভাসে পীতাভ রঙে চামড়ার স্ট্র্যাপে আটকানো শরীরের মাংস এঁকে হিটলারের ছবি আঁকলেন দালি। অর্থাৎ হিটলারের নিগূঢ় ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য পরাবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মর্ষকামী উপাদানের সঙ্গে ধর্মীয় উপাদান যুক্ত করেন তিনি। এমনরূপ ভাবনাকে দালি নিজে প্যারোনোইয়া-জনিত এবং অরাজনৈতিক বলে স্বীকার করেছেন। যদিও ব্রেতোঁসহ সবাই দালিকে হিটলার-অনুরাগী বলে ভুল বুঝেছিলেন। ব্রেতোঁর সঙ্গে দালির যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায় একসময়; এ ঘটনাকে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখেন দালি। কারণ, তাঁর মতে এর মাধ্যমে পরাবাস্তববাদের মৃত্যু হয় এবং নিজেই পরাবাস্তববাদ হয়ে ওঠেন। দালির দাবি পরাবাস্তববাদকে তিনি বস্তুতান্ত্রিকতামুক্ত করে আধ্যাত্মিকতাযুক্ত করেছেন; মহিমান্বিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আবিষ্কার করেন নিউক্লিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদ, যা দ্বারা সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের মেলবন্ধন করতে পারেন।
ফরাসি কবি লতেঁ দালিকে একবার একটি গন্ডারের শিং উপহার দেন, যা দালি ভালোবাসতেন। এটা পেয়ে দালির মনে হয়েছিল, এই শিং তাঁর জীবন বাঁচিয়ে রাখবে। দালি পরে খ্রিষ্টের ছবি আঁকতে গিয়ে দেখেন, ভূতগ্রস্তের মতো সারা শরীরজুড়ে একটা গন্ডারের শিংই এঁকেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার যে পরে গোটা ছবিটি দালির মতে আধ্যাত্মিক ও নিখুঁত হয়ে ওঠে। এ জন্য দালি ফ্রয়েডকে ধন্যবাদ দিতে চান। কারণ, সত্যকে দেখার ক্ষমতা তিনিই তাঁকে দিয়েছেন। আর এ–ও ভাবেন, সারা জীবন ধরে তিনি একটা গন্ডারের শিংই এঁকেছেন। গন্ডারের শিঙের বাঁককে দালি মনে করতেন ঐশ্বরিক কিছু, যা সমস্ত শুদ্ধতা ও উগ্র নন্দনতত্ত্বের প্রধান ভিত্তি। সুতরাং গন্ডারের শিং দালির কাছে মরমি বা অতীন্দ্রিয় উপাদান।
এমনকি কখনো-সখনো নিজের মলকে গন্ডারের শিঙের আকারে দেখতেন এবং তা নিয়ে বেশ ভাবিত থাকতেন। মল দালির কাছে ভাবনার মতো বিষয় ছিল এবং এটা তাঁকে সব সময় দার্শনিক করে তুলত। পারাসেলসাসের মতো তিনিও মনে করতেন, মল মানুষের জীবনের সূত্র এবং আয়ুর সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক আছে। মধুর মতো তরল হলে মলের পক্ষে আয়ু বাড়ানো সম্ভব হতো আর জাগতিক অমরত্ব যদি খুঁজতে হয় তাহলে মল বা বর্জ্যের মধ্যেই খুঁজতে হবে। অন্যদিকে মলত্যাগের সঙ্গে দার্শনিকতা ও অধিবিদ্যাগত যে বিষয় জড়িত, উচ্চস্তরের মানুষও এ ব্যাপারে অনুভূতিহীন দেখে দালি বিস্মিত হতেন।
দালি নিজের মনের গড়নকে বারবার ‘প্যারানোইয়া’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটাকে তিনি একটা গুণ বিবেচনা করে বলেন, এর জন্যই তিনি বিশেষ পদ্ধতির মনোবিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। উদাহরণ হিসেবে লা জাকোন্দলে বা মোনা লিসা ও আঁকিয়ে লিওনার্দো দা-ভিঞ্চির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কথাই ধরা যায়। ফ্রয়েডের সূত্র ধরে দালির কথা হচ্ছে ছবিটি দা ভিঞ্চির অবচেতনের প্রকাশমাত্র। কেননা ছবিটি আঁকার সময় দা ভিঞ্চির গুপ্ত প্রেম ছিল মায়ের প্রতি। ফলে যে নারীর ছবিটি আঁকতে চাইলেন তিনি, তার পরিবর্তে হয়ে উঠল নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি: ভারী স্তন আর দ্ব্যর্থবোধক হাসি। দালি দেখলেন, অঙ্কনে ইডিপাস-কমপ্লেক্সতাড়িত শারীরিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও দ্ব্যর্থ হাসিতে যৌনাকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত লুকানো। ফলে মার্শেল দুশ্যাঁ পরে যখন ছবিটি বিকৃত করে আঁকলেন, দালি এর তারিফও করেন। দুশ্যাঁ মোনালিসার মুখে দালিসুলভ গোঁফ এঁকেছিলেন আর ছবির নিচে ক্যাপশন দেন ‘তার পাছাটি দারুণ’। ফ্রান্সে এ নিয়ে বিতর্ক ওঠে, জনমনে প্রতিক্রিয়াও হয়। সংক্ষুব্ধস্বরূপ মোনালিসা–ভক্তরা, এমনকি মিউজিয়ামে রক্ষিত ছবির ওপর আক্রমণও হয়। দালি এর ব্যাখ্যায় বলেন, মিউজিয়ামে এমন ছবির প্রদর্শন জনমনে অবচেতনে গণিকালয়ের প্রতিরূপ হিসেবে কাজ করে। ফলে মায়ের প্রেমের জটিলতার সমস্যাজনিত মন নিয়ে দর্শক দেখে গণিকালয়ে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি। আর শারীরিক ভঙ্গি, চাহনি ও দ্ব্যর্থ হাসি তার মনে যন্ত্রণাসহ আরও অপরাধকে উসকে দেয়। ফলে সে বেপরোয়া হয়ে পাথর ছুড়ে আক্রমণ করে আর এটা একধরনের প্যারানোইয়াক কর্মকাণ্ড। যদিও দালি দুশ্যাঁর ছবিতে দেখেছেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পের সম্ভাবনা।
দালি ব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো ঘটনায় অবাক হতেন না। তাঁর মতে, যা ঘটে সব সত্য; এমনকি মাঝরাতে যদি আকাশে সূর্য ওঠে, তাতেও তাঁর বিশ্বাসের হেরফের হবে না। ধরে নেবেন তিনি পাগল হননি, সূর্যই হয়েছে। দালি নিজের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোনো কৌতুক বা রহস্যময়তা দেখতে পান না। কারণ, দালি মনে করেন, তিনি অতীন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয় মাধ্যমের বিপরীতার্থক সত্তাবিশেষ।
দালি ব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো ঘটনায় অবাক হতেন না। তাঁর মতে, যা ঘটে সব সত্য; এমনকি মাঝরাতে যদি আকাশে সূর্য ওঠে, তাতেও তাঁর বিশ্বাসের হেরফের হবে না। ধরে নেবেন তিনি পাগল হননি, সূর্যই হয়েছে। দালি নিজের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোনো কৌতুক বা রহস্যময়তা দেখতে পান না। কারণ, দালি মনে করেন, তিনি অতীন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয় মাধ্যমের বিপরীতার্থক সত্তাবিশেষ। এমনকি তিনি যখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব ভাবনা ভাবতেন কিংবা স্বপ্ন দেখতেন তার মধ্যেও রহস্যের কিছু নেই—এ সবই বাস্তব বা সত্য এবং ব্যাখ্যাযোগ্য। যেমন ইতালির রাজা উমবের্তো দালির সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, একটা হাঁসের ভেতরে বিস্ফোরক ডালিমদানা ভর্তি। একসময় বিস্ফোরণও হলো আর হাঁসের শরীরের ভেতরকার উড়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের টুকরাগুলোকে দেখাচ্ছে ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইটের মতো। আর হাঁসের উড়ে-যাওয়া-পালকগুলো অনুসরণ করছে উড়ন্ত আরেক বেহালার আকৃতিকে। দালি জানান, রাজার আগমন উপলক্ষে তিনি অর্কেস্ট্রার ব্যবস্থা করেছিলেন আর যে রাস্তা দিয়ে তিনি হেঁটে আসবেন তার দুধারে ছিল ডালিমগাছের সারি। এর আগের দিন দালি হারপুনে বিদ্ধ একটি রক্তাক্ত ও মৃত রাজহাঁস দেখতে পেয়েছিলেন, যা তাঁকে বিষণ্ন করে তুলেছিল। সুতরাং স্বপ্নটি আজগুবি কিছু নয়, রহস্যময়ও নয় কিছু। তাই তাতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই।
পরাবাস্তববাদী প্রক্রিয়ায় দালি অবচেতন মন থেকে অনায়াসে নির্মাণ করতে পারতেন জরায়ুতে থাকাকালীন স্মৃতি। তাঁর মনে হতো, সে তো গতকালেরই ব্যাপার। যেমন জরায়ুর ভেতরকার সময়ের রংটাকে নরকের রং বলে অভিহিত করেছেন তিনি; অর্থাৎ যা লাল, কমলা, হলদে ও নীলাভ রঙের সমাহার। মায়ের গর্ভের নরম, উষ্ণ আর আঠালো আনন্দ তখন দালি নিতেন চোখ দিয়ে। একে তুলনা করেছেন তিনি প্যানহীন দ্বৈত ডিম্বের ফ্রাইয়ের সঙ্গে। জরায়ু থেকে বের হওয়ার সময় যে আলোর ধাক্কা খায় শিশু; দালির মতে তা-ই জীবনের যত বিমর্ষতা, যাতনা ও অসুখের মূলে। এমনকি মানুষের মৃত্যুচিন্তার মূলেও তা-ই—জরায়ুর অন্ধকারে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষার অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছাই মানুষকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যায়। ঘুমানোর আগে ভ্রূণের আকৃতি ধারণ করার যে ভঙ্গি মানুষের, দালি একে মৃত্যুর অভিজ্ঞতার প্রস্তুতি হিসেবে দেখেছেন। অর্থাৎ ঘুম হচ্ছে মানুষের নকল মৃত্যু। আর প্রতিবার ঘুমের আগে আচমকা শূন্যে অধঃপতনের যে অনুভূতি হয়, সেটাও জন্মমুহূর্তের নির্মম স্মৃতি বলে দাবি দালির। পরাবাস্তব ধারায় এসব স্মৃতির নির্মাণও ছিল তাঁর ছবি। দালি মূলত পরাবাস্তববাদী জিনিসপত্রের সাহায্যে ধ্বংস করতে চেয়েছেন আধুনিকতাবাদী চিত্রকলা ও তথাকথিত পরাবাস্তববাদী আঁকিবুঁকিকে। দালি চেয়েছিলেন যথার্থ পরাবাস্তব ছবি আঁকতে, যাতে প্রতিফলিত হয় প্রকৃত বাস্তব, ঐতিহ্য আর ধ্রুপদি পরম্পরা।
বাস্তব আর পরাবাস্তব যেমন একটা ছবিতে গেঁথেছেন দালি: কাঁচা মাংস কাঁধে গালা। গালা দালির প্রেমিকা ও স্ত্রী ছিলেন। পোর্ট লিগাতে এক অভাবের দিনে ছবিটি এঁকেছিলেন দালি। গালার পোর্ট্রেটের দুই কাঁধে রাখা কাঁচা মাংসের দলা। পেছনের বাস্তবতা হচ্ছে নানা স্তরের। আট বছর বয়সে দালি এঁকেছিলেন এ রকম আরেকটা ছবি: মাথার ওপর কাঁচা মাংসের স্তূপ। বাপের সঙ্গে ছিল বিরোধ, বাপ তখন তাঁকে সহ্য করতে পারতেন না। একসঙ্গে দুজনের বসবাসও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল একসময়। তখন দালির মাথায় ঢুকেছিল সুইস লোককথার সেই উইলিয়াম টেলের আপেলের গল্প, যা আসলে পৈতৃক প্রতিশোধের তির মেরে প্রায়শ্চিত্তমূলক বলিদান দাবি করে। এমন ঘটনা একটা নয়, অনেক আছে। আব্রাহাম আইজ্যাককে পুড়িয়ে মেরেছেন, শনি খেয়েছে পুত্রদের চিবিয়ে; গুজমান এল বুয়েনো ছুরি তুলে দিয়েছেন ছেলের হাতে, আর পরম পিতা ঈশ্বর তো বলি দিয়েছেন যিশুখ্রিষ্টকে। এসব ঘটনা ভোলেন না দালি, তাই অভাবের দিনে এমন ছবি আঁকার মানে হচ্ছে—গালাকে খাওয়ার বদলে কাঁচা মাংসের টুকরাই খেতে চেয়েছেন দালি। বলেছেন এক জায়গায়, মাংসের দলা এসেছে ব্যর্থ বলিদানের প্রায়শ্চিত্তের শিকার হয়ে। এটা এমন, যেন আব্রাহামের ভেড়া, শনির পুত্রগণ, ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিষ্ট কিংবা উইলিয়াম টেলের আপেল। নরমাংসভোজী বলিদানের এটাই প্রধান শর্ত বলে মনে করেন দালি। তাই আট বছর বয়সে বাবাকে বোঝাতে চেয়েছেন, আমাকে না খাওয়ার বদলে মাংসটুকু খাও; আর এখনো ওই একই তাৎপর্য। এভাবে তখনকার তাঁর ভোজ্য ও নাড়িভুঁড়িযুক্ত সহজপাচ্য উপস্থাপনাগুলো ছবিতে একধরনের ক্রমবর্ধমান নাছোড়বান্দা চারিত্র্যরূপ পেয়েছিল বলে স্বীকারও করেন দালি। এটাই দালির মনোজাগতিক বাস্তবতা, ঐতিহ্য ও ধ্রুপদি পরম্পরা।
প্রতিবার ঘুমের আগে আচমকা শূন্যে অধঃপতনের যে অনুভূতি হয়, সেটাও জন্মমুহূর্তের নির্মম স্মৃতি বলে দাবি দালির। পরাবাস্তব ধারায় এসব স্মৃতির নির্মাণও ছিল তাঁর ছবি। দালি মূলত পরাবাস্তববাদী জিনিসপত্রের সাহায্যে ধ্বংস করতে চেয়েছেন আধুনিকতাবাদী চিত্রকলা ও তথাকথিত পরাবাস্তববাদী আঁকিবুঁকিকে। দালি চেয়েছিলেন যথার্থ পরাবাস্তব ছবি আঁকতে, যাতে প্রতিফলিত হয় প্রকৃত বাস্তব।
জীবনে দুই ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি ভেবেছেন দালি—একজন নিজের বাপ, অন্যজন পাবলো পিকাসো। পিকাসোকে তিনি আধ্যাত্মিক পিতা মনে করতেন। আর ছেলেবেলা থেকেই এ দুইজনের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল তাঁর। এটাকে দালি বলেছেন বীরের মতো লড়াই। এ ক্ষেত্রে ফ্রয়েড দালির গুরু ছিলেন। ফ্রয়েড অনুসারে, তিনিই বীর, যিনি পৈতৃক কর্তৃত্ব ও পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন আর তাদের ধ্বংস করেন। প্রথমত, নিজের বাপকে তো দালি ভালোবাসার সুযোগও তেমন দেননি; দ্বিতীয়ত, পিকাসোর ক্ষেত্রেও চিত্রের মাধ্যমে কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে যান, যা অ-পিকাসো মেজাজের। তবে পিকাসোর কৃতিত্বকে তিনি খাটো করেও দেখেননি কখনো। বরং মনে করেন স্পেন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ও আক্রমণাত্মক বৈপরীত্য দেওয়ার সম্মান অর্জন করেছে—এক. পিকাসো এবং দুই. দালির কাছে। তবে দালি একমেবাদ্বিতীয়ম।
এমন আরও কত বিষয়–আশয়: প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় দালি চিন্তা করতেন, তাঁর সত্যিকার জীবন শুরু হবে আগামীকাল থেকে, কিংবা তার পরের দিন কিংবা তারও পরের দিন থেকে। আর জেগে ওঠার একটু আগে দেখতেন অদ্ভুত সব স্বপ্ন, প্রচুর দৃশ্যসংবলিত। মনে হতো, তিনি অপেরা মঞ্চে আর পৃথিবীর মানুষ সব দর্শক তাঁকে দেখছে; অথবা তারাও দালির স্বপ্ন দেখছিল। অন্য ঘটনা, দালির পিতা–মাতার অগ্রজ সন্তান জন্মের কিছুদিন পরে মারা যান। তাঁর নাম ছিল সালভাদর দালি। সুতরাং দালির জন্মের পর পূর্বজ সালভাদরের স্মৃতি রক্ষার্থে এমন নাম রাখা হলো নবজাতকের। বিষয়টা শোনার পর দালি গভীরভাবে আলোড়িত হন যে তিনি তাহলে আরেকজনের অস্তিত্ব বহন করে চলেছেন জন্ম থেকে! তখন থেকে নিজেকে জীবনে নকল ও অপ্রাসঙ্গিক ভাবতে থাকেন। এমন সব অস্থির, উন্মাদ অথচ গভীরভাবে সৃজনশীল চিন্তাভাবনায় পূর্ণ ছিল দালির মনোজগৎ; আর তাঁর ছবিতেও তা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হতো। প্রায় সময় এমন কথাও বলতেন, ‘আমি আমার অগ্রজের মৃতদেহ বহন করে চলেছি। আমি একটা মৃত আত্মা। তাই দালির চিত্র এত রক্তশূন্য শবযাত্রার আনুষ্ঠানিক সম্ভার। যা নকল তা অপ্রাসঙ্গিক।’
এমন মানসকাঠামো ও কিম্ভূৎ জগতের পেছনে দালি নিজে কারণ খুঁজেছেন সমকালের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও বিপ্লবের অন্তঃসারশূন্যতার মধ্যে। তার বড় প্রমাণ পেয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা থেকে। মানবসভ্যতার এই অন্তঃসারশূন্যতা, বিশেষ করে ইউরোপীয় বিবেকের আকাল দালিকে খুব বিমর্ষ করে রাখত তরুণ বয়স থেকে। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কিংবা যুদ্ধের কালেও এমন আশঙ্কা করতেন যে কমিউনিজম বা জাতীয় সোশ্যালিজমের সমষ্টিবাদী, নান্দনিক কিংবা নব্যপৌত্তলিক ইউটোপিয়াগুলোর পরিণতি হবে ধ্বংস। বিশেষ করে ক্যাথলিক, ইউরোপীয় ও ভূমধ্যসাগরীয় ঐতিহ্যের দানবীয় রূপ এই ধ্বংস ডেকে আনবে। আর যুদ্ধশেষের ভোগবাদী ও যন্ত্রবাদ-উত্তর অভিজ্ঞতার দুর্দশা ইউরোপজুড়ে ছড়াবে মধ্যযুগীয় তমসা। এমন অবস্থায় দালির একমাত্র আশাবাদ অতীতের আধ্যাত্মিক সভ্যতার ভিত্তি। আরও আশা যে ইউরোপের এই আত্মিক সংকট থেকে উঠে আসবেন নবযুগের নায়কেরা। আর তিনি মনে করতেন, নিজে সেই পুনর্জাগরণের প্রথম অগ্রদূত। সুতরাং তাঁর প্রথম কাজ হচ্ছে নিজের যুগের ব্যক্তিবাদী বিজ্ঞানের প্রধান প্রধান শাশ্বত ধ্রুবক যৌন প্রবৃত্তি, মৃত্যুচেতনা ও স্থান–কালের যন্ত্রণাকে পুনর্নীরিক্ষা করে উচ্চতর খাতে প্রবাহিত করা। এ ক্ষেত্রে দালির নিজস্ব ইশতেহারও ছিল যে যৌন প্রবৃত্তিকে নবায়ন করতে হবে সৌন্দর্যতত্ত্বে, মৃত্যুচেতনাকে প্রেমে আর স্থানকালের যন্ত্রণাকে ধর্মে ও অধিবিদ্যায়। এ জন্য বেরিয়ে আসতে হবে তথাকথিত ধারণা, তত্ত্ব, রুচি ও নৈতিকতা থেকে। নিজের জীবনযাপন, চিন্তা, কর্মপদ্ধতি, বয়ান ও চিত্রে তাই অপরিচিত এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দালি হাজির হলেন মানুষের সামনে। মূলত মনুষ্যত্বের অনুসন্ধান; চিন্তা ও কর্মে প্রতিবাদী। এই প্রতিবাদ প্রচলিত মূল্যবোধ, শিল্পরুচি, বিশ্বাস, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, চিন্তা, দর্শন, জ্ঞানতত্ত্ব প্রভৃতির বিরুদ্ধে। তাই অনেকের কাছে মনে হয়েছিল, সালভাদর দালি উদ্ভট এক মানুষ ও শিল্পী। এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।