‘ফিরে দেখা’ প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত কয়েকটি শিল্পকর্মের কোলাজ। গ্রাফিকস: প্রথম আলো
‘ফিরে দেখা’ প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত কয়েকটি শিল্পকর্মের কোলাজ। গ্রাফিকস: প্রথম আলো

সমালোচনা

ফিরে দেখা সময়ে পুনরাবৃত্তির অনুসন্ধান

আমাদের গন্তব্য কোথায়? তার খেই না পেয়ে অদৃষ্টের লিখনের ওপর নির্বিবাদে এই যাত্রা ছেড়ে দিয়েও দায়মুক্তি কি মেলে? পেছনে ফিরে তাকাতেই তো দেখি সেই অমোঘ নিষ্ঠুর বলে পশ্চাতের আমি ঠেলছে সেই আমাকেই, তারই গতিতে এগিয়ে চলেছি সামনে। অর্থাৎ অনির্দেশ্য, অলীক কিছু নয় এই এগিয়ে চলা। বেদনাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও হৃদয় খুঁড়ে দেখতেই হয় তাই। সেই সুবাদেই ফিরে দেখার প্রয়াস থেকে যায়, স্মৃতি কিংবা ইতিহাসের গ্রন্থিতে ব্যক্তি কিংবা গণের আলেখ্য থেকেই করে নিতে হয় সাম্প্রতিক সময়ের সূত্র নির্ণয়।

সেই ফিরে দেখার প্রসঙ্গেই ‘ফিরে দেখা’ শিরোনামে রাজধানীর লালমাটিয়ার কলাকেন্দ্রে, গ্যালারি পরিসরে ফিরে এসেছে বাংলাদেশের বিগত শতকের সাত থেকে নয়ের দশকের শিল্পীদের গড়া কিছুসংখ্যক চিত্র ও ভাস্কর্য। কাজী রকিব, দীপা হক, রতন মজুমদার, রুহুল আমিন কাজল, ঢালী আল মামুন, দিলারা বেগম জলি, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, সাইদুল হক জুইস, ফারেহা জেবা, হাবিবুর রহমান, লালা রুখ সেলিম, তৌফিকুর রহমান ও ওয়াকিলুর রহমান—এই ১৪ শিল্পীর কাজ স্থান পেয়েছে গ্যালারিতে। বর্তমানের প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ এই শিল্পীরাই সে সময়ের তারুণ্যোদ্দীপ্ত চোখে যে সময়কে দেখেছেন, অনুভব করেছেন, তারই সম্মিলিত অভিপ্রকাশ এ প্রদর্শনী। এখানে প্রত্যেক ব্যক্তিশিল্পীর সৃষ্টিই তাঁর নিজস্ব অনুভূতির তাড়নাজাত হলেও অভিব্যক্তিগতভাবে একটি ঐকতানের আভাস পাওয়া যায়।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের পর থেকেই শুরু হওয়া এ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক দৃশ্যশিল্পের অভিযাত্রায় ঐতিহাসিকভাবে প্রতি দশকেই সমকালীন শিল্পীদের কাজে তাঁদের প্রজন্মের ঐক্যসুরটিকে লক্ষ করা গেছে, যেখানে ব্যক্তিগত বোধের সঙ্গে সমাজ ও সময়ের বাস্তবতার সম্মিলন শিল্পীদের কাজের উপজীব্য।

ঐকতানের এই সুর কেমন? ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের পর থেকেই শুরু হওয়া এ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক দৃশ্যশিল্পের অভিযাত্রায় ঐতিহাসিকভাবে প্রতি দশকেই সমকালীন শিল্পীদের কাজে তাঁদের প্রজন্মের ঐক্যসুরটিকে লক্ষ করা গেছে, যেখানে ব্যক্তিগত বোধের সঙ্গে সমাজ ও সময়ের বাস্তবতার সম্মিলন শিল্পীদের কাজের উপজীব্য। এটি বাস্তব যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সুবাদে পাওয়া আধুনিকতার ধারণা ও অভ্যাসের মধ্য দিয়ে উপনিবেশোত্তর দেশগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক বনিয়াদ গড়ে উঠেছে; সেই বৃহৎ প্যারাডাইমের জেরে নিজস্ব স্টাইল ও পরিচয় নিয়ে ব্যক্তিশিল্পীর উঠে আসা অস্বাভাবিক ছিল না, হয়েছেও তা–ই। কিন্তু একক শিল্পী এখানে কখনোই বিচ্ছিন্ন নন তাঁর সমাজ ও যুগচিন্তা থেকে। এই প্রদর্শনীতেও একই প্রবণতার অনুরণন দেখা যায়। যেসব শিল্পীর কাজ উপস্থাপিত হয়েছে এখানে, তা নিছক তাঁদের ব্যক্তিক আত্মমগ্নতা নয়, এই প্রকাশকে উতরেও বিগত শতকের যে সময়ের মধ্য দিয়ে তাঁরা গিয়েছেন, এর সঙ্গে শিল্পীদের একটি মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ পাওয়া যায় কাজগুলোয়।

শিল্পী সাইদুল হক জুইসের পেইন্টিং সিরিজ ‘মোহাচ্ছন্ন সমাজ’ শিরোনামটিই জানান দিচ্ছে সেই সচেতন বোধের। কোনো এক আততায়ীর ইশারাবলে চালিত কিছু অপ্রতিভ মানুষ, সঙ্গে ভাবনারত শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি। ঢালী আল মামুনের সিরিজ চিত্র—‘ইন দ্য টাইম অব প্রেগন্যান্সি’ চিত্রতলে মানুষ, মিথিক্যাল মোটিফ আর কিছু প্রাণী–অবয়বের প্রতীকী বিন্যাসে কিছুটা অস্বস্তিকর এক দৃশ্যপট রচনা করেছেন শিল্পী; উজ্জ্বল মৌলিক রঙের সমন্বয়ে বিভাজিত স্পেসের মাঝেও সময়ের অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ভবিতব্যের জঠরযন্ত্রণার আবহই যেন তা। অন্যদিকে একরঙা এচিংয়ে ‘বস সিরিজ’ শিরোনামে শিল্পী দিলারা বেগম জলি ছোট চিত্রপরিসরেও স্পেসের চিন্তিত বিন্যাসে সামাজিক কোনো অবদমনের চিহ্নসূত্র রেখে গেছেন। প্রায় সমধর্মী, অব্যক্ত ক্ষোভ আর যন্ত্রণার ভিন্ন প্রকাশ পাওয়া যায় শিল্পী ফারেহা জেবার কাগজে মিশ্র মাধ্যমে করা শিরোনামহীন ছোট পেইন্টিং সিরিজটিতে। বলিষ্ঠ ড্রইংয়ের মুনশিয়ানায় সুবিদিত শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যর সিরিজটি একইভাবে শিরোনামহীন হলেও ফিগারগুলোর ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তিতে সমসাময়িক অনাচারের প্রতি শিল্পীর বিদ্রূপের প্রয়াসটি দুর্বোধ্য নয়। অধিকাংশের কাজে পরিশীলিত বহুবর্ণিল মাধ্যমিক রঙের চেয়ে বরং কড়া প্রাথমিক রং আর দৃপ্ত রেখা অনুভব জাগায় লোকায়তের সঙ্গে শিল্পীদের সংস্রব কিংবা স্থানিকতার প্রতি তাঁদের সচেতন দৃষ্টির।

শিল্পীদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন ঢাকা পেইন্টার্স কিংবা সময় গ্রুপের মতো কালসচেতন প্রয়াসের সঙ্গে। হয়তো বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান অভিব্যক্তিবাদের এদেশীয় স্থানিক অনুরণন পাওয়া যায় ফিরে দেখা সেই দুই দশকের কাজে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী দশাগুলোর পর্যায়ক্রমিক রাজনৈতিক পালাবদলের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এই শিল্পীরা, যেখানে মধ্য সত্তরের একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান, তার জের ধরে দশকের অধিক সময়ব্যাপী চলা সেনাশাসন আর নব্বইয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন—এসবই দেখেছেন তাঁরা। শিল্পীদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন ঢাকা পেইন্টার্স কিংবা সময় গ্রুপের মতো কালসচেতন প্রয়াসের সঙ্গে। সময়ের অভিঘাত আর উত্তাপকে আমলে নিয়েই করেছেন স্বতন্ত্র শৈলীর নির্মাণ। হয়তো বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান অভিব্যক্তিবাদে অটো ডিক্স কিংবা গ্রজের কাজে যে তীব্র কটাক্ষ আর শ্লেষ, তার এদেশীয় স্থানিক অনুরণন পাওয়া যায় ফিরে দেখা সেই দুই দশকের কাজে।

সাম্প্রতিক বাস্তবতায় গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী একটি সক্রিয় প্রজন্মের সামনে যখন ইতিহাসের এমন দৃশ্যবয়ান হাজির হয়, তখন ভিন্ন সময় পরিসরে পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির একটি পর্যবেক্ষণ যুক্ত হয় তাতে। এ প্রদর্শনীও এই সম্ভাবনার জেরেই ফিরে দেখবার আহ্বান জানায় কয়েক দশক আগের সেই সময়কে। প্রবীণদের কাছে এই দেখা অনেকটাই স্মৃতিচারণা, আর নতুন প্রজন্মের কাছে তা বিগত সময়ের সঙ্গে এ সময়ের অনুভবের সেতুবন্ধের অবকাশ। এই সম্মিলিত দৃশ্য আয়োজনের প্রাসঙ্গিকতা কি শুধু এই সময়েই, নাকি আগের আরও ভিন্ন সময়ের অধ্যায়েও তার প্রয়োজন ছিল, যেখানে বাগাড়ম্বরের গণতন্ত্র পরিণত হয় উৎপীড়নের প্রকল্পে? অথবা সেই মধ্য সত্তর থেকে নব্বই অবধি নির্মিত সমকালকে উতরে যাওয়া এই শিল্পকর্মগুলো আবারও ফিরে দেখার প্রয়োজন হবে ভবিষ্যতের আরও কোনো কালপর্বে? সময়ই তার উত্তর দেবে। প্রদর্শনীটি কলাকেন্দ্রে গত ৩১ অক্টোবর শুরু হয়ে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত চলেছে।