গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

জন্মদিনে স্মরণ

প্রিন্সেস ডায়ানাকে নিয়ে আলোচিত পাঁচ বই

প্রিন্সেস ডায়ানাকে নিয়ে বহু জীবনী, উপন্যাস ও স্মৃতিগ্রন্থ লেখা হয়েছে। তাঁর চরিত্রটি তো শুধু ব্যক্তিগত নয়; বরং সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এমনকি অস্তিত্বগত প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। তাঁর জীবন এবং চারপাশে তৈরি হওয়া গল্পগুলো যেন একেকটি ‘মিথ’। তার দুখী দুখী চোখ, মানবিক ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কল্পনার অংশ। ডায়ানার জীবন ও চরিত্র এতটাই জটিল আর বহুমাত্রিক যে বিভিন্ন লেখক একেক দৃষ্টিতে সেসব তাঁদের লেখায় হাজির করেছেন। কেউ তাঁকে ট্র্যাজিক চরিত্র, কেউ আত্মবিপর্যস্ত নারী, কেউবা মিডিয়া আইকন ও ভুক্তভোগী, কেউ আবার অন্তরঙ্গ সেবকের দৃষ্টিতে কিংবা পালিয়ে যাওয়া নারীর প্রতীকরূপে ডায়ানাকে তুলে এনেছেন তাদের লেখায়।

অ্যান্ড্রু মরটনের ডায়ানা: হার ট্রু স্টোরি—ইন হার ওন ওয়ার্ডস

ডায়ানাকে নিয়ে লেখা সবচেয়ে আলোচিত বই। প্রথম সংস্করণে জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাজকন্যা ডায়ানার নিঃসঙ্গতা এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের অন্দরমহলের নানা গোপনীয়তা, তাঁর সাংসারিক জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতা উঠে আসে। রাজপরিবারের এসব দুর্ভেদ্য তথ্য উঠে আসায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।

অ্যান্ড্রু মরটন

লেখক অ্যান্ড্রু মরটনের সঙ্গে রাজকন্যা ডায়ানার একান্ত বন্ধুত্বের ফলে বইটি প্রকাশিত হয়। পুরো ব্যাপারটি তখনো তেমন জানাজানি হয়নি; কিন্তু ১৯৯৭ সালে ডায়ানার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় সংস্করণে ব্যাপারগুলো আর গোপন থাকেনি। এমনকি গোপনে টেপরেকর্ডারে নেওয়া ডায়ানার একটি সাক্ষাৎকারও এই সংস্করণে যুক্ত করা হয়।

ডায়ানার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—শৈশব, প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে সম্পর্ক, রাজপরিবার, দাম্পত্য জীবনের সংকট, আত্মহত্যার চেষ্টা, সন্তানদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং ক্রমাগত আত্মসচেতন এক নারীতে রূপান্তরের গল্প উঠে আসে বইটিতে। ডায়ানার দাম্পত্য জীবনের চরম একাকিত্ব, মানসিক চাপ ও প্রতিনিয়ত রাজতন্ত্রের নানামুখী সংকট তাঁর জীবনকে রূপকথার রাজকন্যা থেকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিরকালীন নারীর রূপে হাজির করে। তাই এই বইকে ডায়ানার আত্মপ্রকাশমূলক বই বলা হয়।

টিনা ব্রাউনের ‘দ্য ডায়ানা ক্রনিক্যালস’

মৃত্যুর এক দশক পরে বইটি প্রকাশিত হয়। ডায়ানার জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও তথ্যবহুল এ বইটি লিখেছেন টিনা ব্রাউন। সাংবাদিক পরিচয়ের সুবিধা নিয়ে তিনি রাজপরিবারের বিভিন্ন সদস্য, ডায়ানার বন্ধু, কর্মচারী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা এমনকি তাঁর সাবেক প্রেমিকসহ ২৫০ জনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বইটি ডায়ানার জীবনকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিস্তৃতভাবে দেখার সুযোগ তৈরি করে।

টিনা ব্রাউন

মোট ২১টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি শুরু হয় ডায়ানার বংশানুক্রমিক ইতিহাস, শৈশব, মা–বাবার বিচ্ছেদের ফলে ছোট ডায়ানার মানসিক ক্ষতের বর্ণনায়। এরপর আসে ডায়ানার রাজপরিবারে আসা এবং ধীরে ধীরে তাঁর পিপলস প্রিন্সেস হয়ে ওঠার গল্প।

ব্রাউন দেখান কীভাবে মিডিয়া ডায়ানাকে গড়ে তুলেছিল, আবার এই মিডিয়াই তাঁকে ধ্বংস করেছে। তিনি নিরপেক্ষভাবে এ–ও দেখান, ডায়ানা স্বয়ং কীভাবে মিডিয়াকে কৌশলে ব্যবহার করেছেন। তিনি ডায়ানাকে ‘মডার্ন সেক্যুলার সেন্ট’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন।

সেলি বেডেল স্মিথের ‘ডায়ানা ইন সার্চ অব হারসেলফ’

প্রথিতযশা জীবনীকার ও গবেষক স্মিথ। তিনি ডায়ানার জীবনকে দেখতে চেয়েছেন জটিল মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোয়। তাঁর ধারণা ডায়ানার মধ্যে ‘বর্ডার লাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ (BPD) ছিল। তাঁর জীবন ও আচরণ বিশ্লেষণ করে মনস্তাত্ত্বিক পাঠ এই বইকে ডায়ানাবিষয়ক অন্যান্য জীবনীগ্রন্থ থেকে অন্য এক উচ্চতা দিয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য এবং মিডিয়া–সৃষ্ট মিথের বাইরে গিয়ে স্মিথ ডায়ানার সূক্ষ্ম মানসিক বাস্তবতা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন বইটিতে।

সেলি বেডেল স্মিথ

প্রতিটি অধ্যায় ডায়ানার জীবনের একেকটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে নির্মিত। ডায়ানার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের আলোচনায় স্মিথ বলেন, তিনি প্রেম, স্বীকৃতি ও নিরাপত্তার জন্য একজন পুরুষ নির্ভরযোগ্য সঙ্গী খুঁজতেন; কিন্তু প্রতিবারই একধরনের আবেগজনিত বিচ্যুতি, অস্বস্তি এবং আকস্মিক পরিবর্তন তাঁর সম্পর্কগুলোকে ভেঙে দেয়।

স্মিথ শুধু ডায়ানার দুর্বলতা বা নেতিবাচকতা নিয়েই লেখেননি; বরং তিনি ডায়ানার অসাধারণ সংবেদনশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেলিব্রিটি স্ট্যাটাসকে মানবসেবায় ব্যবহার করার ক্ষমতার প্রশংসাও করেন।

পল বারেলের ‘অ্যা রয়েল ডিউটি’

লেখক পল বারেল ছিলেন ডায়ানার ব্যক্তিগত সহকারী, পরবর্তীকালে তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গীও। ডায়ানার মৃত্যুর পর রাজপরিবারের মৌনতা, মিডিয়ার নির্মমতা এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষাপট নিয়ে আংশিক স্মৃতিচারণা, আত্মপক্ষ সমর্থন এবং অনেকাংশে রাজপরিবারের প্রতি নীরব প্রতিবাদ হিসেবেই বইটি রচনা করেন।

ডায়ানার সঙ্গে পল বারেল

ডায়ানার মৃত্যু নিয়ে নানা রহস্য, ষড়যন্ত্র এবং মিডিয়ার বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন ডায়ানার কিছু ব্যক্তিগত সামগ্রী সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে রাজপরিবার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে মামলাটি শেষ পর্যন্ত তুলে নেওয়া হয়। বারেল তখন ‘কুইকস রক’ নামে জনপ্রিয়তা পান।

ডায়ানার সেবক হিসেবে নয়, পল বারেল তাঁর একান্ত বন্ধু, আস্থাভাজন ও পরামর্শদাতা হিসেবে ডায়ানাকে উপস্থাপন করেন। একজন সাধারণ, মমতাময়ী ও যন্ত্রণাবিদ্ধ নারী ডায়ানা কখনো মেঝেতে বসে কান্না করতেন, কখনো রান্নাঘরে নাশতা তৈরি করতেন। মানবিক সাহায্যকারী, বিশেষ করে এইডস ও ল্যান্ডমাইন বিষয়ে তাঁর সাহসিকতা অসাধারণ মমতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে বারেল তুলে ধরেছেন।

বইটি প্রকাশের পর রাজপরিবার এবং রাজতন্ত্রপন্থীদের কাছ থেকে তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। অনেকেই একে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখেছেন। প্রিন্স উইলিয়াম এবং হ্যারি প্রকাশ্যে বারেলকে ব্যবসাবাদী বিশ্বাসভঙ্গকারী বলেও উল্লেখ করেছেন।

মনিকা আলীর ‘আনটোল্ড স্টোরি’

বাস্তব ও মানুষের কল্পনার মধ্যবর্তী জগৎকে কেন্দ্র করে রচিত মনিকা আলীর অনটোল্ড স্টোরি (২০১১) একটি সাহসী ও সৃজনশীল উপন্যাস। কাল্পনিক চরিত্র লারা প্রকৃতপক্ষে ডায়ানার মতো একজন রাজকন্যা। নাম পরিবর্তন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছোট্ট একটি শহরে আত্মগোপনকারী জীবনযাপন করেন। প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্রে ছোটখাটো চাকরিও জোটান। অন্য সবার মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন; কিন্তু অতীত কখনোই তাঁর পিছু ছাড়ে না।

মনিকা আলী

উপন্যাসের কোথাও ডায়ানার নামোল্লেখ না করলেও পাঠক খুব সহজেই বুঝে ফেলেন লারা চরিত্রটি আসলে রাজকন্যা ডায়ানা। এ অপ্রকাশ্য কিন্তু সুস্পষ্ট মিল উপন্যাসটিকে ডায়ানাকে নিয়ে লেখা বইয়ের তালিকায় নিয়ে আসে। লারার ভেতরকার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে মনিকা আলী অসাধারণ সংযমে উপন্যাসে তুলে ধরেন। লারা স্বাধীন কিন্তু একা; গোপন কিন্তু সংকুচিত। উপন্যাসটি সরাসরি মিডিয়ার ভূমিকা এবং সমাজের সেলিব্রিটি-পিপাসার ওপর তীব্র সমালোচনা করে। ডায়ানার জীবন যেভাবে মিডিয়ার খোরাক হয়ে উঠেছিল, তারই এক কাল্পনিক প্রতিবাদ এই উপন্যাস।