
কিছুদিন পরেই অমর একুশে বইমেলা। কবি–লেখকেরা তাই নিজের বই নিয়ে সরব হতে শুরু করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেমন করে বইয়ের প্রচার চালালে প্রচারটি কার্যকর হবে, সে বিষয়ে ভালো দৃষ্টান্ত হতে পারেন মার্কিন ঔপন্যাসিক লরেন মেরি ফ্লেমিং। সম্প্রতি কেমন করে তিনি নিজের উপন্যাসের প্রচারণা চালিয়েছেন, সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে তা জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম
বইয়ের প্রচার নিয়ে আমাদের লেখকদের মধ্যে ‘মনে কী দ্বিধা রেখে’ ধরনের একটি ব্যাপার রয়েছে। তাঁরা স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের বইয়ের প্রচার চালাতে চান না। কোথায় যেন একটু লজ্জা–সংকোচ কাজ করে—নিজের বইয়ের কথা নিজেই প্রচার করে বেড়াব!
সময় পাল্টাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, তরুণ লেখকেরা সাড়ম্বরে নিজের বইয়ের প্রচার করছেন। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসে অনেকেরই অবগুণ্ঠন খুলে দিয়েছে। অনেক লেখকই লজ্জা-দ্বিধা সরিয়ে নিজের বই নিয়ে কথা বলছেন।
এ ক্ষেত্রে সবাই যে আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন, তা নয়। অনেকেই না বুঝে ফেসবুকে বুস্ট করছেন, পাঠকদের মেসেঞ্জারে-ইনবক্সে বইয়ের লিংক পাঠিয়ে বিরক্তির উদ্রেক করছেন। কারণে–অকারণে উদ্ভট-অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও রিলস বানিয়ে হাসির পাত্র হচ্ছেন কেউ কেউ।
মার্কিন লেখক লরেন মেরি ফ্লেমিং বলেন, মার্কেটিং কোনো সহজ বিষয় নয়। ছেলেখেলাও নয়। বইয়ের মার্কেটিং তো আরও কঠিন ব্যাপার। কারণ, এটি কোনো গতানুগতিক পণ্য নয়।
পণ্য হয় দুই ধরনের। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। আর বিলাসী পণ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন চাল, ডাল মানুষ নিজের গরজেই খুঁজে নেয়। কারণ, এসব ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে বিলাসী পণ্য তার খুঁজে বের না করলেও চলে। তাই এসব পণ্য নানাভাবে মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়।
বই হচ্ছে বিলাসী পণ্য। পৃথিবীর অনেক মূল্যবান বই না পড়েই বহু মানুষের জীবন কেটে যাচ্ছে। তাই ফ্লেমিং বলেন, ‘বইয়ের মার্কেটিংয়ের জন্য আপনাকে কৌশলী হতে হবে।’
নিজের প্রথম উপন্যাস লেখা থেকে শুরু করে এর বিপণন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফ্লেমিং বলেন, একটি বই লিখতে শুরু করার আগে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই জানা জরুরি। যেমন—
বইটি আপনি কেন লিখতে চাচ্ছেন, কিংবা যে গল্পটি পাঠককে জানাতে চাচ্ছেন, তা কেন চাচ্ছেন—সবার আগে এসবের উত্তর খুঁজে বের করুন। ফ্লেমিং বলেন, ‘আমি আমার প্রথম উপন্যাস বিকজ ফ্যাট গার্ল লেখার আগে নিজেকে প্রশ্ন করেছলিাম, কেন বইটি লিখতে চাচ্ছি। উত্তর পেলাম, স্তুলতা নিয়ে সমাজে যে বয়ান রয়েছে, সেগুলো ভেঙে দিতে চাই। স্তুল মানুষের বুলিংয়ের শিকার হওয়া নিয়ে আমার বলার কিছু আছে। এরপর উপন্যাসটি লিখতে শুরু করার পর নিজেকে প্রশ্ন করলাম, বইটি পাঠক কেন পড়বে? কীভাবে লিখলে পড়বেন?
‘এসব প্রশ্নের উত্তর যদি আপনি বের করতে পারেন, আপনার বইয়ের মার্কেটিংয়ের কাজ অর্ধেক হয়ে যাবে। নিজেও বুঝতে পারবেন না, আপনি যখন বইটি লিখতে থাকবেন, তখন অজান্তেই বইয়ের মার্কেটিংও করতে থাকবেন আপনি। তখন আপনি যা লিখবেন, তার মধ্যেই ঢুকে যেতে থাকবে মার্কেটিংয়ের উপাদান।’
ফ্লেমিং বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি দারুণভাবে ঘটেছিল। তাই বিকজ ফ্যাট গার্ল আমেরিকায় তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে। লাখ লাখ পাঠক বইটি কিনেছেন। অল্প দিনের মধ্যেই উপন্যাসটি নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার তালিকায় উঠে গিয়েছিল।’
কী লিখতে চাচ্ছেন, পাঠককে কী বার্তা দিতে চাচ্ছেন, তা শুরুতেই নির্ধারণ করতে হবে। একটা কিছু মনের মধ্যে এল আর লিখতে শুরু করলেন, এমনভাবে লিখে সফল হওয়ার দিন শেষ। আগেই ঠিক করে নিতে হবে, আপনার গন্তব্য কোথায়; অর্থাৎ আপনার এই বই বা উপন্যাসের কাহিনির চূড়ান্ত গন্তব্য কী, তা নির্ধারণ করে নিয়ে লিখতে বসতে হবে।
ফ্লেমিং বলেন, ‘বিকজ ফ্যাট গার্ল লেখার আগে আমি ঠিক করেছিলাম, এটি শুধু একটি বই হবে না, এটি হবে সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজও। সেভাবেই আমি কাহিনি সাজিয়ে সংলাপ লিখেছিলাম।’
গত বছরের ২২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের এনট্যাংগলেট পাবলিশিং থেকে বিকজ ফ্যাট গার্ল উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশের পর বেশ কিছু কাজ করেছিলেন ফ্লেমিং। তিনি বলেন, ‘আমি সাতটি স্থানীয় বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম এবং তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনারা কি আমার বইটি নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করতে চান?” এরপর ১৫ জন বন্ধুকে সরাসরি বলেছিলাম, “তোমরা কি আমার বই নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেবে?” তিনজন জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারকে বইটি উপহার পাঠিয়েছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম, তাঁরা যেন নিজেদের প্ল্যাটফর্মে এ বই নিয়ে ভালো-মন্দ রিভউ দেন। এরপর আমার বইয়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত ৩৩টি পডকাস্টে অংশ নিয়েছিলাম। এ ছাড়া সমসাময়িক আট লেখককে চায়ের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং তাঁদের সঙ্গে একাকী বইটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।’
বই লেখা ও বইয়ের প্রচার—দুই ক্ষেত্রেই লরেন মেরি ফ্লেমিংয়ের এসব কৌশল হয়তোবা কাজে লাগাতে পারেন আপনিও। তবে শেষ কথা হলো, আপনার ভেতরে সৃজনশীলতা না থাকলে কোনো কৌশলই কাজে লাগবে না। তাই সৃজনশীলতাকে ‘হ্যাঁ’ বলুন।
সূত্র: রাইটার্স ডাইজেট, ফ্লেমিংয়ের ওয়েবসাইট, নিউইয়র্ক টাইমস ও গুডরিডস