গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বইপত্র

গণসংগ্রাম ও বেহাত বিপ্লব: অতীত থেকে ভবিষ্যতের পাঠ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বামপন্থী ধারাটি বরাবরই ছিল বহুস্তরপূর্ণ, দ্বন্দ্বমুখর এবং অসম্পূর্ণতার ভারে নত—সেই জটিল প্রবাহকে তিনটি সুস্পষ্ট বিন্যাসে ধরার সচেতন প্রয়াস দেখা যায় ‘বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতি: মওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব’ গ্রন্থে। তাত্ত্বিক পটভূমি, ঐতিহাসিক বিকাশ ও রাজনৈতিক অনুশীলনের ধারাবাহিক বয়ানকে একসূত্রে গাঁথতে গিয়ে, মাঝপথে এসে লেখক সিরাজ উদ্দিন সাথী এই আখ্যানের কেন্দ্রে স্থাপন করেন বাম রাজনীতির এক অনন্য, বিপরীতধর্মী ও জনভিত্তিক নেতৃত্ব—মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ফলে গ্রন্থটি কেবল একটি মতাদর্শিক ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং বামপন্থী রাজনীতির উত্থান-পতন, তার সম্ভাবনা ও বেহাত হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে ব্যক্তি ও আন্দোলনের যুগল পাঠে উন্মোচিত করে। আজকের ‘নতুন বাংলাদেশ’-এ, যখন নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব সত্ত্বেও অনেকেই রাজনীতির ঐতিহাসিক সূত্র খুঁজে পান না, তখন বইটি একধরনের শিক্ষণীয় দলিল হিসেবে গুরুত্ব পায়—কারণ এর অধ্যায় ও উপ–অধ্যায়জুড়ে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতির পুনরাবৃত্ত ভুলগুলোর নিরাবরণ পাঠ।

শুধু অধ্যায়ের বিন্যাসেই নয়, বইয়ের শিরোনামেও লেখক সচেতনভাবে গ্রন্থটির তিনটি মূল পর্বকে স্পষ্ট করে তুলেছেন—বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতি, মাওলানা ভাসানীর জীবন ও রাজনীতি এবং বাংলাদেশে বামপন্থী বিপ্লব বেহাত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ও তার কারণ। এই ত্রিস্তর বিন্যাস পাঠককে শুরুতেই বইটির বৌদ্ধিক মানচিত্র সম্পর্কে ধারণা দেয়। প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার বিস্তৃত এই গ্রন্থের সম্পূর্ণ আলোচনা এখানে সম্ভব না হলেও এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দিক অন্তত আংশিকভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করব। যার মধ্য দিয়ে পুরো বইটির একটি ভ্রমণচিত্র আমরা দেখতে পাব আশা করছি।

গ্রন্থটি কেবল একটি মতাদর্শিক ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং বামপন্থী রাজনীতির উত্থান-পতন, তার সম্ভাবনা ও বেহাত হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে ব্যক্তি ও আন্দোলনের যুগল পাঠে উন্মোচিত করে।

বইটির প্রথমভাগে বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির ধারণাগত ও ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচিত হয়েছে। রাজনীতির ডান-বাম বিভাজন, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের মৌলিক ধারণা, এবং বাংলায় বাম রাজনীতির উত্থান এ অংশের ভিত্তি। পাশাপাশি পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, শ্রমিক আন্দোলন ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভূমিকা ও কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের ঢেউ, বিভাজন ও পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে বাম রাজনীতির গতিপথ, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণও এখানে ধারাবাহিকভাবে স্থান পেয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাও এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত।

গ্রন্থের প্রথমভাগে লেখক যে তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করেছেন, তা মূলত ধ্রুপদি মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক বস্তুবাদী বয়ানের অনুসরণে গড়ে ওঠা। রাজনীতির ডান-বাম বিভাজনের উৎপত্তিকে ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে রুশ বিপ্লব পর্যন্ত টেনে এনে লেখক একটি লিনিয়ার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা নির্মাণ করেন, যেখানে বাম রাজনীতি মূলত পরিবর্তনকামী, সাম্যবাদী ও এস্টাব্লিশমেন্ট-বিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই কাঠামোতে বামপন্থা প্রায় সর্বত্রই নৈতিক ও প্রগতিশীল অবস্থানে, আর ডানপন্থা রক্ষণশীল ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপিত।

এই অংশে ফরাসি বিপ্লবের আসনবিন্যাস থেকে ডান-বাম ধারণার উদ্ভবের বর্ণনা পাঠযোগ্য ও শিক্ষণমূলক হলেও এটা অনেকাংশেই সারসংক্ষেপে সীমাবদ্ধ মনে হয়েছে। আরেকটু বিস্তৃত হলে চিন্তাশীল পাঠকদের জন্য আরও বেশি উপভোগ্য হতো। ইউরোপীয় রাজনৈতিক ধারণার এই রূপান্তর কীভাবে উপনিবেশিত সমাজে ভিন্ন বাস্তবতায় কাজ করেছে—সে প্রশ্নটিও এখানে তুলনামূলকভাবে অনালোচিত। অর্থাৎ, ডান-বাম ধারণার স্থানান্তর ও রূপান্তর উপনিবেশিত বাংলার সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে কীভাবে সংঘটিত হয়েছে, সে বিষয়ে লেখক বিশ্লেষণকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে পারতেন। বইটি যেহেতু ২০২৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, সুতরাং পরবর্তী সংস্করণে এই অধ্যায়টির বিস্তারিত লেখার সুযোগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও একজন মাঝারি মানের পাঠক এই অধ্যায়টি থেকে একটা পরিষ্কার ধারণা পাবেন, ক্রিটিক্যাল পাঠকেরা পাবেন নিজেদের মতো ভাবার একটা স্পেস। হয়তো লেখক সেই স্থানটাই তৈরি করতে চেয়েছেন।

মার্ক্সবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যায় লেখক মূলত কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের ধ্রুপদি পাঠ অনুসরণ করেন—শ্রেণিসংগ্রাম, উৎপাদন সম্পর্ক, আদিম সাম্যবাদ থেকে পুঁজিবাদ হয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যে বিবর্তনমূলক ধারণা, তা প্রায় প্রশ্নাতীত সত্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এখানে মার্ক্সবাদের ভেতরের বিতর্ক—যেমন নির্ধারিত ইতিহাসবাদ বনাম রাজনৈতিক এজেন্সি বা ইউরোপীয় অভিজ্ঞতা বনাম উপনিবেশিত সমাজের বিশেষত্ব—এসব বিষয়ে লেখক নীরব অবস্থানের কারণে তাত্ত্বিক আলোচনাটি ব্যাখ্যামূলক হলেও সমস্যাকেন্দ্রিক নয়। এখানেও লেখক কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে পাঠকের নিজের মতো করে ভাবার জন্য একটা স্থান রেখেছেন।

আজকের ‘নতুন বাংলাদেশ’-এ, যখন নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব সত্ত্বেও অনেকেই রাজনীতির ঐতিহাসিক সূত্র খুঁজে পান না, তখন বইটি একধরনের শিক্ষণীয় দলিল হিসেবে গুরুত্ব পায়।

রুশ বিপ্লব ও ভি ই লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় রূপ লাভকে লেখক নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী অর্জন হিসেবে দেখেন। এখানে ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বিস্তার যেভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তা সংক্ষিপ্ত হলেও যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ। এখানেও বিশ্লেষণের ভার তিনি তুলে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। লেখকের অঙ্কিত এই ঐতিহাসিক মানচিত্র দেখা যাবে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা। এর মধ্য থেকেই পাঠককেই তার কারণ খুঁজে নিতে হবে।

বাংলায় বাম রাজনীতির আলোচনায় এসেই গ্রন্থটি তুলনামূলকভাবে বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন থেকে কমিউনিস্ট পার্টির বিকাশ—এই রূপান্তর লেখক দেখিয়েছেন একটি প্রায় স্বাভাবিক ঐতিহাসিক উত্তরণ হিসেবে। এখানে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ ও মার্ক্সবাদী রাজনীতির মধ্যকার টানাপোড়েন, কিংবা মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও রয়েছে সমালোচনামূলক ইঙ্গিত।

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতি-রণকৌশলসংক্রান্ত বিভ্রান্তি, ‘মুখ্য ও গৌণ দ্বন্দ্ব’ নির্ধারণে ব্যর্থতা, কিংবা বুর্জোয়া দলগুলোর ভেতরে ‘ফ্র্যাকশনাল ওয়ার্ক’-এর সিদ্ধান্ত—এসব বিষয় লেখক তুলে ধরলেও এগুলোকে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা নাকি নেতৃত্বগত ভুল—সে প্রশ্নটি খোলা রাখেন।

প্রথমভাগের সামগ্রিক তাত্ত্বিক অবস্থান অনুমান করা যায়, লেখক বাম রাজনীতিকে মূলত একটি নৈতিকভাবে ন্যায্য কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বারবার প্রতিকূলতার মুখে পড়া শক্তি হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রন্থটিকে পরিচিতিমূলক ও আন্দোলন-সহানুভূতিশীল করে তুলেছে। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির ইতিহাসকে এক জায়গায় এনে ধারাবাহিকভাবে পাঠযোগ্য করে তোলাই এই অংশের প্রধান শক্তি, যা পরবর্তী অংশে মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক ভূমিকা বিশ্লেষণের জন্য একটি প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক জমিন তৈরি করে।

বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতি: মওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব
লেখক সিরাজ উদ্দিন সাথী

প্রকাশক: অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স
প্রকাশকাল: ২০২৪
মূল্য: ৬০০ টাকা, পৃষ্ঠা: ২৯৬

আমরা আগেই জেনেছি বইটির দ্বিতীয় ভাগে মাওলানা ভাসানীর জীবন ও রাজনীতির বিস্তৃত আলেখ্য উপস্থাপিত হয়েছে। এই অংশে লেখক কোনো প্রকার ব্যাখ্যা না করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাসানীর জীবনকে তুলে ধরেছেন। ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শ বোঝার জন্য এখানে তার জীবনের আরও অনেক প্রধান বা অপ্রধান অনেক ঘটনা হয়তো এখানে অবতারণা করা যেত। তবে এই অধ্যায়ের সেই অভাবটি তিনি পূরণ করে দিয়েছেন বইয়ের শেষ অংশে। এখানে মাওলানার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি উপস্থাপন করেছেন লেখক। যা একনজরে মাওলানাকে জানতে সাহায্য করে। বইয়ের শেষে সমৃদ্ধ নির্ঘণ্ট থেকে সময়সাশ্রয়ী পাঠকেরা তার প্রয়োজনীয় অংশ খুঁজে বের করতে পারবেন। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠার নিচে টীকা ও তথ্যসূত্রগুলো শুধু তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাই বাড়ায়নি, ভাসানীকে আরও বিস্তারিতভাবে জনার দুয়ারও খুলে দেয়। এই ভাগটিতে এসেছে আজন্ম বিদ্রোহী ভাসানীর আসাম ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট, ন্যাপ, কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর সক্রিয়তা—বিশ্ব শান্তি আন্দোলন, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, চীন, কিউবা ও মধ্যপ্রাচ্য সফর—তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বৈশ্বিক মাত্রা তুলে ধরে। গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর অবস্থানও এখানে গুরুত্ব পেয়েছে।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ভেতর দিয়ে লেখক বইয়ের তৃতীয় ভাগে ‘বেহাত বিপ্লব’-এর ধারণাটিকে কোনো একক মুহূর্তের ব্যর্থতা হিসেবে নয়, বরং ধারাবাহিকভাবে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া একাধিক ঐতিহাসিক সম্ভাবনার সমষ্টি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম, আজাদ হিন্দ বাহিনী, নৌবিদ্রোহ, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—এই প্রতিটি সন্ধিক্ষণেই গণমানুষের মুক্তির বিপ্লবী সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই সেই সম্ভাবনা সংগঠিত বিপ্লবে রূপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

লেখকের বিশ্লেষণে এই ব্যর্থতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বগত ও তাত্ত্বিক সংকট। ভাসানী জনজোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, কিন্তু সেই জোয়ারকে বিপ্লবের মোহনায় প্রবাহিত করার দায়িত্ব যাঁদের ওপর বর্তায়—সোভিয়েতপন্থী ও চীনপন্থী কমিউনিস্টরা—তাঁরা ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তে প্রস্তুত ছিলেন না। একদিকে সোভিয়েতপন্থীদের নির্বাচনমুখী, আপসকামী ও বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের লেজুড়বৃত্তি; অন্যদিকে চীনপন্থীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, খণ্ডিত সশস্ত্রবাদ ও নকশালপন্থী বিচ্ছিন্নতা—দুই ধারাই শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ লেখকের কাছে শুধু জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ নয়, বরং একটি সম্ভাব্য সামাজিক বিপ্লবের ভ্রূণ। কিন্তু সেই ভ্রূণ আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির চাপে, ভারত-সোভিয়েত-আমেরিকার অভিন্ন কমিউনিস্ট-ভীতির কারণে এবং প্রবাসী সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের আপসহীনতার অভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। যুদ্ধকে ইচ্ছাকৃতভাবে সংক্ষিপ্ত করে, নিয়ন্ত্রিত রেখে, একটি ‘ভৌগোলিক স্বাধীনতা’ অর্জিত হলেও সামাজিক বিপ্লবের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। লেখকের ভাষায়, এটি ছিল একধরনের—‘বিপ্লবের গর্ভপাত’।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ভেতর দিয়ে লেখক বইয়ের তৃতীয় ভাগে ‘বেহাত বিপ্লব’-এর ধারণাটিকে কোনো একক মুহূর্তের ব্যর্থতা হিসেবে নয়, বরং ধারাবাহিকভাবে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া একাধিক ঐতিহাসিক সম্ভাবনার সমষ্টি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ট্র্যাজিক চরিত্র হয়ে ওঠেন ভাসানী নিজেই। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না, কিন্তু সমাজতন্ত্রকে গণমুক্তির পথ হিসেবে দেখেছিলেন। ধর্ম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যকার কৃত্রিম দ্বন্দ্ব ভেঙে তিনি যে অসাম্প্রদায়িক, জনভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির রূপরেখা হাজির করেছিলেন, তা কমিউনিস্টদের জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক সুযোগ। কিন্তু সংকীর্ণ মতাদর্শিক অনমনীয়তা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবনে ব্যর্থতার কারণে কমিউনিস্টরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে ভাসানীকেই একঘরে করে ফেলেছে।

ফলে লেখকের মূল্যায়নে ‘বেহাত বিপ্লব’-এর দায় ব্যক্তিগতভাবে ভাসানীর নয়; দায় একটি সমগ্র রাজনৈতিক ধারার—যে ধারা নেতৃত্ব, ঐক্য ও কৌশলের প্রশ্নে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এই অধ্যায়টি তাই শুধু অতীতের হিসাব নয়, বরং বাংলাদেশের বাম রাজনীতির জন্য এক নির্মম আত্মসমালোচনার দলিল, যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে বিপ্লব বারবার দরজায় এসেও সংগঠনের অভাবে, সিদ্ধান্তহীনতায় এবং আন্তর্জাতিক-জাতীয় শক্তির সমঝোতায় হাতছাড়া হয়ে গেছে।

পুরো গ্রন্থটি বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতি ও ভাসানীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে একত্রে বোঝার জন্য একটি প্রামাণ্য পরিচিতিমূলক কাজ। এই গ্রন্থের গুরুত্ব কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর মূল শক্তি নিহিত আছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে সম্ভাবনার ইতিহাস হিসেবে পুনঃপাঠ করার প্রয়াসে। লেখক পাঠককে একটি স্বস্তিদায়ক বয়ান দেন না, বরং এমন এক অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান—কেন এই ভূখণ্ডে গণমানুষ বারবার আন্দোলনে নামে, অথচ সেই আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক রূপ পায় না। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বইটি ব্যক্তি, সংগঠন ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার আন্তসম্পর্ককে উন্মোচন করে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিকে শুধু ঘটনাক্রম নয়, বরং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার ভেতর স্থাপন করে।

একই সঙ্গে গ্রন্থটি বর্তমান সময়ের জন্য একটি নৈতিক ও বৌদ্ধিক চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেয়। আজ যখন নতুন রাজনৈতিক শক্তি, নতুন দল এবং নতুন ভাষার আবির্ভাব ঘটছে, তখন এই বই স্মরণ করিয়ে দেয় যে ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়া কোনো রাজনৈতিক নবযাত্রা টেকসই হতে পারে না। অতীতের ভুল, দ্বিধা ও অপূর্ণতার পাঠকে অগ্রাহ্য করলে রাজনীতি কেবল মুখ বদলায়, কাঠামো বদলায় না। সে অর্থে, ‘বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতি: মওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব’ একটি স্মৃতিকথা বা আদর্শিক ঘোষণাপত্র নয়; এটি একধরনের রাজনৈতিক সতর্কবার্তা—যা ভবিষ্যৎকে নতুন করে কল্পনা করার আগে অতীতকে নির্মোহভাবে দেখার দাবি জানায়।