একসময় আকাশভরা রঙের মেলা ছিল। চারদিকে শুধু রং আর রং। বাহারি রঙে আকাশ তখন নরম রঙিন মেয়ে। পাগলপারা। আকাশকে তখন ছোঁয়া যেত। মেঘেরা হাত দিয়ে দুষ্টুমি করে ছুঁয়ে দিত আকাশের রঙিন তুলতুলে গাল। আর খিলখিল করে হাসত আকাশ। মেঘেরা কোনো বোনই চুলে খোঁপা বাঁধত না। ওরা সবাই ছিল এলোকেশী।আকাশ জোরে হাসলে চমকে যেত বাতাস। ভয় পেয়ে দুরন্ত বাতাস শুধু এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াত। কুণ্ডলী পাকাত নিজেকে। কখনো দমকা স্বভাব নিয়ে আছড়ে পড়ত পৃথিবীতে। তখন গাছপালা নুইয়ে যেত। সমুদ্র ফুঁসে উঠত। এই-না দেখে মেঘেরাও গর্জন করে উঠত। ভীষণ গর্জন। ভয়ে সূর্যও লুকিয়ে পড়ত আড়ালে। মেঘেরা দল বেঁধে ভাসতে ভাসতে আকাশকে চোখের আড়াল করে ফেলত। তখন আকাশের কী কান্না। শুধু কান্না আর কান্না। আকাশের কান্না কেউ দেখে ফেলতে পারে—এই ভয়ে মেঘেরা সেই কান্নাকে চুলের ভেতরে খোঁপা করে লুকিয়ে রেখেছিল এবং সেই কান্নার নাম দিয়েছিল ‘বৃষ্টি’। এই বৃষ্টিকে সব মেঘ মিলে নিজেদের বোন বানিয়ে বরণ করে নিল। বৃষ্টি হয়ে গেল মেঘেদের আদরের ছোট বোন। গুনে গুনে তখন মেঘেরা সাত বোন। এর পর থেকে মাঝেমধ্যেই বৃষ্টিকে পৃথিবীতে পাঠায়। বাতাস বাধা দিলেও পেরে ওঠে না মেঘেদের সঙ্গে। ঠিকই বৃষ্টি এসে পৃথিবীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকাশের সব কান্না শেষ হলে মেঘেরা ঘরে চলে যেত। তখন আকাশ আবার হাসতে পারত, প্রাণ ভরে দেখতে পারত।একদিন আকাশ ভাবল, সে সব রং বিক্রি করে দেবে। এই শুনে মেঘ, সূর্য, ভোর, দুপুর, সন্ধ্যাসহ আরও অনেকে হাজির। কে কত রং কিনতে পারে। কিন্তু শর্ত জুড়ে দিল আকাশ। বলল, রং বেচবে ঠিকই, তবে বিনিময়ে তার চাই রাশি রাশি নক্ষত্র আর তারা। তাতেও সবাই রাজি। যার ঘরে যত তারা আর নক্ষত্র ছিল, সবই দিয়ে দিল আকাশকে। সেই থেকে আকাশ ছোট-বড় অসংখ্য তারা আর নক্ষত্র দিয়ে সাজাল নিজেকে।এবার শুরু হলো কে কোন রং নেবে সেই প্রতিযোগিতা। সূর্য তার তেজি ভাব নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আমি উজ্জ্বলতা চাই।’ সেদিন অনেক রঙের উজ্জ্বলতা সে একাই কিনে নিয়েছিল। বিনিময়ে আকাশকে দিয়েছিল ‘ধ্রুবতারা’। কিন্তু মেঘেরা যে সাত বোন। ওদের সঙ্গে কে পারে। মেঘেরা জোর দাবি জানাল, তাদের চাই সাত-সাতটি রং। অনেক রঙের মধ্য থেকে বেছে বেছে পছন্দসই সাত রং নিয়ে নিল মেঘেরা। বৃষ্টি নামের বোনটিকে ওরা অনেক ভালোবাসে। বৃষ্টি সবার আদরের হওয়ায় ওকেই সবাই বিশেষ পার্বণে সাতরঙা শাড়িতে সাজায়। আমরা যে রংধনু দেখি, ওটাই বৃষ্টির শাড়ির সাজ, মেঘেদের কেনা সাত রঙের সমাহার।বিপদে পড়ল উষা, প্রভাত, ভোর আর সকাল। ওরা একে অপরের প্রতিবেশী। খুব আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা পরস্পরের। উষা ছোট হওয়ায় ওকে প্রথম পছন্দ করতে বলল। কিন্তু রং কোথায়। সবই তো মেঘেরা সাত বোন নিয়ে গেছে। তাই উষা কিনল স্বর্গীয় সোনালি রং। এই চার প্রতিবেশীর এতই মিল যে উষা তার কেনা স্বর্গীয় সোনালির সঙ্গে আবির মিশিয়ে রাঙা করে দিল প্রভাতকে। আর প্রভাত তার প্রভাতী রংকে পরিষ্কার করে সেখান থেকে স্বর্ণালু ধাঁচটা দিল ভোরকে। ভোরও রাঙা হয়ে উঠল রুপালি রূপে। বাকি থাকল সকাল। সকাল পেল কাঁচা কাঁচা রোদমাখা রং।দুপুর ভীষণ একা। কিন্তু সূর্যের সঙ্গে তার ভাব অনেক দিনের। তাই দুপুর সূর্যের কাছ থেকে উজ্জ্বলতা চেয়ে নিল। তেজি সূর্য তার তেজটা তুলে দিতে ভুলল না বন্ধু দুপুরকে। তাই দুপুর অনেক বেশি উজ্জ্বল আর প্রখর।লাজুক বিকেল তার লজ্জারাঙা গালে কী মাখবে, ভেবেই পেল না। কিন্তু সে গোধূলিদের বাড়ি পার হয়ে সন্ধ্যাদের বাড়ি বেড়াতে যায় প্রায়ই। অনেকক্ষণ কাটায় শান্ত স্বভাবের সন্ধ্যাদের বাসায়। সন্ধ্যার কাছে জানতে চাইল, কী রং কিনবে। সন্ধ্যা রং কেনার ব্যাপারে কোনো পরামর্শই দিল না বিকেলকে। বিকেল খুব সাজগোজ পছন্দ করে। ওর সারা গায় শুধু অলংকার আর অলংকার। কানে, নাকে, গলায় কাঁচা সোনার গয়না। কণ্ঠে পিতল দিয়ে গড়া মাদুলি। পায়ে ঝংকার তোলা রুপালি নূপুর। গোধূলি তাই বিকেলকে বলল, ‘দিদি, তুই রং দিয়ে কী করবি, তুই নিজেই তো বর্ণচ্ছটা, বর্ণালি।’ দিদিকে এ কথা বলে গোধূলি নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে সুযোগে বিকেল ওর অনেক দিনের জমানো লাল আলতা মেখে দিল গোধূলির গায়ে। গোধূলি হয়ে উঠল রক্তিম সিঁধুররঙা। সন্ধ্যাটা চিরকালই চুপচাপ স্বভাবের। প্রতিবাদহীন ছিল। কিন্তু সূর্যের বাড়াবাড়ি ভালো লাগেনি সন্ধ্যার। আড়ি দিল সে সূর্যের সঙ্গে। বলেছিল, সূর্য থাকাকালীন সে কখনোই ঘরের বাইরে বেরোবে না। এই একগুঁয়েমির জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে সন্ধ্যাকে। মূল্যবান শুকতারাটা আকাশকে দিয়ে দিতে হয়েছে। বিনিময়ে কিনতে হয়েছে সাদা-কালো মিশ্রিত পাংশুটে ছাই রং। সন্ধ্যাটা তাই ধূসরিত। ধূসর রঙে রঞ্জিত হয়ে আছে তখন থেকে। আকাশ অবশ্য কথা দিয়েছিল শুকতারাকে, সে ইচ্ছা করলেই ‘সন্ধ্যাতারা’ বলে ডাকতে পারবে। ঘুমকাতুরে রাত্রির চোখে রাজ্যের ঘুম। শুধু ঘুম আর ঘুম। ঘুম থেকে জেগে দেখে সব রং শেষ। শুধু অন্ধকার পড়ে আছে। কালো আর কালো। যেখানে রঙের কোনো বালাই নেই। মন খারাপ করে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে বিছানায়। এসব দৃশ্যই দূরে বসে একা একা দেখছিল হাসিমাখা চাঁদটা। ওর গালভরা শুধু হাসি। মায়াবী মুখ। চাঁদটার খুব মায়া হলো রাত্রির ওপর। সে রাত্রির ঘুম ভাঙিয়ে অভয় দিয়ে বলেছিল, ‘মন খারাপ কোরো না, আমি তোমায় এমন রং এনে দেব যে সবাই ঈর্ষা করবে।’ চাঁদ কোনো রং কিনল না। চাঁদের কাছে তাই এখনো অনেক তারা রয়ে গেছে। নিজে নিজে আনমনে সে খোঁপায় তারা গুঁজে বউ হয়ে সাজে। কপালে তারার টিপ পরে। নেচে-গেয়ে বেড়ায়। কথা রেখেছিল চাঁদ। মাঝেমধ্যে চাঁদ জ্যোৎস্না বিলায় রাতের গায়। তখন সবাই ঈর্ষা করে রাতকে। রাত হয়ে ওঠে ধবধবে ফরসা। জ্যোৎস্না পেলেই রাতের মনটা ভরে যায়। রাত গলে যায়। ডাগর চোখে চেয়ে থাকে। আর ঘুমাতে যায় না। শুধু জেগে থাকে।