নিউইয়র্কে রকওয়ে বিচের পাশে আটলান্টিকের ঢেউয়ের ওপর দুলছে চাঁদ
নিউইয়র্কে রকওয়ে বিচের পাশে আটলান্টিকের ঢেউয়ের ওপর দুলছে চাঁদ

নিউইয়র্কে জোছনা উৎসব

আমেরিকার আকাশে যখন দুপুরের পর থেকেই চাঁদ দেখা যায়

পৃথিবীর যেখানেই থাকেন না কেন চাঁদের ভাষা কিন্তু একই। চাঁদ, জোছনা আর জলের সমীকরণ কিন্তু একই। ১ আগস্ট নিউইয়র্কের বাঙালিরা মাতলেন চাঁদ ও জোছনার উৎসবে। আর উৎসবটি হলো এমন এক সময়ে যখন উত্তর আমেরিকার আকাশে দুপুরের পর থেকেই ভেসে ওঠে চাঁদের অবয়ব।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় কি জানেন, রকওয়ে বিচের পাশে আটলান্টিকের ঢেউয়ের ওপর যখন চাঁদের আলো দোল খাচ্ছিল, তখন আমার চিরচেনা মেঘনার কথাই মনে হচ্ছিল। পৃথিবীর যেখানেই থাকেন না কেন চাঁদের ভাষা কিন্তু একই। চাঁদ, জোছনা আর জলের সমীকরণ কিন্তু একই। পুরো বিষয়টিকে পৃথক করেছিল সমুদ্রসৈকতের কোল ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া চমৎকার পথ এবং হাজারখানেক বাঙালি।

আমেরিকায় আসার পরপর প্রথম যখন আমার এক বন্ধুর মুখে শুনলাম যে উত্তর আমেরিকার আকাশে দেখা চাঁদ আকারে অনেক বড় হয়, আবার গরমের সময় দুপুরের পর থেকেই আকাশে চাঁদের অবয়ব দেখা যেতে শুরু করে, সে সময় আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। একসময় দেখলাম, সত্যিই বছরের এ সময়ে চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছে চলে আসে এবং উত্তর আমেরিকার এ অংশ থেকে সেটা আরও বেশি বড় দেখায়। তখন একে বলে ‘সুপার মুন’। ১ আগস্টে ছিল পূর্ণিমা, পাশাপাশি সুপার মুন। এ উপলক্ষে ব্যতিক্রমী এক আয়োজন করেছিলেন চন্দ্রগ্রস্ত একদল তরুণ। তাঁদের কোনো নামের বাহাদুরি নেই, নেই বিজ্ঞাপনের সমাহার, কৃতিত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি নেই, নেই নিজেকে জাহির করার যুদ্ধ। সেই চাঁদপাগলদের আয়োজনের শিরোনামটাও ছিল বেশ পরিচ্ছন্ন—‘জলে গানে কবিতায়-জোছনা উৎসব ২০২৩’। সে  এক অপূর্ব আয়োজন।

বলা হয়, আমেরিকায় চার ‘ডব্লিউ’র নাকি কোনো ভরসা নেই—এক. ওয়েদার, দুই. ওয়েলথ, তিন. ওমেন আর চার ওয়ার্ক। কারও চাকরি সকালে আছে তো বিকেলে নেই। কেউ এই ধনী তো এই গরিব। কারও বান্ধবী সকালে আছে তো বিকেলেই কাট। আর ওয়েদার? এই গরম, এই কনকনে ঠান্ডা, এই রোদ, এই ঝুমবৃষ্টি।

জোছনা উৎসব ঘিরে ১ আগস্ট নিউইয়র্কে বাঙালিরা মেতে ওঠেন অন্য রকম আনন্দে

জোছনা উৎসব উপলক্ষেই কিনা কে জানে, দিনভর গরম থাকলেও সন্ধ্যায় ছিল চমৎকার ফুরফুরে বাতাস। তাই সন্ধ্যার অনেক আগে থেকেই উৎসব উদ্‌যাপন শুরু হয়ে গেল। নিউইয়র্কের প্রায় সব বড় শিল্পী, সাংবাদিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পানুরাগীর দেখা পাওয়া গেল সেখানে। পুরো আয়োজনটি হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করা হলেও আধিক্য ছিল রবীন্দ্রনাথের। ছিল জল-জোছনায় যুগলবন্দী, যন্ত্রসংগীত, নাচ, গান, কবিতা পাঠ, পুঁথিপাঠ, গেইম শো, জাদু প্রদর্শনী ও অভিজ্ঞতা বিনিময়। সঙ্গে ঝালমুড়ি, পিৎজা, ছোলা-চানাচুর আর বিরিয়ানি। সবশেষে অন্ধকারে হেঁটে বেড়ানো।

সেদিনের চাঁদ পাগল করেছিল প্রায় সবাইকে। মাইডাসের ছোঁয়ায় চারদিক যেমন সোনা হয়ে উঠত, সেদিন চাঁদপাগলদের ছোঁয়ায় চারদিক যেন আরও বেশি করে রুপালি হয়ে উঠেছিল। মঞ্চের এক দিকে জোছনার গান হচ্ছে, অন্য দিকে আটলান্টিকের ওপর জোছনা যেন গলে গলে পড়ছে। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য।

মঞ্চের ঠিক উল্টো দিকেই সুন্দর বাঁধানো পথ নেমে গেছে সৈকতের দিকে। তাই পুরো সময়ে কেউ হয়তো হাত ধরাধরি করে সমুদ্রসৈকতে হেঁটে বেড়িয়েছেন, কেউ হয়তো চিৎকার করে গান করেছেন, আবার কেউ চাঁদের দিকে তাকিয়েছিলেন এমনি-এমনি। ভিনদেশিদেরও অনেককে দেখা গেছে হঠাৎ থেমে গিয়ে সিঁড়ির পাশে বসে পড়তে। সেদিনের চাঁদ পাগল করেছিল প্রায় সবাইকে। মাইডাসের ছোঁয়ায় চারদিক যেমন সোনা হয়ে উঠত, সেদিন চাঁদপাগলদের ছোঁয়ায় চারদিক যেন আরও বেশি করে রুপালি হয়ে উঠেছিল। মঞ্চের এক দিকে জোছনার গান হচ্ছে, অন্য দিকে আটলান্টিকের ওপর জোছনা যেন গলে গলে পড়ছে। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য।

জোছনা উৎসবে লেখকসহ অন্যরা

গাড়ি পার্ক করার যন্ত্রণাটুকু যাঁরা সহ্য করে উঠতে পেরেছেন, তাঁদের সবার জন্যই জোছনা উৎসবের সন্ধ্যাটি ছিল মনে রাখার মতো। যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় একটা জোছনা উৎসব হবে, সেখানে আবার হাজারখানেক বাঙালি হাজির হবে, সেটা ছিল অবিশ্বাস্য। এটাই প্রমাণ করে দেখালেন গোপাল সান্যাল, জাহেদ শরীফ, আবদুল হামিদ, সুখেন জোসেফ গমেজ ও হাসানুজ্জামান সাকীরা। আয়োজনের উপদেষ্টা ছিলেন তাজুল ইমাম, শিতাংশু গুহ ও নূরুল আমিন বাবু। আহ্বায়ক ছিলেন স্বীকৃতি বড়ুয়া। অন্য যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ড. সাহানা ভট্টাচার্য্য, শুভ রায় ও পিনাকী তালুকদার। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন এ ইউ হাসান, সারোয়ার রাফী ও সুলতান আহমেদ। ব্যতিক্রমী আয়োজনের জন্য এ দল বেশ কিছুদিন ধরেই প্রশংসিত হয়ে আসছিল।