তিস্তা এক মায়ানদী। সৌন্দর্যের বিচিত্র রূপ তার জলে-স্থলে-আকাশে। একই দিনে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যায় সকালের, দুপুরের, বিকেলের, সন্ধ্যার—ভিন্ন ভিন্ন রূপ। স্থান পরিবর্তন করলে রূপ আরও বদলে যায়। বর্ষা-শীত-গ্রীষ্ম-হেমন্তে আলাদা আলাদা নৈসর্গিকতা নিয়ে দেখা দেয়। তিস্তাপারের মানুষের কাছে পরম বন্ধু এই নদী।
জীবনানন্দ দাশ ‘নদী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘রাইসর্ষের ক্ষেত সকালে উজ্জ্বল হ’ল—দুপুরে বিবর্ণ হয়ে গেল/ তারি পাশে নদী;/ নদী, তুমি কোন্ কথা কও?’ নদী যে কথা বলে, তা তিস্তায় গেলেই বোঝা যায়। তার নিজস্ব ভাষা আছে। কেবল জলের কলকল ধ্বনিতে সেই কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথা, ‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি’, এমন অযুত কথামালায় ভরপুর তিস্তা। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে তিস্তাকে মানুষ বলত পাগলী নদী। এখনো কোথাও কোথাও পাগলী নামে তিস্তাকে ডাকে। বিশেষ করে বর্ষায় তিস্তার আচরণ বোঝা কঠিন।
ভাওয়াইয়া গানে নদী বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, ‘তিস্তা নদীর শুটকারে পুড়ি পান্তাভাতও খাই রে’। তিস্তা বিধৌত জনপদ ভাওয়াইয়ার জন্ম এবং লালনভূমি। তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশের পর বাঁক নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে মিলেছে। বাঁকের ভেতরে থাকা লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম ভাওয়াইয়ার উর্বর ভূমি। ভাওয়াইয়ায় তিস্তা এতটাই প্রভাবক যে বাংলাদেশ বেতার প্রায় অর্ধশত বছর ধরে একটি গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে; যার নাম ‘তিস্তা পারের গান’।
বিখ্যাত ভাওয়াইয়াশিল্পী কছিম উদ্দীনদের মতো বড় বড় শিল্পী এ অনুষ্ঠানের প্রাণ ছিলেন। তিস্তাকে নিয়ে এত আয়োজন তা তিস্তারই কথা, তিস্তাকথন। সৈয়দ শাসমুল হক তাঁর লেখায় তেরো শ নদীর কথা ঘুরেফিরে বারবার লিখেছেন। আলাদা করে তিস্তার কথাও বলেছেন বহুবার। দেবেশ রায়ের তিস্তা পুরাণ, তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত–এর কথাও আমাদের মনে আছে।
সাধারণত কোন অনাদি কাল থেকে নদী বয়ে চলে, তার ঠিকুজি জানা অসম্ভব। কিন্তু তিস্তা নদীর বয়স জানা যায়। তিস্তা নদীর বয়সও তেমন বেশি নয়। ১৭৮৭ সালে আগস্ট মাসে একটি প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছিল। ওই সময়ে করতোয়া ছিল বিশাল নদী। প্রবল বন্যায় করতোয়া নদী পানি ধারণ করতে পারেনি। তখন করতোয়ার খাত পরিবর্তন হয়ে তিস্তা নদীর সৃষ্টি হয়।
প্রায় ২৩৬ বছর বয়সী তিস্তার পারে যে জনপদ, তারা তিস্তার পরম বন্ধু। যতবার বাড়ি ভেঙে যায়, ততবারই আবারও ঠাঁই নেয় নদীর পাড়েই। ১৫–২০ বার বাড়ি নদীতে ভেঙে যাওয়া মানুষ আবার বাড়ি করেছে তিস্তাপারেই। এ নদী জলদুগ্ধে বাঁচিয়ে রাখে তিস্তা অববাহিকার কোটি মানুষকে।
শীতকালে তিস্তার জল স্বচ্ছ ও সবুজাভ হয়। শীতল জলে পা ডুবিয়ে রাখলে সারা শরীরে শীতল পরশ ছড়িয়ে যায়। নদীতে আছে নানা রকম চর। সাধারণ চর, ফসলি চর, ডুবোচর। দ্বীপচরও আছে। দ্বীপচর মানে, যে চরের চারদিকে পানি। ডুবোচর থাকে পানির নিচে। পানির প্রবাহ দেখে বোঝার উপায় নেই। খালি চোখে মনে হবে, গভীর পানি। বাস্তবে হাঁটুজলও নেই। মাঝিরা ঠিকঠাক বুঝলেও কখনো কখনো হঠাৎ আটকে যায় তাঁদের নৌকা। জোরেশোরে ঝাঁকুনি খেতে হয়।
কখনো মাঝি নেমে পড়েন, নৌকা ঠেলে নিয়ে চলেন গভীর জলে। নদীতে পানির স্রোতে ভূমির বিচিত্র গঠন চোখে পড়ে। তিস্তায় আছে চোরাবালি। তিস্তার হালকা ভেজা চরে, কিংবা অল্প পানিতে অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। দাঁড়ালে পা ক্রমে বালুর নিচে যেতে থাকে। চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
শীত নামার আগে আগে তিস্তার চরে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু—সবাই ব্যস্ত সময় কাটাতে থাকে। রুপালি চরে আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, বাদাম, তামাক, ডাল, ভুট্টাসহ বিভিন্ন জাতের শস্য ফলানো হয়। যেসব চর চাষাবাদযোগ্য, সেখানে সকালেই চলে যান বাড়ির পুরুষেরা। বেলা গড়াতেই মেয়েরা বাড়ি থেকে গামছায় বেঁধে খাবার নিয়ে যান। দেখতে দেখতেই রুপালি চর সবুজ হয়ে ওঠে।
কোনো কোনো দিন দেখেছি, নৌকাভর্তি যাত্রী। প্রত্যেকে নারী। গোধূলির রং মেখে কৃষিমুখী নারীরা তিস্তার চরে কৃষিকাজ করে ফিরছেন। কেউ কেউ ছাগল তুলে নিয়েছেন নৌকায়। ছোট ছোট শিশুরাও নৌকার মাঝি। এপার-ওপার করছে। বইঠাচালিত নৌকা আছে। যন্ত্রচালিত নৌকাও কম নেই। তিস্তার রুপালি চরে সবুজের আস্তরণ তৈরি করেন আমাদের কৃষি নায়কেরা। নারী-পুরুষ-শিশু—সবাই তিস্তায় কৃষি উৎপাদন-উৎসবের সারথি।
অনেক দিন কেবল বেড়াতে গিয়েছি তিস্তায়। অনেক দিন গিয়েছি তিস্তা কেমন আছে, তা–ই দেখতে। কত দিন যে নদীর বুকে নৌকায় ভেসে বেড়িয়েছি পাখির খোঁজে ছবি তুলব বলে, তার ইয়ত্তা নেই। কদাচিৎ দেখেছি ডলফিন, ভেসেই ডুবে যায়। তিস্তায় পাখির রূপ দেখার জন্য আমাদের ক্যামেরায় চোখ রাখতে হয়েছে। টেলিফটো লেন্সে দেখেছি আমরা দূরের জলে নানারূপের পাখপাখালি।
রাজশাহীর পদ্মা, সিলেটের হাওরাঞ্চলে আমরা বিচিত্র পরিযায়ী পাখির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতাম। তিস্তাও যে পাখিতে সমৃদ্ধ, এটা আমরা কয়েকজন মিলে আবিষ্কার করেছি। গত কয়েক বছরে এখানে আমরা দেখেছি ‘মৌলভি হাঁস’, দেশি মেটে হাঁস, উত্তরে টিটি, পিয়াং হাঁস, উত্তরে ল্যাঞ্জা হাঁস, ছোট কান প্যাঁচা, নেপালি ইগল, ধলালেজ ইগল, ইন্ডিয়ান গুটি ইগল, মাছমুরাল, লম্বা পা তিশাবাজ, কালাঘাড় শাহিন, কমন কেস্ট্রেল, কাটুয়া চিল, মোটা হাঁটু, উল্টাঠোঁটি, কালো মানিকজোড়, দাগি রাজহাঁসসহ আরও বিচিত্র পাখি।
তিস্তা নদীতে আছে শতাধিক প্রজাতির পাখি। প্রতিনিয়ত তিস্তায় যেতে যেতে আমাদের বন্ধুত্ব কেবল নদীর সঙ্গে নয়, বন্ধুত্ব হয় নৌকার মাঝির সঙ্গেও। খাইরুল মাঝি। তিস্তায় পাখি এলেই আমরা তার কাছে খবর পাই। খাইরুলের কাছে খবর পেয়ে দেখেছি ভোঁদড়। তিস্তায় ভোঁদড় দেখা কল্পনাতীত ছিল।
তিস্তা কখনো জলদুগ্ধরূপী, কখনো রূপসৌন্দর্যের আধার, কখনো ফসলি বুক, জোছনালোকিত রাতে মায়াভরা জল ও চর। কখনোবা দুকূল ভেঙে চোখের জলে ভাসায় জনপদ। যে জলে ভেসে থাকে আনন্দঘন জীবন, সেই জলেই ডুবে যায় জীবনের আনন্দলোক। তিস্তা যেন মহাকাল। সবকিছুকে বুকে নিয়ে চলেছে নিরবধি।
তিস্তাপারের মানুষ নদী প্রকৌশল-প্রযুক্তি-সেচ প্রকল্প-মহাপরিকল্পনা অনেকটাই বোঝে। তারা এ-ও জানে, তিস্তার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র মিলিত হলে তার নাম হয় যমুনা। রাজবাড়ীতে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হলে যমুনার নাম বদলে গিয়ে হয় পদ্মা। এই পদ্মা মেঘনার সঙ্গে মিলে বয়ে চলে সমুদ্রে।
তিস্তাপারের মানুষ লোকায়ত জ্ঞান দিয়ে তিস্তাকে বিচার করে। শুষ্ক মৌসুমে নদী মরে গেলে তাদের মনে দেখা দেয় কষ্টের ছায়া। তারা জলে-মাছে ভরপুর তিস্তাকে দেখতে চায়। ভাঙনহীন জলমগ্ন তিস্তা তাদের কল্পনাসুন্দরী।