লোক–ঐতিহ্য, বাস্তবতা ও বিমূর্ততা—এই তিন ধারা কেবল শিল্পের পৃথক শৈলীমাত্র নয়; বরং মানুষের অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি ও মননের পরস্পরসংলগ্ন স্তর। বাস্তবতা আমাদের দৃশ্যমান জগৎ ও প্রতিদিনের সংঘাত-সম্পর্ককে স্পষ্ট করে, লোক–ঐতিহ্য আমাদের শিকড়, স্মৃতি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সন্ধান দেয়। আর বিমূর্ততা আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও মনস্তাত্ত্বিক সঞ্চরণে নিক্ষেপ করে—যেখানে দৃশ্য ও অর্থের সীমা মুছে গিয়ে জন্ম নেয় বোধ ও অনুরণন। এই তিন ধারাকে অবলম্বন করে লা গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে তিন তরুণ শিল্পীর ‘টিম্বার টেলস’ শিরোনামের চিত্র প্রদর্শনী।
রাকিব আলম শান্তর বাস্তবধর্মী গাছের শিকড়, পুরোনো ইমারত, সদরঘাটের নদী-নৌকা দৃষ্টিনন্দন ও কারিগরি দক্ষতায় প্রশংসনীয়। চিত্রগুলো শুধুই অনুরাগপূর্ণ বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি নয়, ভবিষ্যতে হয়তো দৃষ্টিনিবদ্ধ নথিভাষ্যের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও বিবেচিত হবে।
শাকিল মৃধার ‘গোয়ালিনী’, ‘কারু’, ‘মাছ কাটা’, ‘রসুই ঘর’, ‘চরকি’ শিরোনামের চিত্রে গ্রামীণ জীবনের গল্পগাঁথা রয়েছে; অর্থাৎ আমাদের শিকড় ও সংস্কৃতি রূপকথার মতো ধরা আছে। ছবিতে ফর্ম কখনো স্পষ্ট, কখনো ধোঁয়াটে। তাঁর ফর্মের জ্যামিতি লোকশিল্পীদের মতো সরল নয়, অতিমাত্রায় নকশাপ্রধান। কিছুটা রূপক ভাষা ব্যবহারে ‘রিভাইভাল অব নেচার’ চিত্রটি যথার্থই লোকশিল্প থেকে আধুনিকতায় সার্থক রূপান্তর বলা যায়।
আবু আল নঈমের চিত্রের গঠন একেবারেই ভিন্ন। তাঁর আধা বিমূর্ত ও বিমূর্তধর্মী চিত্রে এসেছে মনস্তত্ত্ব, দেহভাষা, অভ্যন্তরীণ অনুভব আর খণ্ড খণ্ড ইঙ্গিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘ডেস্ট্রাকশন’ চিত্রের কথা। যেখানে শিল্পীর দেহ অভ্যন্তরীণ ব্যথার অনুভূতি যেন রং ফর্ম ও টেক্সচারে পাঠযোগ্য। তাঁর ‘টেক্সচার’ ও রেখা যেন শিল্পীর মনের ছায়া—আধা বিমূর্ত হলেও গভীর আত্মপ্রকাশের ভাষা হয়ে ওঠে। তাঁর কাজে চিহ্নিত হয় আত্ম-অন্বেষণ ও ব্যক্তিগত ভাষার নির্মাণ, যা সাহসী এবং সম্ভাবনাময়।
এই দলীয় প্রদর্শনী একত্রে তিনটি ভিন্ন পথচলার আলতো ছোঁয়া—কখনো আলাদা, কখনো সমান্তরাল। কাঠের নিঃশব্দ রেখায় তিন শিল্পী তিনভাবে বলে গেছেন গল্প এবং তা বলা শেষ হয়নি—এই শুরু হোক তাঁদের দীর্ঘ অভিযাত্রার প্রথম অনুচ্ছেদ।
আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে ‘টিম্বার টেলস’ শিরোনামের প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ১৭ জুন। চলবে ২৫ জুন পর্যন্ত।