কাজলরেখা চলচ্চিত্রে সাদিয়া আয়মান
কাজলরেখা চলচ্চিত্রে সাদিয়া আয়মান

চলচ্চিত্র

‘কাজলরেখা’য় যেভাবে লোকগল্পের প্রত্যাবর্তন

বাঙালির উপকথায় কথা বলে শুকপাখি কিংবা মৃত রাজকুমার জেগে ওঠে ভালোবাসার স্পর্শে। সেখানে দুখিনী রাজকন্যারা বছরের পর বছর বনবাসে থাকে, অরণ্য তাদের লালন করে পরম মমতায়। সেসব উপকথা শত শত বছর পেরিয়ে আজও সজীব।

আমাদের দেশে লোককথাভিত্তিক চলচ্চিত্র একসময় ছিল বিপুল জনপ্রিয়। রূপবান, সাত ভাই চম্পা বা বেদের মেয়ে জোসনার অকল্পনীয় সাফল্য তা–ই বলে। কিন্তু সিনেমা ইদানীং শুধুই শহুরে মধ্যবিত্তের। গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত কাজলরেখা বহুদিন পর মাটির গন্ধে ভরা গল্পের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। প্রশ্ন হলো, এ সময়ের দর্শক কি এ রকম গল্পের জন্য প্রস্তুত? নতুন সময়ের উপযোগী করে ফুটিয়ে না তুললে পুরোনো লোককাহিনি কি দর্শক দেখবেন? গিয়াস উদ্দিন সেলিম সে ফাঁদে পা দেননি। বানোয়াট ভারতীয় সিনেমার মতো চোখধাঁধানো সেট, মেকআপ আর দৃশ্যায়নের জৌলুশ দিয়ে গল্পগুলোর সরলতার বারোটা বাজাননি।

এই ছবিতে হাওরের রাজার বাঁশের রাজপ্রাসাদ, মাটিতে পাটি বিছিয়ে বসা সভাসদ, কাঠের ময়ূরপঙ্খী নাও আর সাধারণ বেশভূষা চোখে আরাম দেয়। কাজলরেখার আসল সৌন্দর্য এর লোকেশনের নিসর্গদৃশ্যে। সুসং দুর্গাপুরের বিস্তৃত গাঢ় সবুজ আর নেত্রকোনা ও সিলেটের হাওরের সুনীল জলরাশি দর্শককে মুগ্ধতার আবেশে ভরিয়ে রাখে।

প্রকৃতির সৌন্দর্য অবশ্য কাহিনির গতিকে নষ্ট করে না। ঘটনার পরম্পরাকে সেলিম যেভাবে বুনেছেন, ছবির শেষ পর্যন্ত তা দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখে। খুব উঁচু লয়ের উত্তেজনা না থাকলেও একটা কৌতূহল ছবির শেষ পর্যন্ত দর্শকের মনোযোগ টেনে রাখে।

কিশোরী কাজলরেখার চরিত্রে সাদিয়া আয়মান বেশ মানানসই ছিলেন। বিপরীতে বড় কাজলরেখা মন্দিরা চক্রবর্তী ছিলেন নিষ্প্রভ। নকল রানি চরিত্রে রাফিয়াত রশিদ মিথিলা প্রাণ খুলে অভিনয় করেছেন। শরীফুল রাজের অভিনয়ও ছিল সংযত। কাজলরেখাকে বুঝতে না পারা বা পেয়েও হারিয়ে ফেলার বেদনা ও আর্তি খুবই বিশ্বাসযোগ্য ছিল।

কাজলরেখা মূল কাহিনির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও কিছু জায়গায়, বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে পরিবর্তন এনেছেন পরিচালক। নকল রানিকে জ্যান্ত পুঁতে মারার বদলে নাকে খত দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে শেষ করেছেন তাঁর গল্প। এ সময়ের সিনেমায় নারীর প্রতি সহিংসতার বিপরীতে এ ছবিতে কাজলরেখার মানবিকতা অর্থবহ হয়ে ওঠে। সেলিম নির্মল বিনোদনের ছবি বানাতে চেয়েছেন। তাতে তিনি সার্থক।

এ ছবির শিল্পনির্দেশনা অপূর্ব, কিন্তু ভিএফএক্সের কাজ কাঁচা। শুকপাখির হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া বা আকাশে তারা খসে পড়ার দৃশ্য বড্ড চোখে লাগে। লোকেশন সুন্দর হলেও গল্পটা চলচ্ছবির ভাষায় বলারও যথেষ্ট অবকাশ ছিল।

তবু সব মিলিয়ে এ সময়ের ছায়াছবির সহিংসতা, খিস্তি, ক্লিশে শহুরে গল্পের ভিড়ে কাজলরেখা নির্মল একঝলক বাতাসের মতো।