লন্ডনের কোনো আর্দ্র দুপুরে, থেমস নদীর ধারে বসে এক পুরুষ হয়তো খসড়া কাগজে লিখছেন—‘টু বি, অর নট টু বি’। যে বাক্যটি একদিন হয়ে উঠবে ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রশ্ন। কিন্তু লেখার সময় শেক্সপিয়র কি আদৌ কোনো প্রশ্নে ডুবে ছিলেন—না কি অন্য কোনো ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর কলম বয়ে যাচ্ছিল?
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক লিটারারি হাব-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখক স্যাম কেলি এই অদ্ভুত সম্ভাবনাটিই তুলে ধরেছেন, শেক্সপিয়র কি হ্যামলেট লিখেছিলেন গাঁজার নেশায়? প্রশ্নটি মজার, কিছুটা রগরগেও বটে; কিন্তু এর মধ্যে আছে সৃষ্টিশীলতার মনোবিজ্ঞান নিয়ে এক গভীর অনুসন্ধান।
সন্দেহের পেছনে ঐতিহাসিক কারণ
রেনেসাঁর যুগের ইংল্যান্ড ছিল ভেষজ ও ওষুধের পরীক্ষার সময়। চা-কফির মতোই বিভিন্ন ভেষজ পাতা, গাছের নির্যাস, এমনকি গাঁজাও ব্যবহৃত হতো নানা রোগ-বালাই বা ধ্যানচর্চায়। ইতিহাসবিদেরা বলেন, শেক্সপিয়রের সমসাময়িক কবি-নাট্যকারদের মধ্যে হেম্প পাইপ বা হার্বাল স্মোক-এর ব্যবহার ছিল সাধারণ বিষয়।
মূলত ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস থ্যাকারির গবেষণায় শেক্সপিয়রের বাগানে পাওয়া কাদামাটির পাইপে ক্যানাবিসের চিহ্ন আবিষ্কার হয়েছিল—কেলির আলোচনার সূত্রপাত্র সেই ঘটনা থেকেই। অবশ্য স্যাম কেলি বলেছেন, নিশ্চিতভাবে সেটি শেক্সপিয়রেরই পাইপ ছিল এমন কোনো প্রমাণ নেই, তবুও এই আবিষ্কারই এক দশক আগে এই প্রশ্ন তুলেছিল যে শেক্সপিয়র কি তবে ধোঁয়ায় ডুবেই ভাবতেন হ্যামলেটের একাকিত্ব?
সন্দেহজনক সাহিত্যিক আচ্ছন্নতা
শেক্সপিয়রের লেখার বিস্ময়কর গতি ও গভীরতা আজো গবেষকদের অবাক করে। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি লিখেছেন ওথেলো, কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট—সবই মহাকাব্যিক মাপের নাটক। কেলির দাবি, ‘মানুষ এমন টানা সৃষ্টিশীল উত্তেজনায় থাকতে পারে না, যদি না সে কোনো মানসিক বা রাসায়নিক তীব্রতার মধ্যে থাকে।’
তাঁর মতে, হ্যামলেট নাটকের দীর্ঘ মনোলোগগুলো, চরিত্রগুলোর আত্ম-সন্দেহ ও বিভ্রম এবং মৃত্যুচেতনার প্রতিটি প্রশ্ন যেন এমন এক মানসিক আবর্ত থেকে জন্ম নিয়েছে, যেখানে যুক্তি আর অনুভূতির সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যায়। ‘ক্যানাবিস হয়তো সেই সীমারেখাটিকে আরও অস্পষ্ট করেছিল,’—এই অনুমানই কেলির নিবন্ধের মূল কথা।
তবে তিনি স্বীকার করেন—এটি ইতিহাস নয়, সম্ভাবনার গল্প। কোনো নথি নেই, কোনো স্বীকারোক্তিও নয়; কেবল তাঁর ভাষায়, ‘ধোঁয়াটা এখনো রূপকই, বাস্তব নয়।’
হ্যামলেট-এর ধূম্রপাঠ
যদি সত্যিই শেক্সপিয়র গাঁজার ধোঁয়ার নিচে হ্যামলেট লিখে থাকেন, তাহলে নাটকটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। হ্যামলেটের ‘ডেলিরিয়াম’ (প্রলাপ), তার ভেতরের বিতর্ক এবং সর্বোপরি ‘টু বি, অর নট টু বি’-র মতো জটিল আত্মজিজ্ঞাসা সবকিছুই যেন এক সাইকেডেলিক ভাবনায় পূর্ণ।
কেলি প্রশ্ন জারি রাখেন, এমন তীব্র আত্ম-অন্বেষণ, এমন চেতনা ভাঙা অভিজ্ঞতা কি কেবল ভাবনার ফল, না কি কোনো উত্তেজক ধোঁয়ারও সাহায্য? এই প্রশ্নে ইতিহাস নিশ্চুপ, কিন্তু সাহিত্য চঞ্চল। কারণ হ্যামলেট যেভাবে ‘বাস্তব’ আর ‘প্রতিচ্ছবি’-র সীমা মুছে দেয় তা আধুনিক যুগসৃষ্ট মনোবৈজ্ঞানিক সাহিত্যেও অনন্য।
বলা হয়ে থাকে, যে কোনো শিল্পীর জীবনেই রহস্য থাকে। ভ্যান গঘের আত্মবিধ্বংসীপনা, পো-র মদ্যপতা কিংবা হেমিংওয়ের মানসিক অন্ধকার—এসব কাহিনি আমাদেরকে শিল্পীর মানবিক দিকটি দেখায়। স্যাম কেলির এই নিবন্ধটিও আসলে সেই ধারারই। তিনি শেক্সপিয়রকে ‘অপবিত্র’ করতে চাননি, শুধু বলতে চেয়েছেন সৃষ্টিশীলতার আগুন অনেক সময় এমন এলাকায় জ্বলে ওঠে, যা আমরা বুঝতে পারি না।
শেষ পর্যন্ত, প্রশ্নটি থেকে যায়—শেক্সপিয়র কি সত্যিই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় লিখেছিলেন? সম্ভবত না। আবার, কে জানে! তবে একথা বলা যায় যদি সত্যিই ‘স্টোনড’ অবস্থায় হ্যামলেট লেখা হয়ে থাকে, তাহলে ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ধোঁয়ার কুণ্ডলী সম্ভবত সেটিই।