
মন্টু ক্লাস নাইনে পড়ে। ১৯৬৪ সাল। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। মন্টুর বাবা মোয়াজউদ্দিন সাহেব সরকারি কলেজের শিক্ষক। বদলির চাকরি। এখন আছেন রাজশাহী সরকারি কলেজে।
মন্টুরা যে বাসায় থাকে, তার খুব কাছেই ভুবনমোহন পার্ক। বাসা থেকে বেরোলেই এক দৌড়ে যাওয়া যায়। বারান্দা থেকেও দেখা যায় বিশাল মাঠ। মাঠে প্রায়ই জনসভা হয়। বিশেষ করে রোববারে। ওই দিন অফিস–আদালতে ছুটি। তবে স্কুল–কলেজের ছুটি শুক্রবারে।
জনসভা হয় বিকেলে। তবে দুপুর থেকেই চিৎকার শোনা যায়: হ্যালো, মাইক টেস্টিং, ওয়ান–টু–থ্রি–ফোর, ভাইসব, অদ্য বিকাল পাঁচ ঘটিকায় ঐতিহাসিক ভুবনমোহন পার্কে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হইবে। উক্ত জনসভায় বক্তৃতা করিবেন গরিবের বন্ধু, জনদরদি নেতা...ইত্যাদি। শুনতে শুনতে মন্টুর মুখস্থ হয়ে গেছে।
বছর প্রায় শেষ। দুপুরে ভরপেট খেয়ে মন্টু তার ঘরে লুকিয়ে একটা বই পড়ছিল। বইয়ের নাম কলেজ গার্ল। মলাটের ভেতর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে লেখা: কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। বইয়ের পাতায় মন্টুর চোখ আঠার মতো আটকে যায়।
পড়তে পড়তে মন্টুর মনে পড়ে যায় পাশের বাড়ির নিরুদির কথা। নিরুপমা দত্তকে সবাই নিরু বলে ডাকে। বয়সে মন্টুর বড়। সে ডাকে নিরুদি। বড় হলেও তারা খুব ভালো বন্ধু। নিরুদি কলেজে পড়ে। মন্টু খেয়াল করেছে, নিরুদির বাসার সামনে দিয়ে কলেজের কিছু ছেলে যখন–তখন সাইকেল চালিয়ে যায়। গেটের কাছে এসে সাইকেলের বেল টেপে—ক্রিং ক্রিং। নিরুদির বাবা উকিল। তিনি বাসায় থাকলে বেশির ভাগ সময় বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে বসে থাকেন। খবরের কাগজ পড়েন। তিনি বাসায় থাকলে ছেলেরা আর বেল বাজায় না। সাইকেল নিয়ে শোঁ করে চলে যায়।
বইটা পড়তে পড়তে নিরুদির কথা মনে হলো মন্টুর। নিরুদিও তো কলেজ গার্ল। তবে বইয়ে যে রকম লিখেছে, সে রকম নয়। নিরুদি খুব ভালো। নিরুদি একবার মন্টুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল। মন্টু খুব লজ্জা পেয়েছিল। নিরুদির মুখ থেকে একটা গন্ধ বের হয়েছিল। গন্ধটা যেন কেমন। আইসক্রিমের নাকি বেলি ফুলের, মন্টু তা ঠাহর করতে পারে না। ওই গন্ধটা মন্টুর মুখে এখনো লেগে আছে।
নিরুদিকে আর সে দেখতে পাবে না। ওরা ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। জানুয়ারি মাসে একটা হাঙ্গামা হয়েছিল। কিছু লোক হিন্দুদের বাড়ি আর দোকানে হামলা করেছিল। নিরুদিদের বাড়িতে কেউ আসেনি। তবে ঢিল ছুড়েছিল। মন্টু বুঝতে পারে না, মানুষ কেন এমন করে।
হেমন্তের শেষ। জানালা দিয়ে পড়ন্ত বেলার নরম রোদ আর সেই সঙ্গে ঝিরঝিরে বাতাস এসে ঘরটাকে শীতল করে তুলেছে। মন্টুর ঘুম পাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে। কিন্তু কলেজ গার্ল–এর পাতা থেকে চোখ সরাতে পারছে না। হঠাৎ কানে এল তীব্র আওয়াজ—মাইক্রোফোন টেস্টিং, ওয়ান–টু–থ্রি–ফোর। একজন কর্কশ কণ্ঠে শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে বাতাসে শব্দ ছুড়ে দিচ্ছে—ভাইসব, আজকের ঐতিহাসিক জনসভার প্রধান বক্তা, বাংলার মানুষের প্রিয় নেতা, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী...।
মন্টু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এই চেঁচামেচিতে ঘুমানো যাবে না। কলেজ গার্লকে বালিশের নিচে লুকিয়ে রেখে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, ভুবনমোহন পার্কে বেশ কিছু লোক জমায়েত হয়েছে। কেউ ইতস্তত পায়চারি করছে। কেউ কেউ ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ঘাসের ওপর বসে বাদাম চিবুচ্ছে।
মন্টু শার্টটা গায়ে চাপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। তারপর রাস্তা পেরিয়ে সোজা পার্কের ভেতর। একদিকে কয়েকটা চৌকি পেতে তার ওপর শতরঞ্জি বিছিয়ে একটা মঞ্চ বানানো হয়েছে। মঞ্চের ওপর কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় কারও জন্য অপেক্ষা করছে। মন্টু পকেট হাতড়ে এক আনার একটা ধাতব মুদ্রার অস্তিত্ব টের পেল। একটা ছোকরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে—অ্যাই বাদাম, অ্যাই বাদাম। মন্টু তাকে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল: এক ছটাক দে।
মন্টু বাদাম চিবুতে চিবুতে মঞ্চের দিকে তাকাল। মঞ্চে একটা মাইকস্ট্যান্ড। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন বলছেন: আপনারা সবাই বসে পড়ুন। আমাদের প্রধান অতিথি এখনই এসে পড়বেন। মন্টু লোকটাকে চিনতে পারল। লোকটির পরনে সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি। মঞ্চের খুব কাছে বসে থাকায় মন্টু দেখল, তাঁর পাঞ্জাবির বোতামগুলো সোনার। তিনি পান চিবুচ্ছেন। শহরের সবাই তাঁকে চেনে। খুব বনেদি পরিবারের লোক। সাহেববাজারে তাঁর একটি ঘড়ির দোকান আছে। মাঝেমধ্যে তিনি দোকানে বসেন।
এমন সময় মঞ্চের সামনে একটা জটলা। কয়েকজন চিৎকার করে উঠল—জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। ভিড় ঠেলে একজন মঞ্চে উঠলেন। মন্টু দেখল, লোকটি অন্যদের চেয়ে লম্বা। পরনে ধবধবে সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ ভাঁজ হয়ে আছে, হাত থেকে লম্বা। তিনি মঞ্চে আসন গেড়ে বসলেন। এক হাতে একটা পাইপ, অন্য হাতে দেশলাই। তিনি দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালালেন। পাইপটা মুখে দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে থাকলেন। মন্টু এক ইংরেজ সাহেবকে এভাবে ধূমপান করতে দেখেছে।
হঠাৎ মন্টুর কানে একটা হইচইয়ের শব্দ এল। একটু দূরে পার্কের গা ঘেঁষে ষন্ডামার্কা ১০–১২ জন লোক। ওদের পরনে শার্ট আর লুঙ্গি। হাতে লাঠি। মন্টু শুনেছে, মিটিংয়ে গোলমাল করতে কিংবা মিটিং ভেঙে দিতে প্রতিপক্ষ অনেক সময় গুন্ডা ভাড়া করে আনে। তারা মিটিংয়ে হামলা করে, উপস্থিত লোকদের পেটায়। ভয়ে সবাই দৌড়ে পালায়। মন্টু এর আগে এভাবে দুটো জনসভা পণ্ড হতে দেখেছে। পাঁচ–ছয়জন মানুষ মারমুখো হলেই কয়েক হাজার মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারে।
মন্টু পকেটে হাত দিয়ে অবশিষ্ট বাদামগুলো আঁকড়ে ধরে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, ষন্ডামার্কা লোকগুলো হাতের লাঠি ঘোরাচ্ছে আর মঞ্চের দিকে এগোচ্ছে। যারা মাঠের ওপর বসে ছিল, তারা উঠে পালাবার পথ খুঁজছে। মুহূর্তেই মাঠ প্রায় ফাঁকা। কেবল মঞ্চের আশপাশে ৫০–৬০ জন দাঁড়িয়ে আছে।
এমন সময় মঞ্চের ওপর বসা দীর্ঘকায় লোকটি মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মন্টু দেখল, তিনি ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের আস্তিন গোটাচ্ছেন। তাঁর কণ্ঠ থেকে বাজখাঁই একটা চিৎকার বের হলো—ধর শালাদের!
ওই কণ্ঠে কিছু একটা ছিল। ষন্ডাগুলো হকচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর পেছন ফিরে ভোঁ–দৌড়।
মন্টু দেখল, ১৫ মিনেটের মধ্যে মাঠ আবার ভরে গেল কানায় কানায়। আট–দশ হাজার মানুষ হবে। দীর্ঘকায় লোকটি বক্তৃতা শুরু করলেন। তাঁর একটি বাক্যই মন্টু মনে রেখেছে—যদি মানুষের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা থাকে, তাহলে আপনারা ফাতেমা জিন্নাহকে হারিকেন মার্কায় ভোট দেবেন।
বক্তা ছিলেন একজনই। সভা শেষ হলো। মন্টু ঘরে ফেরার জন্য হাঁটা ধরল। মাগরিবের নামাজের আগেই ঘরে না ফিরলে বাবার বকুনি খেতে হবে।
মন্টুর একটাই কৌতূহল—লোকটা কে? একটা লোক একা দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, আর অমনি গুন্ডাগুলো ভয়ে পালিয়ে গেল! ওরা তো তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারত।
মন্টু রাস্তা পার হচ্ছে। হঠাৎ দেখে, পাশে হাঁটছেন বাবা। তিনিও বক্তৃতা শুনতে এসেছেন। মন্টুর মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল—আব্বা, লোকটি কে? ওই যে বক্তৃতা দিল? অধ্যাপক মোয়াজউদ্দিন খন্দকার স্মিত হেসে বললেন—শেখ মুজিব।