
বিংশ শতাব্দীর শেষ বিজয় দিবসে; ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর ‘বিশেষ বিজয় দিবস সংখ্যা’য় সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। আমাদের বহু মূল্যবান লেখা শুধু মুদ্রণের পাতায় রয়ে গেছে; তেমনি একটি এই ‘একাত্তরের চিঠি: প্রাপক বনলতা সেন’। তবে দীর্ঘদিন কেবল ছাপার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা এই লেখা বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই অনলাইনে উঠে এল নতুন পাঠকদের সামনে।
বিজয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনলাইনপূর্ব যুগে যত লেখা, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ ও কবিতা ছাপা হয়েছিল, বিজয়ের পুরো মাসজুড়ে সেসব ধুলোঝরা পৃষ্ঠা আমরা এবার প্রথমবারের মতো অনলাইনে তুলে আনব।
ক্রন্দসী এখন বাংলা। বনলতা, বহুদিন আজ
আমাদের যোগাযোগ নেই। এখনো হাঁটছি আমি
ইতিহাস অন্ধকারে হাজার বছর। শ্যামভূমে
দিনের গভীরে দিন, রাতের আড়ালে রাত। তুমি
শুধু নও শূন্য—কবিতার খাতাও এখন। ভাগ্যে
যদি এই চিঠি পৌঁছে যায় ঠিকানায়, জেনো আজও
একজন বেঁচে আছে—লিখি বেঁচে আছে সে কীভাবে।
এখন সূর্যের আলো পোড়া কাঠ অঙ্গারের কষ—
আমি যে বাংলার কবি আমি এই কষ চেটে খাই
শব্দের বদলে আজ—ছন্দের বদলে আমি এই
কষ টেনে টেনে খাই; ইদানীং ইতিহাস এই।
আকাশের মহাশূন্যতায় এখন কবর খুঁড়ি;
বাংলার মাটিতে আজ মাটি নেই সাড়ে তিন হাত;
আকাশেই হতে পারে তবে স্থানসংকুলান।—ভালো!
যখন আকাশে ফের দেখা দেবে নক্ষত্রসকল—
প্রতিটি নক্ষত্র হবে আমাদের প্রতিটি মৃত্যুর
উজ্জ্বল ফলকচিহ্ন। আকাশেই তবে অবিরাম—খোঁড়ো।
বনলতা, বাড়িঘর শেয়ালেরই গর্ত আজ বটে
কালো সাপ কোলে নিয়ে অবরুদ্ধ বাড়িতে প্রবাসী—
কবিতা এ নয়—আমি লিখে চলি চিঠি তোমাকেই
সুদূর নাটোরে। এখন তোমার চুল শ্রাবস্তীর
দ্রুত কালো হয়ে যাচ্ছে ঘোর অমাবস্যার বুরুশে।
তোমাকেই লিখে চলি, বনলতা, সমূহ সংবাদ।
কিন্তু এ অক্ষর ছাঁদ, এটা কার? নিজেই চিনি না।
হঠাৎ গুলির শব্দ চৌরাস্তায়—নিশ্বাস লুকিয়ে
গর্তে আরও ঢুকে যাওয়া—কিন্তু কী অদ্ভুত, আমি আজ
আমা থেকে এতটা বিচ্যুত—গুলি চলছে সত্ত্বেও
পথে ছুটে যাই, দেখি লাশ; একটি কুকুর একা—
তার লেজ নড়ছে না, সটান উদ্বেগে খাড়া, শুঁকে
চলে মনিবের ঘ্রাণ নাকি মৃত্যুর বুটের ছাপ।
কবি কিম্বা অন্যতর এখন যে আমি সেই লোক
চাপা শিস দিয়ে তাকে কাছে ডাকি: তবে তুই–ই আয়!
কে এখন তুই ছাড়া! সে কি আসে! দৌড়ে ছুটে যায়।
বাঙালি যে আছে আজও মাটি কামড়ে এখনো বাংলায়—
ভীষণ চিৎকার করে উঠি আমি: এ–ই তো কোদাল,
ছুটে এসো ধারালো কোদাল, একটি কবর খোঁড়ো
তোমার মৃতের জন্য রূপসী বাংলায়।—স্তব্ধতাই!
এখন সময় দ্যাখো নষ্ট ধ্বস্ত সময়ে গড়ায়।
এখন সূর্যের আলো পোড়া কাঠ অঙ্গারের কষ।
যুদ্ধ কী করব আমি!—হৃৎপিণ্ডে এতখানি শোক—
নদীবক্ষে ভাসে লাশ—বন্ধ সব জানালা–দরোজা—
বাতাসে উৎকট ঘ্রাণ পেট্রলের সতত অস্থির।
মাংস কি কাঠের মতো চড়চড় পোড়ে? ব্যাবিলন
নিমেষেই হয়ে যেতে পারে কি শ্মশান? এখন যে
যুদ্ধ করে, শত্রুর বিরুদ্ধে যারা এখন সৈনিক
প্রতি হৃৎস্পন্দনে তাদের জানি আমারই স্পন্দন,
অবরুদ্ধ আমারই নিশ্বাস তারা টানছে এখন।
আমি যে বাঙালি, আমি এইভাবে নিজেকেই দ্যাখো
আজ বাঁচিয়ে রাখছি।
ভোরে সূর্য ওঠে। আলো যেন
পোড়া কাঠ অঙ্গারের কষ আমি শব্দের বদলে
চেটে খাই, আজ এইভাবে জীবনের কম্পমান
হাতে আমি জীবিত রয়েছি—এইভাবে ইতিহাসে
দাঁড়িয়ে রয়েছি।—আমি ছিলাম বার্লিনে, আমি আছি
এখন ঢাকায়—আমি ভিয়েতনামে, নিকারাগুয়ায়—
এশিয়ায় আফ্রিকায় এইভাবে সূর্য থেকে আমি
পোড়া কাঠ হোক তবু তারই ঘন অঙ্গারের কষ
শব্দের গভীরে শব্দ চেটে চেটে এখনো নিজেকে
বাঁচিয়ে রেখেছি এক কবিতার অপেক্ষায়—লিখে
যাচ্ছি এই চিঠি দ্রুত হাতে তোমাকেই, বনলতা,
যখন তোমার চুল স্বর্ণপ্রভা একদিকে ওই
যোদ্ধার পূর্ণিমা ছুঁয়ে, অন্যদিকে এমন আঁধারে,
যখন এ অবরুদ্ধ দেশে আজ তোমার প্রেমিক
আয়নায় কিম্বা কোনো ডোবা জলে দ্যাখে অকস্মাৎ
কীভাবে মারিতে মুখ নষ্ট তার—শিরোদেশে টাক—
যেখানেই সে আজ ফেলে পা, পায়ে ঠেকে হাড়, খুলি,
হাঁসের ডিমের খোলা নষ্ট শসা খুলি ফেটে যায়।
আবার গুলির শব্দ, আরও মৃত্যু, আরও লাশ, আরও—
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি কবেই
কবরের অধিকারে চলে গেছে। তবে আকাশেই
কবর খনন করি আমি আজ মহাশূন্যতায়;
আকাশ তো মহাশূন্য, আজও শূন্য নয় এ হৃদয়;—
এখনো শিশুর মতো লেবুপাতা রৌদ্র পান করে,
এখনো প্রতিভা আছে—সংগোপনে বাঁচিয়ে চলেছি—
এখনো ঘুঙুর হয়ে ভাঁটফুল রাঙা পায়ে বাজে,
এখনো শব্দের স্বরে শুদ্ধতম অভিধা রয়েছে,
অপেক্ষায় মৃদঙ্গ রয়েছে, মালা গাঁথা রয়েছে যে
করণকৌশলে আজও, মাতৃদুধ এখনো রয়েছে।
তারই জন্যে এই বেঁচে থাকা, বনলতা, তারই জন্যে
অন্য কোনো খাদ্যাভাবে অঙ্গারের কষ চেটে চেটে
এই বেঁচে থাকা, এই মারিচিহ্ন মুখ তুলে ধরা,
প্রতিটি কবরে আজ জীবন্ত প্রোথিত—তবু আমি
আর আমাদের এই বাঁচা, এই শ্বাস টেনে চলা—
রূপসী বাংলায় যেন বিজয়ের অরুণ বিকেলে
তেরোশত নদীজলে আবার ভাসান হয়, লাশ
নয়, উৎসব দীপের; যেন প্রতি প্রেমে আমাদের
বনলতা তোমাকেই পাই; যেন প্রতি উচ্চারণে
তোমাকে উত্তর দিতে পারি, প্রিয়তমা, এত দিন
কোথায় ছিলাম আমি, কীভাবে ছিলাম।
খেলা করে
হাজার বছর; ইতিহাস সমুদ্রসফেন, আমি
গোপালের কাল থেকে হেঁটে হেঁটে হাজার বছর—
কৃষকের শূন্য থালা থেকে কত মাৎস্যন্যয় ঠেলে—
ফকির–সন্ন্যাসী নীল–তেভাগার দেশে ভেসে গেছি—
ইতিহাস রক্তাক্ত নিঃসীম লাল সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা, যখন সে
চোখে দ্যাখে সোনালি ধানের গ্রাম হাওরের খাদ্য
হতে হতে অকস্মাৎ, তেমনি দেখেছি তাকে—এক
দীর্ঘ বাঙালিকে—পাখির নীড়ের মতো এই বুকে
তার স্বপ্নডিম: সাপ কোলে বড় দীর্ঘ অমাবস্যা
জেগে হাজার বছর আমি এত দিন তাঁরই সঙ্গে
নৌকোয় ছিলাম।
বাইরে আবার গুলি। বনলতা,
এখনো নিশ্বাস বহে—আজ নয়—রাত্রি জাগো আজ—
উৎসবে সাক্ষাৎ হবে মুখোমুখি—পত্রে এতাবধি
২৪.১১.৯৯