দীর্ঘ পথ হাঁটতে গেলে একদিন পথেরা ফুরায়ে যায়—
ছোট্ট জীবন দীর্ঘতর হলে কেন জানি মহিমা হারায়;
এই কারেণই এখন আমার আর দীর্ঘ সম্পর্ক হয় না—
তবুও বিরাট করে লিখি, তোমাকে পাওয়ার সম্ভাবনা
তখনো আমার মনে ভাবনারা বসে থাকবে অনন্তকাল
আমাকে ধরতে যেয়ে আউলায়ে যাবে কামনার জাল,
শিশিরে জড়িত মাকড়সার কাহিনি আজও মনে রাখি;
আমরা দুজন মিলিত হতে চেয়েও শত্রুর মতন থাকি!
গোধূলির দিকে উড়ে যাওয়া এ জীবন যেন পাতি বক
সুগন্ধি রুমাল নিয়ে আমার পেছনে দাঁড়াল এক ঠগ—
ঠগিদের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিদিন উল্লাস দেখি
খুনের রুমাল নিয়ে আমার চারপাশে করিতেছে রেকি!
তবু এই ছোট্ট জীবনকে ভালোবেসে দীর্ঘ রচনা করি—
আসলে জীবন ঠগির সুগন্ধি রুমালের হ্যাঁচকা টানেরই।
খুব কাছের একজন আমাকে দেখিয়েছিল তার ক্ষত
তুলোর মতন প্রিয় নবজাতকের কনিষ্ঠ আঙুলের মতো;
প্রবল স্পর্শময় সেই অধরাকে হাতে নিয়ে বলল ‘ফুল’
ওই স্পর্শের আঙুলেই লেখা ছিল একজীবনের ‘ভুল’
ভুলের মাধুরীতে ভরে গেছে আমাদের যৌথ জীবন—
একদিন যার আনন্দ ভাই, আজ তার বেদনার বোন!
তারা সন্ধ্যায় ফোটে সকালে ওঠার আগে ঝরে যায়;
এই এক আদিম মোহ—সকলেই যা হাতে নিতে চায়।
যদিও দেখা যায় না, তাকে কল্পনা করে নিতে হবে—
তুমি রোজ ওই উত্তীর্ণ সন্ধ্যার বেলকনিতে দাঁড়াবে;
কল্পনা করে নিতে পারলেই পেয়ে যাবে তার মানে,
পেয়ে গেলে সেই ফোটার শব্দ তুমি দাঁড়াবে এখানে!
এই আনত সন্ধ্যার গোধূলিতে বসে আমি যত ভাবি—
কল্পিত রেখার ওপরে জীবন তুই কীভাবে দাঁড়াবি?
কল্পনার পাখায় আমি উড়ে যেতে শুরু করলাম যেই
চারিদিক এত সুন্দর হলো যার রূপ আছে সুগন্ধ নেই
তাহলে সে কেন সকাল হওয়ার আগেই ঝরে যায়
তদবির করে মহামান্য দেশের রাষ্ট্রদূত হতে চায়?
আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন, যে ফুল সকালে ঝরে,
এমন ঝাঁ ঝাঁ ব্যাকুল সুগন্ধ ছড়ায় যেন ব্যথা না করে
সে না থাকলেও তার তীব্র সুবাস ছড়িয়ে পড়বে মনে
তার পক্ষে আরও কিছু ব্যথা লিখে রাখছি প্রাণপণে।
ফলে এই ঝরাফুলগুলি এমন এক ধরনের আকার পায়
ধরতে গেলেও তারা কী করে যেন অধরাই থেকে যায়!
এমনই সে ধরতে না-পারা ময়ূর যে পেখম মেলে ওড়ে
তার জন্যে মহাজীবনের পক্ষে—আমি আজও ভবঘুরে;
প্রতিদিন তোমাকে কতরকমভাবে বলি—তুমি সুন্দর!
তুমি যেন সেই হারিয়ে যাওয়া ফুল্লশ্রীর পণ্ডিত নগর;
কিন্তু তুমি তো নগর নও, মনোহর নও তুমি রাজধানী
আমারে সে চেনে নাই—দীর্ঘশ্বাসেই রচিত এ কাহিনি
যে অচেনায় রাতেরা অথবার মতো দীর্ঘশ্বাস হয়ে নামে,
যেখানে প্রিয় ভোরগুলি অকস্মাৎ শিউলি তলায় থামে—
ভাবনারা মিলিত দুজনে করুণতম কাহিনি রচনা করে
শরতের ঘাস আজও কার ঘ্রাণ নিয়ে উপচায়ে পড়ে!
যে রমণে রাতে ফোটে, ভোরবেলা ঝরে যায় কামিনী
সে কারণে আমি আজও দীর্ঘকবিতা লিখতে পারিনি
তাই বড় করে তোমার কাছে এই ছোট্ট জীবন লিখি;
নিরালয় বসে ভাবি ক্রৌঞ্চের কথা—বেদনার বাল্মীকি!
তখন যারা জেগে থাকে, তারা জানে মহারাত্রির ঘোর;
রেইনট্র্রিগাছের মগডালে ইগল পাখিটির একলা প্রহর—
ভোরে গৃহস্থের ঘরে গলা খুলে যুবক মোরগ ডাক দেয়
জীবনের পক্ষে নিংড়ায়ে পড়া ওই ফুল্লশ্রীর জ্যোৎস্নায়
যেমন করে আমি তার কাছ থেকে চলে গেছি বহু দূরে—
যেমন করে কাছের আকাশে নক্ষত্রেরা ফোটে সুদূরে;
সেই আকাশের নিচে তোমার আমার মনোলীনা ভোর
চুম্বনপ্রার্থী দরজায়, ব্যথার সিটকানিতে হয়েছি কাতর।
আমি জেগে থাকি তারাভরা রাতে ওই দিগন্তের লোভে,
মানুষের পক্ষে যারা জাগে অসাম্যের সীমাহীন বিক্ষোভে;
কেউ আছে বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে ভিজতে চায় বন্ধুর মতো—
তাড়াহুড়ো করে ছাতা মেলতে যেয়ে ভিজে যায় দ্রুত!
এসবের ধারেকাছে না যেয়েও যে বসে থাকে মোহহীন
জীবনের ঘনিষ্ঠ কিনারার পাশে সে জীবন কেন চিরদিন
যে জীবন খেতেই পায় না অসহ্য এবং দুর্ভিক্ষতাড়িত;
মানেহীন করুণ বনরুটিটি যদি ভাগ করে খেতে দিত;
একালের অন্তরে আছি আমি, মহাকাল প্রান্তরে তুমি,
যেখানে কল্পনার বিরান চরে জেগে ওঠে হারানোর ভূমি
যদি তুমি সুদূর ভেবে হাঁটতে শুরু করো এই শুক্রবারে,
অনন্তকালের পথও ফুরায়ে যাবে পরবর্তী বিষ্যুদবারে;
তখন আবার কবিতা নিজে নিজেই ছন্দ পরিবর্তন করে...
এবং দীর্ঘকবিতার জন্য একটি ছোট্ট জীবনের হাত ধরে
একটি গন্ধবিহীন ফুলও তখন তার পাপড়ি মেলে দাঁড়ায়
এই ছোট্ট জীবন খাতাভর্তি দীর্ঘকবিতা লিখতে চায়;
তারপর আবার আমাদের বাংলা কবিতা হাত বদলায়—
সুগন্ধা নদীর বুকের ভিতরে একটি শুশুক লাফ দেয়
একটি ছোট্ট জীবনকে ভালোবেসে দীর্ঘকবিতার রচনা
তখন একজন অপরিচিতাকেও মনে হয় কতভাবে চেনা!
কথাহীন যে কথাদের সুর ওই দূর থেকে ভেসে আসে—
জীবনকে যখন বেশি ভাল্লাগে না তোমার বাম পাশে;
নিকট ফুরায়ে যাবে—তাকে আরও কাছে ধরে রাখো
পথের মধ্যেই তুমি পেয়ে যাবে পথ পেরোনোর সাঁকো।
যদি তুমি সাঁকো পেরিয়ে যাও, সন্ধ্যাকেও কাছে পাবে
সন্ধ্যামলতী ফুটবে কর্মকার পাড়ায়—ভোরে ঝরে যাবে
ফোটার আগেই যে ঝরে যায়—যেমন ঝরে গেছে রিতা
ছোট্ট জীবন নিয়ে সে লিখতে চেয়েছিল দীর্ঘকবিতা!
যেখানে ছন্দরা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে বাংলা কবিতার মতন
বিজয়ের উৎসব শেষ হয়ে গেলে কেন তার পরাজিত মন!
কবির কলমেও তো কত সহস্র শব্দের গুম-হত্যা-খুন
লবণচাষির ভাতের প্লেটে নেই আজও খোরাকের নুন
রাতের যেকোনো প্রহরে বোমা পড়বে, তবু শিশুটিকে
বুকে আগলায়ে জেগে থাকতে দেখেছি কবির মাকে—
এই ধরনের দৃশ্যের কাছে, যেকোনো ছন্দই পরাজিত
মাকে মনে পড়ে, সে আমার পঙ্গু পাকে কোলে নিত
কত প্রিয় শব্দরা ঝরে গেছে, খসড়া খাতাতে তার ঘ্রাণ
হৃদয়ও ছিঁড়ে গেছে, যেমন বাসনার এই ছেঁড়া কাঁথাখান
একটি মৃত শব্দের পক্ষে কবি, মা তার নবাগতর জন্য—
যখন দুজনেই জাগে মনে, তখন বনের নাম হয় অরণ্য
এই মধ্যরাতে আগ্রাসনের ভিতরে জন্মাবে যে ফিলিস্তিনে!
তার জন্য মা ও কবি ছাড়া প্রতীক্ষার ভাষা কেউ জানে?
পৃথিবীতে কোনো দিন কারও জন্যে এমন কেউ জাগে না
যতই লিখেছি বসে রাতে তোমাদের ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা
কোনো দিন জানতেও পারবে না জীবনের এত অপচয়!
জন্মের আগেই কেন এই মহাজীবনের অনিচ্ছা মৃত্যু হয়;
জীবন কখনোই দীর্ঘ দিবস ধরে মোটেও যাপন করা নয়
পৃথিবীর এইসব অন্ধগলির পথ কোনো দিন কি শেষ হয়?
তবু এই জীবনের পক্ষে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিমা,
যে জীবন বাঁচতে চেয়ে জানে নাই, মৃত্যুই তার পরিসীমা।
একটি সুগন্ধি ফুল মাঝরাতে জন্মে এবং ভোরবেলা ঝরে
সেই জীবনের পক্ষে তোমাকেই চেয়েছি আকার–উকারে!
এমত বেদনার কবিতায় তোমাদের জীবনের কিছু হয়?
করতলে কত শব্দ টলমল করে, কত শব্দরা মরে যায়!
কত দিন এই কলমের নিচে, বহু শব্দকে করিয়াছি কিমা,
তারেও তো জানি নাই—যে বেদনার নাম ছিল রহিমা
আমি সেই গ্রামের দিকে একটা জীবন তাকায়ে থেকেছি
তোমাকে পাওয়ার জন্য কত পঙ্ক্তি অযথা রচনা করেছি,
ঘুরিতেছি আকাশে বাতাসে ওই সুতোছেঁড়া ঘুড়ির মতন—
তোমাকে পেলে আরও বেশি ভালো হতো চিত্রকল্প মন;
ইটের ভাটার ভিতরে রচিত নগরবাড়ির যে নীরব নিস্তব্ধতা
তেমনই বেদনায় রচিত আমার এই দীর্ঘকবিতার খাতা;
ঘুণাক্ষরেও যদি জানতাম, টেনে আরও লম্বা করা যেত—
হে মোর ছোট্ট জীবন, যদি হতে এই দীর্ঘকবিতার মতো...