অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রবন্ধ

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

পরাবাস্তবতার প্রধান প্রবক্তা হিসেবে ব্রেটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গদ্যকীর্তি হলো ‘নাদজা’। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থ আত্মজীবনী, ডায়েরি এবং উপন্যাসের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এটি কোনো নির্মিত আখ্যান নয়; বরং লেখকের জীবনে আকস্মিকভাবে প্রবেশ করা নাদজা নামের এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতার সাংবাদিকসুলভ বিবরণ। নাদজা চরিত্রটি পরাবাস্তবতার জীবন্ত প্রতিমূর্তি। সে সমাজের প্রথাগত যুক্তির ধার ধারে না, চলে তার নিজস্ব খামখেয়াল ও অন্তর্দৃষ্টির ওপর ভর করে। তার মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা এবং মানুষের মনের কথা বোঝার এক রহস্যময় শক্তি। ব্রেটনের কাছে নাদজা ছিলেন বাস্তব ও স্বপ্নের সীমারেখায় বসবাসকারী এক মানবী, যিনি লেখকের অবচেতন সত্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারতেন। বইটির বিখ্যাত উক্তি, ‘বিউটি উইল বি কনভালসিভ অর উইল নট বি অ্যাট অল’; অর্থাৎ ‘সৌন্দর্য হবে খিঁচুনি ধরা, অথবা তার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।’ এই দার্শনিক অনুভব পরাবাস্তবতার এক নান্দনিক আদর্শকে প্রকাশ করে। এই ‘খিঁচুনি ধরা’ সৌন্দর্য প্রচলিত সুষম ও বিন্যস্ত সৌন্দর্যের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে; এ হলো সেই সৌন্দর্য, যা অপ্রত্যাশিত, চমকপ্রদ এবং যা আমাদের ভেতরকে নাড়িয়ে দেয়। নাদজার করুণ পরিণতি; অর্থাৎ তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া—এই বিতর্ককেও উসকে দেয় যে পরাবাস্তবতা কি তবে মানসিক অসুস্থতারই শৈল্পিক উদ্‌যাপন?

আঁদ্রে ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

ফ্রানৎস কাফকা ছিলেন এমন এক দুঃস্বপ্নের কারিগর। যদিও কাফকা পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের অংশ ছিলেন না, তবু তাঁর সাহিত্যকে এই আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কাফকার জগৎ এক আমলাতান্ত্রিক দুঃস্বপ্নের জগৎ, যেখানে ব্যক্তি অসহায়ভাবে এক অদৃশ্য ও বোধাতীত শক্তির করুণার পাত্রে পরিণত হয়। তাঁর ‘দ্য মেটামরফোসিস’ গল্পের প্রথম বাক্যটিই বিশ্বসাহিত্যে এক মাইলফলক। ‘এক সকালে গ্রেগর সামসা যখন অস্থির সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল, সে দেখল, সে তার বিছানায় এক দানবীয় পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে আছে।’ এই চরম অবাস্তব ঘটনাকে কাফকা বর্ণনা করেছেন সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও বাস্তবসম্মত ভঙ্গিতে। এই শৈলীই পাঠকের মনে তীব্র পরাবাস্তব অভিঘাত সৃষ্টি করে। গ্রেগরের এই রূপান্তর, তার বিচ্ছিন্নতা, পরিবারের কাছে তার উপযোগিতা হারানোর ভয় এবং আধুনিক জীবনের অমানবিকতার এক ভয়ংকর রূপক। একইভাবে ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসের নায়ক জোসেফ কে এমন এক অপরাধে অভিযুক্ত হয়, যা সে জানে না এবং সে এমন এক বিচারব্যবস্থার জালে জড়িয়ে পড়ে, যার কোনো নিয়মকানুন নেই। কাফকার এই যুক্তিহীন, দমবন্ধ করা জগৎ পরাবাস্তবতার মূল সুরকেই যেন ধারণ করে আছে।

একবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে পরাবাস্তবতার ধারাটিকে যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শৈল্পিকভাবে সফল রূপ দিয়েছেন, তিনি হলেন জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি। তাঁর লেখায় সমকালীন পরাবাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর উপন্যাসগুলোতে দৈনন্দিন জাপানি জীবনের অতি সাধারণ পটভূমি অবলীলায় প্রবেশ করে পরাবাস্তব ও অলৌকিক উপাদান। ‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসে কিশোর কাফকা তামুরা বাড়ি থেকে পালায় তার বাবার ইডিপাসীয় অভিশাপ থেকে বাঁচতে, আর তার যাত্রাপথে সঙ্গী হয় কথা বলা বিড়াল, আকাশ থেকে পড়া মাছের বৃষ্টি এবং কর্নেল স্যান্ডার্সের মতো এক আধিভৌতিক চরিত্র। ‘নরওয়েজিয়ান উড’-এর মতো বাস্তবধর্মী উপন্যাস লেখার পরও মুরাকামি বারবার ফিরে গেছেন পরাবাস্তবতার জগতে। তাঁর মতে, আমাদের এই বাস্তব জগতের সমান্তরালেই আরেকটি জগৎ সক্রিয় এবং সেই জগতের শক্তি প্রায়ই আমাদের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর চরিত্ররা একাকিত্ব, হারানো প্রেম এবং অস্তিত্বের অর্থ খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই এই দুই জগতের মাঝখানে আটকা পড়ে। মুরাকামির লেখনী প্রমাণ করে, পরাবাস্তবতা কেবল একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন নয়, এটি মানব মনের গভীর সত্যকে উন্মোচন করার এক চিরকালীন পদ্ধতি।

যদিও কাফকা পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের অংশ ছিলেন না, তবু তাঁর সাহিত্যকে এই আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে পরাবাস্তবতার ধারাটিকে যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শৈল্পিকভাবে সফল রূপ দিয়েছেন, তিনি হলেন জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি।

বাংলা সাহিত্যে পরাবাস্তবতার অনুরণন

ইউরোপীয় পরাবাস্তবতা যে রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, বাংলা সাহিত্যে ঠিক সেই রকম কোনো সুসংগঠিত আন্দোলন দেখা যায়নি। কিন্তু এর উপাদান ও দর্শন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের রচনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের মনন ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তিনিষ্ঠ ও বাস্তববাদী হলেও, এর গভীরেও রয়েছে এক মায়াবী ও অতিলৌকিক জগৎ।

জীবনানন্দ দাশ ছিলেন তেমনই এক ধূসর স্বপ্নের কবি। বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রথম সার্থক প্রয়োগ সম্ভবত জীবনানন্দ দাশের হাতেই ঘটেছিল। তাঁর কবিতায় চেতনা ও অবচেতনের সীমানা মুছে যায়। ‘বনলতা সেন’–এর মতো কবিতায় রোমান্টিকতার আড়ালেও রয়েছে এক পরাবাস্তব আবহ, যেখানে ইতিহাস, ভূগোল ও ব্যক্তিগত স্মৃতি একাকার হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর পরাবাস্তব রূপটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বা ‘মহাপৃথিবী’র কবিতাগুলোতে। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ এই পঙ্‌ক্তিগুলো কেবল সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র নয়, এটি এক পরাবাস্তব পরিস্থিতি যেখানে সব মূল্যবোধ উল্টে গেছে। ‘শিকার’ বা ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় প্রকৃতি ও মানব মনের গহিন রহস্য একাকার হয়ে এক স্বপ্নিল ও প্রায়ই আতঙ্ক জাগানো জগৎ তৈরি করে। জীবনানন্দের চিত্রকল্পগুলো—‘ভিজে পেঁচার ডানা’, ‘ইঁদুরের রক্তমাখা ঠোঁট’, ‘নাটাফলের মতো চোখ’—প্রচলিত কাব্যিক সুষমাকে আঘাত করে এক নতুন, ঝাঁকুনি দেওয়া সৌন্দর্যের সন্ধান দেয়, যা ব্রেটনের ‘কনভালসিভ বিউটি’র কথা মনে করিয়ে দেয়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চরিত্রগুলোও অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে পরাবাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ বা ‘চাঁদের অমাবস্যা’ আপাতদৃষ্টিতে বাস্তববাদী উপন্যাস হলেও, তাঁর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসটিতে পরাবাস্তবতার গভীর ছায়া পড়েছে। কুমুরডাঙ্গা নামের এক রহস্যময় ও ক্ষয়িষ্ণু নদীকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের আখ্যান। নদীটি এখানে কেবল একটি ভৌগোলিক উপাদান নয়, এটি যেন এলাকার মানুষের অবচেতন এবং তাদের অনিবার্য ধ্বংসের প্রতীক। উপন্যাসের বর্ণনাকারী তবারক ভূতের গল্প বলে, কিন্তু তার গল্পগুলো নিছক অলৌকিক কাহিনি নয়; বরং তা মানুষের মনের গভীরের ভয়, পাপবোধ ও অস্তিত্বের সংকটকে মূর্ত করে তোলে। নদীর কান্নার যে জনশ্রুতি, তা বাস্তব ও পরাবাস্তবের সীমারেখাকে মিলিয়ে দেয়। ওয়ালীউল্লাহ ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং মানুষের মনের জটিল স্তরগুলোকে উন্মোচন করার জন্য তিনি পরাবাস্তবতার কৌশল ব্যবহার করেছেন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’য় জাদুবাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার এক অনবদ্য মিশ্রণ ঘটেছে। তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসে বাস্তব ঐতিহাসিক সংগ্রামের পাশাপাশি উঠে এসেছে লোকপুরাণ, মিথ এবং স্বপ্নের এক বিশাল জগৎ।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩—মৃত্যু: ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭)

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’য় জাদুবাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার এক অনবদ্য মিশ্রণ ঘটেছে। তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসে বাস্তব ঐতিহাসিক সংগ্রামের পাশাপাশি উঠে এসেছে লোকপুরাণ, মিথ এবং স্বপ্নের এক বিশাল জগৎ। উপন্যাসের চরিত্ররা প্রায়ই খোয়াব বা স্বপ্নের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ বা অবদমিত ইচ্ছার সংকেত পায়। চেরাগ আলী ফকিরের মতো চরিত্র, যে পুকুরে ডোবা মানুষের লাশকে কথা বলাতে পারে বা কাতলাহার বিলের নিজস্ব যে আধিভৌতিক সত্তা—এগুলো উপন্যাসটিকে এক পরাবাস্তব মাত্রায় উন্নীত করে। ইলিয়াস দেখিয়েছেন যে সাধারণ মানুষের জীবন কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংগ্রাম দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়; তাদের চেতনার গভীরে প্রোথিত আছে স্বপ্ন, বিশ্বাস ও মিথের এক শক্তিশালী জগৎ।

এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখক অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’ বা ‘মহিষকুড়ার উপকথা’র মতো উপন্যাসে বাস্তবতার এক ভিন্ন বয়ান তৈরি হয়েছে, যা ইউরোপীয় পরাবাস্তবতার সংজ্ঞায় না পড়লেও প্রচলিত বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যায়। বাংলাদেশের কবি ও শিল্পী হাসানুর রহমান তাঁর কবিতায় ও চিত্রকর্মে পরাবাস্তব চিত্রকল্পের ব্যবহার করেছেন। আধুনিক কবিদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সামাজিক বাস্তবতা প্রকাশের জন্য পরাবাস্তব ভাষার আশ্রয় নেন।

জীবনানন্দ দাশ (জন্ম: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯—মৃত্যু: ২২ অক্টোবর ১৯৫৪)
বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রথম সার্থক প্রয়োগ সম্ভবত জীবনানন্দ দাশের হাতেই ঘটেছিল। তাঁর কবিতায় চেতনা ও অবচেতনের সীমানা মুছে যায়। ‘বনলতা সেন’–এর মতো কবিতায় রোমান্টিকতার আড়ালেও রয়েছে এক পরাবাস্তব আবহ, যেখানে ইতিহাস, ভূগোল ও ব্যক্তিগত স্মৃতি একাকার হয়ে যায়।

পরাবাস্তবতার শিকড় প্রোথিত ছিল একাধিক দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বের গভীরে। এর সবচেয়ে বড় ভিত্তি ছিল সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েডের ‘দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’ গ্রন্থটি ছিল পরাবাস্তববাদীদের কাছে বাইবেলের মতো। ফ্রয়েড বলেন, স্বপ্ন হলো ‘অবচেতনের রাজপথ’ (দ্য রয়াল রোড টু দ্য আনকনসাস)। স্বপ্নের মধ্যে আমাদের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, ভয় ও দ্বন্দ্বগুলো প্রতীকী রূপে আত্মপ্রকাশ করে। পরাবাস্তববাদীরা এই স্বপ্নিল ভাষার যৌক্তিকতাকেই জাগতিক বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তাঁরা ‘স্বয়ংক্রিয় লিখন’ (অটোমেটিক রাইটিং) পদ্ধতির জন্ম দেন। আঁদ্রে ব্রেটন ও ফিলিপ সুপোঁ এই পদ্ধতিতে লেখা ‘দ্য ম্যাগনেটিক ফিল্ডস’ গ্রন্থে দেখান, কীভাবে যুক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া অবচেতন থেকে সরাসরি শব্দ ও চিত্রকল্প উঠে আসতে পারে। এটি ছিল একধরনের সাহিত্যিক সম্মোহন, যেখানে লেখক নিজেই নিজের অবচেতনার মাধ্যম হয়ে ওঠেন।

ফ্রয়েড ছাড়াও পরাবাস্তববাদীরা জার্মান দার্শনিক হেগেলের দ্বান্দ্বিকতাবাদ (হেগেলিয়ান ডায়ালেকটিকস) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। হেগেলের মতে, থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সিন্থেসিস বা এক উচ্চতর সত্যের জন্ম হয়। পরাবাস্তববাদীরা এই মডেলকে তাঁদের দর্শনে প্রয়োগ করেন। তাঁরা স্বপ্ন (থিসিস) এবং বাস্তবতার (অ্যান্টিথিসিস) মধ্যকার দ্বন্দ্বকে মিলিয়ে দিয়ে এক উচ্চতর বাস্তবতা বা ‘সুররিয়ালিটি’তে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। তাঁদের কাছে জীবন ও মৃত্যু, যুক্তি ও পাগলামি, অতীত ও ভবিষ্যৎ—এসব কোনো বিপরীত ধারণা ছিল না, বরং ছিল একই পরম বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।

পরাবাস্তবতা এক দীর্ঘ ছায়া, যা সাহিত্যকে অনুসরণ করে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। প্রাচীন থেকে উত্তরাধুনিক পরাবাস্তবতা যদিও বিংশ শতাব্দীর একটি সুনির্দিষ্ট আন্দোলন, এর আত্মিক পূর্বসূরিদের খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে। পঞ্চদশ শতকের ডাচ চিত্রকর হায়ারোনিমাস বশের চিত্রকর্মে নরক ও পৃথিবীর যে অদ্ভুত, দুঃস্বপ্নময় চিত্র ফুটে উঠেছে, তা সালভাদর দালির পরাবাস্তব চিত্রকর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়। সাহিত্যে ফরাসি কবি কোঁত দে লোত্রেয়ামেঁর ‘মালডোররের গান’ গ্রন্থটিকে পরাবাস্তববাদীরা তাঁদের অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে গণ্য করতেন। লোত্রেয়ামঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘একটি সেলাই মেশিনের সঙ্গে একটি ছাতার আকস্মিক সাক্ষাৎ, ব্যবচ্ছেদ টেবিলের ওপর’—পরাবাস্তববাদী চিত্রকল্পের সারসংক্ষেপ হয়ে ওঠে। এই উক্তি দেখায়, দুটি সম্পূর্ণ অসংলগ্ন বস্তুকে অপ্রত্যাশিতভাবে একসঙ্গে রাখলে তা কীভাবে এক নতুন ও ‘পারটার্বিং’ বা বিরক্তিকর কিংবা ভীতিকর সৌন্দর্যের জন্ম দিতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সামনে এক পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করছে, যেখানে আমরা আমাদের সত্তার এক সম্পাদিত সংস্করণ উপস্থাপন করি। এই পরিস্থিতিতে, পরাবাস্তবতা আমাদের শেখায় বাস্তবতাকে প্রশ্ন করতে, নির্মিত বাস্তবতার পেছনের সত্যকে অনুসন্ধান করতে।

পরাবাস্তবতার প্রভাব আধুনিক ও উত্তরাধুনিক শিল্প-সাহিত্যেও বিশাল। লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতার ওপর এর প্রভাব অনস্বীকার্য। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হুলিও কোর্তাসার বা ইসাবেল আইয়েন্দের লেখায় অলৌকিক ঘটনাগুলো দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে উঠে আসে, যা পরাবাস্তবতার অনুপ্রেরণাতেই পুষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে গড়ে ওঠা থিয়েটার অব দ্য অ্যাবসার্ডের নাট্যকারদের, যেমন স্যামুয়েল বেকেট বা ইউজিন আয়োনেস্কোদের ওপর কাফকা ও পরাবাস্তববাদীদের গভীর প্রভাব ছিল। বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটকের অর্থহীন সংলাপ ও অন্তহীন অপেক্ষা পরাবাস্তব দুঃস্বপ্নেরই এক নাট্যরূপ।

একবিংশ শতাব্দীতে পরাবাস্তবতার প্রাসঙ্গিকতা

আজকের এই হাইপার-রিয়েল, ডিজিটালনিয়ন্ত্রিত বিশ্বে পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়ে গেছে? উত্তরটি হলো, না। বরং এর প্রাসঙ্গিকতা হয়তো আরও বেড়েছে। আমরা এমন এক সময়ে বাস করি, যেখানে বাস্তব ও ভার্চ্যুয়ালের সীমারেখা ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সামনে এক পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করছে, যেখানে আমরা আমাদের সত্তার এক সম্পাদিত সংস্করণ উপস্থাপন করি। এই পরিস্থিতিতে, পরাবাস্তবতা আমাদের শেখায় বাস্তবতাকে প্রশ্ন করতে, নির্মিত বাস্তবতার পেছনের সত্যকে অনুসন্ধান করতে।

বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র ও ভিডিও গেমের জগতে পরাবাস্তবতার কৌশল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ডেভিড লিঞ্চ, চার্লি কফম্যান বা ইয়োর্গস লানথিমোসের মতো চলচ্চিত্র নির্মাতারা পরাবাস্তবতাকে ব্যবহার করে আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, বিচ্ছিন্নতা ও অস্তিত্বের সংকটকে পর্দায় তুলে ধরেন। পরাবাস্তবতা আজও শিল্পীদের জন্য এক শক্তিশালী অস্ত্র, যা দিয়ে তাঁরা ভোগবাদী সমাজের একরৈখিক যুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং আমাদের চেতনায় ঝাঁকুনি দিয়ে যান।

পরাবাস্তবতা যুগান্তকারী হলেও এটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না। এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল এর রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা ও পলায়নবাদ। যদিও আঁদ্রে ব্রেটনসহ অনেক পরাবাস্তববাদী নিজেদের বিপ্লবী মনে করতেন এবং কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের শিল্প ছিল মূলত আত্মমগ্ন এবং ব্যক্তিগত অবচেতনার দ্বন্দ্ব। মার্ক্সবাদী সমালোচকেরা মনে করতেন, এই আন্দোলন বুর্জোয়া সমাজের সংকট থেকে জাত এবং এটি শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব মুক্তির সংগ্রাম থেকে বহু দূরে।

জ্যঁ-পল সার্ত্র (জন্ম: ২১ জুন ১৯০৫—মৃত্যু: ১৫ এপ্রিল ১৯৮০)
সার্ত্রের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষের অবাধ ইচ্ছা ও স্বাধীনতা। তিনি মনে করতেন, পরাবাস্তববাদীরা অবচেতন মনের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে একধরনের মানসিক নিয়তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা মানুষের স্বাধীন চেতনার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে।

অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যঁ-পল সার্ত্র পরাবাস্তবতাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। সার্ত্রের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষের অবাধ ইচ্ছা ও স্বাধীনতা। তিনি মনে করতেন, পরাবাস্তববাদীরা অবচেতন মনের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে একধরনের মানসিক নিয়তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা মানুষের স্বাধীন চেতনার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে। তাঁর মতে, পরাবাস্তববাদীরা বাস্তব জগতের দায়ভার এড়িয়ে অবচেতনের নিরাপদ আশ্রয়ে পালাতে চান।

আলব্যের কাম্যু জগৎকে ‘অ্যাবসার্ড’ বা অর্থহীন হিসেবেই দেখেছেন, কিন্তু এই অর্থহীনতার প্রতিক্রিয়া পরাবাস্তববাদীদের থেকে ছিল ভিন্ন। পরাবাস্তববাদীরা এই অর্থহীনতাকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন স্বপ্নের জগতে, অন্যদিকে কাম্যু বলেছেন, এই অ্যাবসার্ডিকে গ্রহণ করে, এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই জীবনের মহত্ত্ব অর্জন করতে হবে।

সমস্ত বিতর্ক ও সমালোচনা সত্ত্বেও পরাবাস্তবতা বিশ্বসাহিত্য ও শিল্পকলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর রেখে গেছে। এটি শিখিয়েছে যে আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ কেবল পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়; এর বাইরেও রয়েছে এক বিশাল, রহস্যময় জগৎ—আমাদের স্বপ্নের, কল্পনার এবং অবচেতনের জগৎ। পরাবাস্তবতা সেই জগতের দরজার চাবি। এটি শিল্পীকে শিখিয়েছে যুক্তির কারাগার ভেঙে দুঃসাহসী হতে, প্রচলিত সুন্দরের সংজ্ঞাকে অস্বীকার করতে এবং জীবনের অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর দিকগুলোকে আলিঙ্গন করতে।

জীবনানন্দ দাশের ‘হাওয়ার রাত’ থেকে শুরু করে হারুকি মুরাকামির ‘দুই চাঁদওয়ালা আকাশ’ পর্যন্ত, পরাবাস্তবতার অভিযাত্রা আজও চলমান। এটি আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে মানব অস্তিত্বের গভীরতম সত্যগুলো প্রায়ই অযৌক্তিক, স্বপ্নময় এবং সন্দেহাতীত। এই অন্তহীন রহস্যের অনুসন্ধানই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখে। পরাবাস্তবতা সেই অনুসন্ধানেরই এক চিরকালীন সংগীত, যা আমাদের অবচেতনার মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রায় আজও ডেকে নেয়।