গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

শ্রদ্ধাঞ্জলি

গল্পের সাঁকো পেরিয়ে নক্ষত্রমুখী ইফতেখার মাহমুদ

ইফতেখার মাহমুদের কথা মনে এলেই প্রথম যে ছবিটি আমার মনে ভেসে ওঠে, তা হলো এক শান্ত, সংযত, নিভৃত আলোয় ভরা মানুষ—খুব ধীরে, খুব কোমলভাবে কথার ভাঁজে ভাঁজে মানুষের ভেতর আলো জ্বেলে দেন, যেন তাঁর পাশে দাঁড়ালেই মন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

১৯৮০ সালের ৬ মে রংপুরের নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। শৈশব-কৈশোর কেটেছে নাটোরে, যেখানে তিনি প্রথম পড়াশোনার হাতেখড়ি পান। স্কুল শেষে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ তাঁকে দিয়েছে শৃঙ্খলার প্রথম পাঠ। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের ভেতর দিয়ে খুলে গেছে নতুন দরজা—সমাজ, মানুষ ও ন্যায়ের গভীর অন্বেষা। পরে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হন তিনি। শিক্ষকতার পরিসর তাঁর কাছে শুধু পাঠদান ছিল না, বরং সাধারণ মানুষের জীবন-বাস্তবতাকে গভীরভাবে খুঁড়ে দেখার এক নীরব গবেষণাও ছিল। তাঁর বোধ—লেখা ও অ-লেখা—দুটোই জীবনকে বোঝার ভিন্ন ভুবন। লেখা দিয়ে তিনি বিশ্বকে স্পর্শ করেছেন, আর অ-লেখা দিয়ে পৃথিবীকে অনুভব করেছেন।

বাংলা কথাসাহিত্যের বিবর্তন লক্ষ করলে দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্পের নির্মাণশৈলী ও রূপবোধ বিস্তর পাল্টেছে। আধুনিক গল্পকারদের অনেকেই কাহিনি বলার চেয়ে আঙ্গিক-পরীক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে গল্প হয়ে ওঠে কেবল বয়ান, কিন্তু তার প্রাণগভীরতা ক্ষীণ হয়ে যায়। একক আখ্যান, মানবিক দ্বন্দ্ব, সময়-স্থানের সুসংবদ্ধ বোধ—এগুলো অনেক সময় কৌশলপ্রিয়তার আড়ালে চাপা পড়ে যায়।

ইফতেখার মাহমুদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘শিকড়ে শাখায় মেঘে’, ‘কথা আর গল্পের জীবন’, ‘হে দিগ্বিদিক, হে অদৃশ্য’, ‘হুমায়ূন আহমেদের ভঙ্গি এবং ভঙ্গুরতা’, ‘অসমাপ্ত সাঁকো’, ‘অনুপস্থিত’ ও ‘কথা কাগজে’।

এই প্রেক্ষাপটে ইফতেখার মাহমুদ এক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কথাশিল্পী, নিজেকে যিনি আলাদা করে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি আঙ্গিক কিংবা ভাষার নতুনত্ব অনুসন্ধান করলেও কখনোই তাঁর গল্পে গল্পের মৌল উপাদান হারায় না। তাঁর কাছে গল্প কেবল শৈলীর প্রদর্শনী নয়, বরং চরিত্রের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা ও অনুভবকে বুনন করে এক অখণ্ড কাহিনি-জগৎ নির্মাণ। তাঁর ‘অসমাপ্ত সাঁকো’ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ইন দ্য মেকিং’-এর কথা বলা যেতে পারে। এই গল্পে তিনি নির্মাণের অনুষঙ্গ প্রয়োগ করলেও গল্পের কেন্দ্রে থাকে একটি সম্পূর্ণ ও গ্রাহ্য কাহিনি। ফলে পাঠক যেমন ভাষাগত বৈচিত্র্যের স্বাদ পান, তেমনি পান একটি সুসংহত গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা। তাঁর এই গল্প একটি প্রেমের গল্প, কিন্তু বিষয়টি সরল নয়। এখানে প্রেমকে দেখা হয়েছে আত্মহানি, আত্মবিসর্জন ও স্বীকৃতির প্রশ্নের মধ্য দিয়ে। প্রেমের প্রতি চরিত্রের আকাঙ্ক্ষা তাকে কীভাবে অপরের নিকট ‘অত্যন্ত প্রিয়’ হতে প্ররোচিত করে—গল্পটি এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আখ্যানটি মঞ্চের বিন্যাসে সাজানো—একটি নাট্যচিত্ররূপ। সংলাপ, দৃশ্যান্তর ও নেপথ্যস্বরের সমন্বয়ে যে পাঠভুবন গড়ে ওঠে, তা বাংলা গল্পে তুলনামূলকভাবে ব্যতিক্রম। অর্থাৎ তিনি আঙ্গিক নিয়ে নতুন করে ভাবলেও কখনোই তা আখ্যানকে প্রতিস্থাপন করে না, বরং আখ্যানকে নতুন সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

ইফতেখার মাহমুদ (৬ মে ১৯৮০—৩০ অক্টোবর ২০২৫)

আরেকটি গল্প ‘মাথার ভেতর’, যা প্রকৃতি ও স্মৃতির মনস্তাত্ত্বিক মাত্রা স্পর্শ করে। এখানে শহুরে মানুষদের মাথার মধ্যে নদী বয়ে চলে—এটি নিছক কল্পনা নয়, বরং এক প্রবল প্রতীক। নগরায়ণের মধ্যে জেগে থাকা গ্রামীণ স্মৃতি, প্রকৃতিবোধ ও হারানো সত্তা এখানে নদী হয়ে ফিরে আসে। ফলে গল্পটি পাঠকের মধ্যেও এক অদৃশ্য নদীর স্রোত সৃষ্টি করে, যা ব্যক্তির ভেতরকার অনাবিলতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। ইফতেখার মাহমুদের গল্প পাঠ করতে করতে পাঠক ধীরে ধীরে নিজেও নদীর অংশ হয়ে যান—এ যেন শহরের বিবর্ণতায় থেকেও অতীতের নির্মলতার স্পর্শ পাওয়া।

ইফতেখার মাহমুদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘শিকড়ে শাখায় মেঘে’, ‘কথা আর গল্পের জীবন’, ‘হে দিগ্বিদিক, হে অদৃশ্য’, ‘হুমায়ূন আহমেদের ভঙ্গি এবং ভঙ্গুরতা’, ‘অসমাপ্ত সাঁকো’, ‘অনুপস্থিত’ ও ‘কথা কাগজে’।

ইফতেখার মাহমুদের গল্পের প্রধান শক্তি দ্বিমাত্রিক: আখ্যানগত সম্পূর্ণতা—গল্পে একটি স্পষ্ট ‘কাহিনি’ থাকে, যার প্রবাহ পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। আরেকটি হচ্ছে অন্তঃসার ও উপপাঠ—ঘটনার বাইরে গল্পের ভেতরে থাকে মর্মবস্তু, যা পাঠককে ভাবায়, প্রশ্ন করে এবং নিজের জীবনানুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে আহ্বান জানায়।

গল্পপাঠ যে কেবল ঘটনাবলির সঙ্গে পরিচয় নয়, বরং চরিত্র, স্মৃতি, বোধ ও নীরব অভিব্যক্তির স্তরসমূহে প্রবেশের অভিজ্ঞতা—ইফতেখার মাহমুদের লেখায় তা সুস্পষ্ট। তাঁর গল্প পাঠকের কাছে অনুধাবনের এক বহুস্তরীয় যাত্রা উপস্থাপন করে, যেখানে বলা ও না-বলা, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দুই-ই সমান গুরুত্ব দাবি করে।

বাংলা গল্পের সমকালীন পরিমণ্ডলে এ কারণেই ইফতেখার মাহমুদের সাহিত্যকর্ম গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর গল্প-উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই—আখ্যানভিত্তিক গল্প বলার ঐতিহ্য ও শৈলী-পরীক্ষা একই সঙ্গে সম্ভব; পরীক্ষা কখনো মৌল সত্তাকে গ্রাস করে না, গল্প সর্বদাই গল্পই থাকে—তার শিল্পসজ্জা তার পরিপূরক মাত্র।

‘কথা আর গল্পের জীবন’ তাঁর একটি প্রবন্ধগ্রন্থ, যেখানে কথাশিল্প ও গল্পভিত্তিক ভাবনায় লেখক প্রবেশ করেছেন। নাম থেকেই বোঝা যায়—‘কথা’ ও ‘গল্প’-র জীবন; অর্থাৎ শুধু গল্প নয়, কথার মধ্যেও রয়েছে জীবন। এখানে তিনি জীবনকে কথার মাধ্যমে দেখতে চান: গল্প বা কথার ভেতর মানবজীবনের জটিলতা, অনুভূতি, প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে। এ কাজ পাঠককে সরলভাবে বিনোদিত করার থেকে অনেক দূরে—এখানে পাঠককে চিন্তায় আমন্ত্রণ করা হয়েছে। ‘কথা’ ও ‘গল্প’র সীমা ভেদ করে লেখক আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এক রূপান্তর-মুহূর্তে, যেখানে জীবনের রূপক খুঁজে পাওয়া যায়।

‘হে দিগ্বিদিক, হে অদৃশ্য’ গল্পগ্রন্থের শিরোনামেই একটা প্রশ্নবোধক ভাব জাগে—‘দিগ্বিদিক’, ‘অদৃশ্য’ , অর্থাৎ সব দিকেই যাওয়া যায়, সবকিছুই দেখা যায়, কিন্তু অনেক কিছুই দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না। এ কাজ সাহিত্যের এক জটিল রূপকে ধরেছে, যেখানে ভাষা ও রূপক মিলিত হয়ে অনুভবের সীমার কথা বলছে। লেখক এখানে উপস্থাপন করেছেন যে জীবন শুধু দৃশ্যমান নয়; অনেকটাই নিঃশব্দ, নিভৃত, এমনকি অব্যক্ত। তার রচনায় সেই অব্যক্তের মুহূর্তগুলো শব্দে রূপ দেওয়া হয়েছে—চোখে না পড়া, কিন্তু হৃদয়ে স্থায়ী হওয়া দৃশ্যগুলোকে।

ইফতেখার মাহমুদ একজন সংবেদনশীল লেখক, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও অতল মানবিকতার মানুষ ছিলেন। ঢাকায় ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আইনশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন, আর সাহিত্যজগতে রেখে গেছেন প্রশংসনীয় অবদান।

‘হুমায়ূন আহমেদের ভঙ্গি এবং ভঙ্গুরতা’ গ্রন্থটি একটু ভিন্ন ধরনের—এটি সমালোচনামূলক রচনা। বাংলা কথাসাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। লেখক এখানে প্রশ্ন করছেন: লেখকের স্টাইল বা ভঙ্গি কেন জনপ্রিয় হলো, সেটি কত দূর স্থায়ী হলো এবং কোথায় সেই ভঙ্গি ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে বা উঠতে পারে? এই রূপে গ্রন্থটি শুধু সাহিত্যিক বিশ্লেষণ নয়, সাধারণ পাঠককে দেখাতে চায় লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক পরিবেশের পেছনের মনোবৃত্তি ও সামাজিক প্রসঙ্গ।

ইফতেখার মাহমুদ একজন সংবেদনশীল লেখক, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও অতল মানবিকতার মানুষ ছিলেন। ঢাকায় ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আইনশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন, আর সাহিত্যজগতে রেখে গেছেন প্রশংসনীয় অবদান।

দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্রেন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) না-ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন কথাশিল্পী ইফতেখার মাহমুদ। তাঁর এই অকালমৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিসরে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করেছে।

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী ও মডেল মৌরি মাহদী তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আইনের বই পড়া প্রথম যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল, তিনি আমাদের প্রিয় শিক্ষক, লেখক ও কথাসাহিত্যিক ইফতেখার মাহমুদ স্যার। ভার্সিটির প্রথম দিন ক্লাসে দেরি করে যওয়ায় স্যার কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে পরিচয়পর্ব নিচ্ছিলেন। কথার মধ্যে ইংলিশ আর বাংলা শব্দের মিশ্রণ থাকায় স্যার আমাকে বললেন, যখন বাংলায় কথা বলবেন, তখন বাংলায় শেষ করার চেষ্টা করবেন। এতে ভাষার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সেদিন থেকে শুরু হলো স্যারকে অনুকরণের পর্ব। আজকে যতটুকু সাবলীলভাবে কথা বলি, পুরোটা আমার স্যারের কৃতিত্ব।’

আজ তাঁর শূন্যতা আমাদের মাঝে স্পষ্ট। এ শূন্যতা বড়, কিন্তু অন্যদিকে এর একধরনের শান্ত শক্তি রয়েছে—যেমন আলো নিভে গিয়েও তার আভা রয়ে যায়। এই পৃথিবীতে মানুষ আসে, যায়, কিন্তু কিছু মানুষ শব্দের ভেতর, মানুষের স্মৃতিতে, লেখার পাতায় থেকেও যায়। ইফতেখার মাহমুদ এমনই একজন মানুষ।