‘সাতানট্যাঙ্গো’ চলচ্চিত্রটির দৈর্ঘ্য সাত ঘণ্টা উনিশ মিনিট—শুধু এইটুকু তথ্যই বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট। এই দীর্ঘতার মধ্যে আছে সময়ের এক অনন্য দার্শনিক অনুসন্ধান—একটি গ্রামের কথা, যেখানে শব্দের চেয়ে নীরবতা বেশি শক্তিশালী, যেখানে মানুষের গতি ধীর হলেও চিন্তার গতি অবিরাম। বেলা তারের পরিচালনায় তৈরি এই ছবির মূল নির্যাস সুদীর্ঘ বাক্যগঠনের জন্য পরিচিত সদ্য নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখা চিত্রনাট্য।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই হাঙ্গেরির এক রহস্যময় সাহিত্যিক। তাঁর অসংখ্য দীর্ঘ বাক্যে গড়া, বিরামহীন প্রবন্ধসদৃশ উপন্যাস ইউরোপীয় সাহিত্যের এক নতুন ভাষা তৈরি করেছে। ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির গিউলায় জন্ম নেওয়া এই লেখক নিজের সময়কে ভাবেন এক প্রলয়ের অংশ হিসেবে। ‘সাতানট্যাঙ্গো’, ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড গোজ অন’, ‘সেইবো দেয়ার বিলো’র মতো বইগুলো তাঁকে আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখকে পরিণত করেছে। ২০২৫ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার সময় ক্রাসনাহোরকাইয়ের নামটি অনেকের কাছেই নতুন মনে হয়েছিল, যদিও ইউরোপীয় সাহিত্যে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখার ধীরগতি, বুনট ভাষা আর অন্তর্মুখী ভাবনার কারণে তাঁর পাঠকসংখ্যা হয়তো কম ছিল, কিন্তু প্রভাব ছিল গভীর। নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে তাঁর লেখা এখন আরও বৃহৎ পরিসরে পাঠকের সামনে পৌঁছেছে। সুইডিশ একাডেমির ভাষায়, তিনি এমন শিল্পী, যিনি মানুষের জীবন, সময় আর নৈরাশ্যের অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে প্রকাশ করেছেন, যা প্রচলিত গদ্যের সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। তাঁর লেখার ভঙ্গি শান্ত, কিন্তু ভাবনার গভীরতা পাঠককে ধীরে ধীরে এক ভেতরের জগতে নিয়ে যায় যেখানে ভাষা আর চিন্তা মিলেমিশে যায় নিঃশব্দ প্রবাহে।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই হাঙ্গেরির এক রহস্যময় সাহিত্যিক। তাঁর অসংখ্য দীর্ঘ বাক্যে গড়া, বিরামহীন প্রবন্ধসদৃশ উপন্যাস ইউরোপীয় সাহিত্যের এক নতুন ভাষা তৈরি করেছে। ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির গিউলায় জন্ম নেওয়া এই লেখক নিজের সময়কে ভাবেন এক প্রলয়ের অংশ হিসেবে।
অন্যদিকে বেলা তার হাঙ্গেরির এক প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি ধীরগতির দৃশ্য, দীর্ঘ শট, ও আলো-ছায়ার নীরব ভাষায় গড়ে তুলেছেন নিজের স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র ভুবন। ১৯৫৫ সালে হাঙ্গেরির পেচ শহরে জন্ম নেওয়া বেলা তার প্রথম দিকে তৈরি করতেন সামাজিক বাস্তবতাভিত্তিক চলচ্চিত্র, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন, পারিবারিক সংকট ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল মূল বিষয়। পরবর্তী সময়ে তিনি সেই বাস্তবতা থেকে সরে এসে সময় ও অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে একধরনের ধ্যানমগ্ন চলচ্চিত্রধারা নির্মাণ করেন, হয়ে ওঠেন আধুনিক ইউরোপীয় সিনেমার অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্রকার।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সঙ্গে বেলা তারের পরিচয় হয় আশির দশকের মাঝামাঝিতে, ‘ড্যামনেশন’ নির্মাণের আগে। একটি সাক্ষাৎকারে বেলা তার বলেন, তিনি ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার মধ্যে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছিলেন যা তাঁর নিজের ভাবনার সঙ্গে গভীরভাবে মেলে—সময়, স্থবিরতা আর মানুষের অস্তিত্বসংকট নিয়ে। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁদের দীর্ঘ সহযাত্রা। প্রথমে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন ‘ড্যামনেশন’–এ, তারপর ‘সাতানট্যাঙ্গো’, ‘ওয়ার্কমেইস্টার হারমোনিস’, ‘দ্য ম্যান ফ্রম লন্ডন’ ও ‘দ্য তুরিন হর্স’–এ। ক্রাসনাহোরকাই পরবর্তী সময়ে দ্য প্যারিস রিভিউকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি শুধু বেলার সঙ্গেই কাজ করেছি। তাঁর সঙ্গে কাজ করা মানে ছিল আমার লেখা তাঁর হাতে তুলে দেওয়া, তারপর সেটি নতুনভাবে দেখা। আমাদের কাজ একধরনের গভীর বোঝাপড়া, যেখানে শব্দ থেকে দৃশ্য তৈরি হয়।’ এই পারস্পরিক আস্থা ও সৃজনশীল মিলনই গড়ে তুলেছিল আধুনিক ইউরোপীয় সিনেমার এক অনন্য অধ্যায়।
একটি সাক্ষাৎকারে বেলা তার বলেন, তিনি ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার মধ্যে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছিলেন যা তাঁর নিজের ভাবনার সঙ্গে গভীরভাবে মেলে—সময়, স্থবিরতা আর মানুষের অস্তিত্বসংকট নিয়ে। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁদের দীর্ঘ সহযাত্রা।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের শিল্প এরপর কেবল আর উপন্যাসে থেমে থাকেনি। পরিচালক বেলা তারের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা আধুনিক চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। তাঁদের প্রথম কাজ ‘ড্যামনেশন’ (১৯৮৮) এক অন্ধকার, বিষণ্ন শহরের গল্প, যেখানে ভালোবাসা, একাকিত্ব আর নৈতিক পতনের বিষয়গুলো ফুটে ওঠে ক্রাসনাহোরকাইয়ের গদ্যের ভঙ্গিমায়। তিনি স্ক্রিপ্ট লিখেছেন এমনভাবে, যেন প্রতিটি সংলাপ একখণ্ড উপন্যাসের অংশ। ক্যামেরার স্থিরতা আর অল্প কিছু সংলাপ—সবই যেন তাঁর লেখার দীর্ঘ, ধীর বাক্যগুলোর প্রতিফলন।
এরপর আসে তাঁদের সবচেয়ে বিখ্যাত যৌথ কাজ ‘সাতানট্যাঙ্গো’ (১৯৯৪)। ক্রাসনাহোরকাইয়ের নিজের উপন্যাস থেকে নির্মিত এই সাত ঘণ্টার চলচ্চিত্রে উপন্যাসের অবিরাম বাক্যকে পর্দায় রূপ দিতে গিয়ে তিনি গল্পটিকে সাজিয়েছেন দৃশ্যের বিন্যাসে, সময়ের ক্রমে নয়। ফলে দর্শক ধীরে ধীরে আটকে যান এক ভিন্ন পৃথিবীর স্থবিরতায়, ঠিক যেমন পাঠক হারিয়ে যান তাঁর দীর্ঘ বাক্যের ভেতরে। নিজেদের এই যুগলবন্দী সম্পর্কে ক্রাসনাহোরকাই একবার দ্য প্যারিস রিভিউকে বলেছিলেন, ‘আমি কখনোই প্রচলিত স্ক্রিপ্ট লিখি না। আমি কেবল শব্দের একটা আবহ তৈরি করি আর বেলা সেটিকে পর্দায় রূপ দেয়।’ তাঁর কাছে ‘চিত্রনাট্য’ কোনো প্রযুক্তিগত নথি নয়; বরং দার্শনিক একটি অনুবাদ—একটি চিন্তার কাঠামো, যা পরিচালকের নির্দেশনায় দৃশ্য হয়ে ওঠে। এই সৃজনশীল ধারা চলতে থাকে তাঁদের পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতেও।
‘ওয়ার্কমেইস্টার হারমোনিস’ (২০০০) ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাস ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’–এর রূপান্তর, দেখা যায় একটি শহরে এক রহস্যময় সার্কাসের আগমন, যা ধীরে ধীরে সমাজের শৃঙ্খলাকে ভেঙে দেয়। ক্রাসনাহোরকাই এখানে গল্পের পাশাপাশি দর্শকদের দিয়েছেন এক নতুন ভাবনার কাঠামো। ‘মানুষের বিশৃঙ্খলা কি প্রকৃতির মতোই অবশ্যম্ভাবী?’ এই প্রশ্ন তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন সংলাপ ও দৃশ্যের ভেতর দিয়ে।
‘দ্য ম্যান ফ্রম লন্ডন’ (২০০৭) একটি ফরাসি উপন্যাস থেকে অভিযোজিত চলচ্চিত্র। এখানে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভূমিকা ছিল গল্পের গভীর দার্শনিক দিকগুলো পুনর্লিখন করা, কীভাবে অপরাধ, আকাঙ্ক্ষা আর নৈতিক সংকটের মধ্যে মানুষ হারিয়ে যায়, সেটিই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি এই সিনেমায়।
এখন পর্যন্ত সর্বশেষ যৌথ কাজ ‘দ্য তুরিন হর্স’ (২০১১)। লেখক ও পরিচালক দুজনই ঘোষণা করেছিলেন যে এটি হতে যাচ্ছে তাঁদের শেষ চলচ্চিত্র। পুরো ছবিতে সংলাপ অল্পই, কিন্তু ক্রাসনাহোরকাই সেই নীরবতাকেও লিখে দিয়েছিলেন স্ক্রিপ্টে—বাতাসের শব্দ, আলোর পরিবর্তন, ঘোড়ার পদধ্বনি—সবকিছু তিনি বর্ণনা করেছেন এমনভাবে, যে তা গল্পের অংশ হয়ে উঠেছে। দৃশ্যের ছন্দ নির্ধারণ করে দেওয়ার এক ভিন্ন প্রয়াস আমরা খুঁজে পাই এই সিনেমায়। নিজের উপন্যাসের রূপান্তর হোক বা অন্য গল্পের পুনর্লিখন; সব ক্ষেত্রেই ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভূমিকা ছিল অনন্য। বেলা তার একবার বলেছিলেন, ‘লাসলো শব্দ লেখেন, আমি ছবি তুলি।’ তাঁদের এই যৌথ কাজগুলোও একধরনের অনুবাদ যেন—ভাষা থেকে দৃশ্যে, চিন্তা থেকে সময়ের মধ্যে।
চলচ্চিত্রের বাইরেও ক্রাসনাহোরকাই কাজ করেছেন অন্যান্য মাধ্যমে। জার্মান শিল্পী ম্যাক্স নিউম্যানের সঙ্গে তাঁর বই ‘অ্যানিমাল ইনসাইড’–এ শব্দ ও চিত্রের সংলাপ দেখা যায়; আবার ফটোগ্রাফার অর্নান রোতেমের সঙ্গে দ্য ম্যানহাটন প্রজেক্ট–এ তাঁর গদ্য শহরের ছবির ভেতর দিয়ে চলে যায়। এসব কাজে তিনি ভাষা ও চিত্রের সীমা পরীক্ষা করেছেন—একটির শুরু কোথায়, অন্যটির শেষ কোথায়।
লাসলোর কাজকে অনেকে ‘ধীর’ বলেন, কেউ কেউ বলেন ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’, কিন্তু এই ধীরতাই হয়ে উঠেছে তাঁর স্বকীয়তা। তিনি এমন স্ক্রিপ্ট লেখেন, যেখানে গল্পের চেয়ে পরিবেশ, সংলাপের চেয়ে নীরবতা আর ঘটনার চেয়ে সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই নীরবতার মধ্যেই তিনি খুঁজে বেড়ান অর্থ, যেখানে চলচ্চিত্র থেমে যায়, কিন্তু দর্শক ভাবতে থাকেন।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই কখনো ‘স্ক্রিপ্টরাইটার’ হতে চাননি; কিন্তু তিনি এমন একজন গল্পকার, যিনি ক্যামেরার জন্যও ভাবতে জানেন।