গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

সংগীত

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও রাগসংগীতে বিশুদ্ধতার ধারণা

আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব বরাবরই এক বিস্ময়কর মানুষ। এ কথা যেমন নিরেট সত্য, তেমনি এ কথাও সত্য যে তিনি একই সঙ্গে এক পরম সাধারণ মানুষ ছিলেন। খাঁ সাহেবের সংগীতের মূলে কোনো আভিজাত্য বা দূরত্ব ছিল না, প্রতিটি সুরের ভেতর দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে মাটির গন্ধ, ক্ষুধার ইতিহাস, মানুষের ক্লান্তি ও আশ্বাসের শব্দ।

আমি আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে চিনেছি আমার গুরুজির কাছ থেকে। সেদিন বিহাগের তালিম চলছিল। তালিমের একপর্যায়ে গুরুজি আমায় থামিয়ে বললেন, ‘তোকে একটা গল্প বলি। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ বিহাগের বিনকারী শেষ করবেন, সম্ভবত ঝালা বাজাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তাঁর চোখ দিয়ে জল বয়ে এল আর তিনি বললেন, “এত দিন পর গান্ধারটা লাগল!”’ সেই গল্প শুনে আমি বুঝেছিলাম আত্মসন্ধান, শ্বাসের আশ্বাসে গলার মধ্য দিয়ে উঠে আসা আত্মার ছবিও নেহাত।

আলাউদ্দিন খাঁ কলোনিয়াল ভারতবর্ষে সেই সামন্ত সংগীতের শৃঙ্খল ভেঙে নয়া সংগীতধারার বিনির্মাণ করেছিলেন, যেখানে দরিদ্র, কৃষক, ‘মুসলমান’, ‘হিন্দু’, ‘বাঙালি’, উড়িয়া, মারাঠি—সবাই এক সুরে মিশে যেত। সংগীতে ধর্মের সীমা ভেঙে যায় এবং সেই ভাঙার মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় নতুন গণতান্ত্রিক নন্দনচেতনা।

আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব উপমহাদেশের একটা জটিল সময়ে বর্তমান ছিলেন। দীর্ঘ দমন, কলোনিয়াল আধিপত্য, সামাজিক বিভাজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া মানে একপ্রকার সোশিও-পলিটিক্যাল আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারও। ভারতীয় সংগীত, বিশেষ করে আলাউদ্দিন খাঁর মতো মানুষদের হাতে হয়ে উঠেছিল এক প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব নিজেই ছিলেন এক বিপ্লবী সংগীতচেতা। কলোনিয়াল ভারতবর্ষে সেই সামন্ত সংগীতের শৃঙ্খল ভেঙে নয়া সংগীতধারার বিনির্মাণ করেছিলেন, যেখানে দরিদ্র, কৃষক, ‘মুসলমান’, ‘হিন্দু’, ‘বাঙালি’, উড়িয়া, মারাঠি—সবাই এক সুরে মিশে যেত। সংগীতে ধর্মের সীমা ভেঙে যায় এবং সেই ভাঙার মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় নতুন গণতান্ত্রিক নন্দনচেতনা। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব এখানেও বিস্ময়কর।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

শাস্ত্রীয় সংগীতকে একটা উচ্চ, নিরপেক্ষ, পবিত্র রূপ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, যেখানে ‘শুদ্ধতা’ থাকে। এই শুদ্ধতা ‘রাগ’–বিষয়ক নয়, বরং ‘পরিবেশন’ ও ‘ধারণ’–বিষয়ক। কিন্তু এই ধারণা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে কলোনিয়াল আধিপত্য ও পশ্চিমা বৌদ্ধিক ধাঁচ এই ‘শুদ্ধতা’র ধারণাটিকে প্রভাবিত করেছে। তো, আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব কি কখনো এই ‘শুদ্ধতার’ ধারণার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন? হ্যাঁ। আলাউদ্দিন খাঁ শুধু সংরক্ষণ করা রাগ শেখাতেন না, চর্চাও করতেন না, পুনর্নির্মাণ, ভাঙা-গড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ভাগ্যিস করেছিলেন, নইলে আমরা গিমিক ধরে বসে বসে অতএব, সুতরাং, যেহেতু, করতে করতেই শেষ হয়ে যেতাম। ‘রাগের শুদ্ধতা’ ব্যাপারটা কেমন আবার?

রাগের শুদ্ধতা শুধুই যান্ত্রিক নয়, অভিজ্ঞতা, জীবনচেতনা এবং গৃহীত সামাজিক ধ্যান থেকে আসা ভাব। প্যাকেটবাঁধা ‘রীতি’ বা ‘রীতিনীতি’র বাইরে গিয়ে এক রূপে প্রকাশ, আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব ছাড়া পেরেছে কজন,তা নিয়ে জানাশোনার ব্যাপার আছে।

শাস্ত্রীয় সংগীতকে একটা উচ্চ, নিরপেক্ষ, পবিত্র রূপ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, যেখানে ‘শুদ্ধতা’ থাকে। এই শুদ্ধতা ‘রাগ’–বিষয়ক নয়, বরং ‘পরিবেশন’ ও ‘ধারণ’–বিষয়ক। কিন্তু এই ধারণা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে কলোনিয়াল আধিপত্য ও পশ্চিমা বৌদ্ধিক ধাঁচ এই ‘শুদ্ধতা’র ধারণাটিকে প্রভাবিত করেছে।

প্রাতঃরাশের রাগ এবং জন-আলোকিত ‘অথেন্টিসিটি’—এই ব্যাপারে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব বহু বাদ্যযন্ত্র, বহু ধারা, এমনকি পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রের কিছু উপাদানও ব্যবহার করেছিলেন, যেমন কলকাতায় থিয়েটারের সঙ্গে কাজ করা; মাইহার ব্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘বহুভাষিক’/ ‘বহুবাদ্যযন্ত্রিক’ ব্যবহার কি ইতিহাসের দৃষ্টিতে ‘অথেন্টিসিটি’কে দুর্বল করেছে নাকি নতুন ‘লোক-অথেন্টিসিটি’ তৈরি করেছে? কর্তৃপক্ষ বা ‘সংকীর্ণ ধারাবাহিকতাবাদী’ গোষ্ঠীগুলো কি কখনো এই বহুবাদ্যযন্ত্রবাদকে ‘বিকৃতি’ বা ‘পাশবিক পরিবর্তন’ হিসেবে দেখেছে? এর উত্তরে বলা যায়, নতুন ‘লোক-অথেন্টিসিটি’ তৈরি করেছে। কলোনিয়াল সময়ে সংরক্ষিত বাদ্যযন্ত্র ও রাগের আকারে স্থিতাবস্থা ছিল, যা সমাজের সীমিত অংশের জন্য নির্ধারিত ছিল। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বহুবাদ্যযন্ত্রিক অভিজ্ঞতা এই সীমা ভেঙে দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নতুন স্বাভাবিক সংগীতচেতনা জাগিয়েছে; ব্যক্তিগত ও গণস্মৃতির অংশ এই পুরো ব্যাপারটা।

আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের পারফরম্যান্স মূলত দরবার, বাড়ি ও মঞ্চে হলেও, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খল ভেঙে সাধারণ মানুষের মধ্যে গান পৌঁছে দিতেন। তাঁর প্রাত্যহিক তালিম ও সংগীত বিদ্যালয় দরিদ্র ছাত্রদেরও অন্তর্ভুক্ত করত। তাই তিনি সংগীতকে কেবল অভিজাতদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখেননি।

আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব দৈত্যই ছিলেন, গানের দৈত্য। দৈত্য নিয়ে তাঁর যে গল্প, সেটা অনেকেই জানেন। আধুনিক সময়ের সাংস্কৃতিক অর্থনীতি সংগীতকে বাজারজাত করেছে, কিন্তু আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব তা প্রতিহত করেছেন। শিল্পকে বাজারের বাইরে রেখেছিলেন, গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ও সংগীতের অভ্যন্তরীণ নৈতিকতার ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের গুরু–শিষ্য পদ্ধতি কোনো বংশগত বা অর্থনৈতিক সুবিধার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ক্ষমতার এক উদার রূপ তিনি তৈরি করে গেছেন, যেখানে শিল্প ও সংস্কৃতিকে মানুষের স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে দেখা হয় এবং সেই মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ একত্র হয়।

আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের পারফরম্যান্স মূলত দরবার, বাড়ি ও মঞ্চে হলেও, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খল ভেঙে সাধারণ মানুষের মধ্যে গান পৌঁছে দিতেন। তাঁর প্রাত্যহিক তালিম ও সংগীত বিদ্যালয় দরিদ্র ছাত্রদেরও অন্তর্ভুক্ত করত। তাই তিনি সংগীতকে কেবল অভিজাতদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখেননি।

মানুষটার ভেতর শক্তি ছিল প্রবল, যে শক্তি আজও সঞ্চার করেন আমাদের ভেতর। খাঁ সাহেবের সুরের ভেতর লুকিয়ে ছিল মেহনতি মানুষের আত্মা। তিনি ছিলেন মাঠ–ঘাটের, নদী–জলের এবং মানব-দুঃখের শিল্পী। সংগীত একধরনের বিপ্লবী নন্দনতত্ত্ব, যা রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা, লালনের ভ্রাম্যমাণ সত্যবোধ এবং গণসংগীতের প্রতিবাদী সুর, শাস্ত্রীয় সংগীতের ঐশ্বরিক সুর, এই সবের মিলনক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে।

সে কারণেই, ‘এত দিন পর গান্ধারটা লাগল’—একটা বিহাগের ছবি তৈরি করতে পারে। আত্মপ্রত্যাবর্তনের মুহূর্ত তৈরি করতে পারে।

আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব যেভাবে যাপন করে গেছেন সংগীতকে, শ্বাসে নিয়ে বাস করেছেন সংগীতে। বহু সাধনার পথ শেষে আলাউদ্দিন খাঁ হয়ে উঠলেন শিল্পী, দার্শনিক, পুরোদস্তুর মানুষ। এই পুরোদস্তুর মানুষের চরণে প্রণাম। গান কখনো শেষ হয় না, শুধু আমরা থেমে যাই।