নিষ্পেষিত মানবতার প্রতি উৎসর্গ করা ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ প্রামাণ্যচিত্রটিতে এক উত্তাল সময়ের কথা তুলে আনতে চেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। সময়টি হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। প্রামাণ্যচিত্রটি বানানোও হয়েছিল সেই সময়ে। পদ্মাকে, অর্থাৎ বাংলাদেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে ঋত্বিক ঘটক দুটি ঘটনা সমান্তরালে দেখানোর চেষ্টা করেন। একদিকে দেখা যায়, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে (বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়), যিনি স্বাধীন বাংলার প্রতীক লাল–সবুজ পতাকাকে সাক্ষী মেনে জান বাজি রেখে দেশের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের সাধারণ মানুষের সমর্থন।
যে দেশ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, যে দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদী সর্বদা উর্বর রাখে জমিকে, যে জমি চাষ করে কৃষক ফসল ফলায়, গ্রামীণ জীবন অতিবাহিত হয় এক শান্তিময় ছন্দে, সেই পরিবেশ পুরোটাই ওলট–পালট ও শ্মশানে পরিণত করে দেয় পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। গভীর ও শান্ত নদী পদ্মার বুকে গুলি চলে। দেখা যায়, শিকারি চিল উড়ছে আকাশে।
একাত্তরের মার্চ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচার মানুষ হত্যা শুরু করে। নিরস্ত্র মানুষের ওপর তারা গণহত্যা চালায়। ঋত্বিক দেখান, বাংলার আকাশ শকুনের দখলে। তারই ফাঁকে পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের স্থিরচিত্র। এর সঙ্গে প্রতিস্থাপিত হয় নীল আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলা শকুনের উড়াল। তাদের নজর জমিনে, লাশের ওপর।
নিষ্পেষিত মানবতার প্রতি উৎসর্গ করা ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ প্রামাণ্যচিত্রটিতে এক উত্তাল সময়ের কথা তুলে আনতে চেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ...আমরা দেখতে পাই দাঁড়িপাল্লা ও শকুনের বারবার ফিরে আসা। ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজের ভেতর দিয়ে ঋত্বিক মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই ও তাঁদের শত্রুদের চিহ্নিত করতে চান।
উত্তাল হয়ে ওঠে পদ্মা। অস্ত্র ধরে এ দেশের সাধারণ মানুষ। নিমেষের ভেতর তারা বীর যোদ্ধা হিসেবে উদ্ভাসিত হয়। জান বাজি রেখে তারা রুখে দাঁড়ায়। তাদের সামনে দুটো পথই খোলা: মৃত্যু, নয়তো স্বাধীনতা। বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনামে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী প্রতিরোধের খবর। ছবি ছাপা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এরই ভেতর আরেকটি দৃশ্য ঘুরেফিরে আসে—দাঁড়িপাল্লার ছবি। ব্রতের আকারে আসা এই দাঁড়িপাল্লা একবার এদিকে হেলে পড়ে, তো আরেকবার ওদিকে। যুদ্ধের ময়দানে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষেই বেশি বাটখারা জমা হয়।
ঋত্বিক যে রুশ চলচ্চিত্র পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইনের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন, সেটি বেশ ভালো করে বোঝা যায় এই প্রামাণ্যচিত্রে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যখন অস্ত্র হাতে নিয়ে কঠিন জবাব দিতে থাকেন, তখন দেখা যায় ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’–এর মতো পাথরের সিংহ জাগ্রত হয়ে উঠছে। আমরা দেখতে পাই দাঁড়িপাল্লা ও শকুনের বারবার ফিরে আসা। ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজের ভেতর দিয়ে ঋত্বিক মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই ও তাঁদের শত্রুদের চিহ্নিত করতে চান।
যুদ্ধের বয়ানে শুধু যোদ্ধা ও যুদ্ধই থাকে না, আরও থাকে শরণার্থী, থাকে বিশ্ববাসীর সমর্থন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র সুরে আবেগ ও প্রতিশোধের বহ্নি জ্বালাতে জ্বালাতে ঋত্বিক আমাদের দেখান বাংলাদেশ থেকে পায়ে হেঁটে শত শত শরণার্থী গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে কলকাতায়। সে সময় কলকাতার সুধী সমাজ এবং শিল্প ও সংস্কৃতির জগতের সবাই তাঁদের সহায়তায় রাজপথে নেমে আসেন। সাহায্য–সহযোগিতা সংগ্রহ করতে থাকেন শরণার্থীদের জন্য, সীমান্তের ওপারে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। জয় বাংলার জন্য ত্রাণ সংগ্রহে শামিল হন শচীন দেববর্মন, দিলীপ কুমার, রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুর, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, সলিল চৌধুরী, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁরা রাস্তায় রাস্তায় অর্থ তুলছেন, মঞ্চে মঞ্চে গান গাইছেন, আহ্বান করছেন সহযোগিতার। বলছেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে। অসম যুদ্ধের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন ঋত্বিক ঘটক ও তাঁর বন্ধুরা।
কলকাতার রাস্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বড় করে টাঙানো। তাতে লেখা: শেখ মুজিবুর তোমার সোনার বাংলার জয় হোক। কলকাতার পত্রিকায় শেখ মুজিবকে নিয়ে খবরের পর খবর। এত বড় নেতাকে কি পশ্চিম পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলল? গুজবের পর গুজব। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা হাতে মানুষ। ট্রাকের ওপরে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সংগ্রহ করছে ত্রাণ। চাইছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমর্থন। বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে চাইছে। ঋত্বিক সেসব দৃশ্যের পেছনে আমাদের শুনিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। শচীনকর্তা গান বাঁধেন, ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই অখণ্ড এই ঢোল, সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের বোল...’। এই গানেই তিনি বলেন, ‘তারা সকলেই মুজিবরের ভাই’।
ঋত্বিক ঘটকের ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ শুধু ২১ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। সে চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে কলকাতা, তথা ভারতের চলচ্চিত্র ও সংগীতাঙ্গন কেমন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
কলকাতায় ১৯৭১ সালে যা হয়েছিল সেসবের খণ্ডচিত্র দেখানোর পাশাপাশি তিনি দেখান একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাঁরা নতুন বাংলাদেশ গঠন করবেন। আরও দেখতে পাই, একজন মাকে (নার্গিস দত্ত)। তিনি যেন দেশমাতৃকারই প্রত্নরূপ। তাঁর কিছুটা মিল পাওয়া যায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করছেন বিশ্ববিবেকের কাছে, বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই অন্যায় যুদ্ধ দেখে কি বিশ্বনেতারা মুখ বুজে থাকবেন, চোখ বন্ধ করে রাখবেন? তাঁরা কি কিছুই করবেন না?
পদ্মার হৃৎপিণ্ডে যখন রক্তক্ষরণ হচ্ছে, নদীর ঘোলা পানি যখন রক্তে রঞ্জিত, তখন সেই মুক্তিযোদ্ধাও একই আহ্বান জানাতে থাকেন, নির্মম গণহত্যা বন্ধ করো। যোদ্ধার এই আকুতি ফ্রিজ হয়ে নেগেটিভ হয়ে যায়। এরপর তার ওপর থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে রক্তের ধারা। সেই ধারার সঙ্গে ঋত্বিক মিশিয়ে দেন পদ্মার ঢেউকে। এরপর ক্যামেরা চলে যায় ফসলের মাঠে, যেখানে কৃষক নতুন করে বীজ ফেলছেন। নতুন বাংলাদেশ গড়ার নব উদ্যমে। যেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের রক্ত ধারণ করে বয়ে যাচ্ছে নদী। নদীবিধৌত দেশের জমিন শহীদদের আত্মত্যাগ ও বিসর্জনের বিনিময়ে এক নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ঋত্বিক ঘটকের ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ শুধু ২১ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। সে চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে কলকাতা, তথা ভারতের চলচ্চিত্র ও সংগীতাঙ্গন কেমন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কতটা আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছিল।
প্রামাণ্যচিত্রটি প্রযোজনা করেছিলেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ। ঋত্বিকও নিজেকে শতভাগ উজাড় করে ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর প্রাণের বাংলাদেশ বলে কথা! তিনি সারা জীবন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মিলনের কথা বলেছেন। সে জন্যই সব আবেগ দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন দুর্বার গতি পদ্মা। এটি একদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থনের ছবি, আরেক দিকে সাংস্কৃতিক মিলনেরও আহ্বান।