অলংকরণ: এম এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এম এম রাকিবুর রহমান

গল্প

তখ্‌ত

আগ্রা। ১৬০৮ সালের জুন মাস। সবে সকাল হয়েছে। শহরের উত্তর দিকের দেয়ালের ছায়া আড়াল করে রেখেছে দিল্লি দরওয়াজাকে। ওটার সামনে এরই মধ্যে জমে উঠেছে ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে আছে ভিনদেশি তাজির (ব্যবসায়ী), কাফেলা, ফকির, বিভিন্ন দেশের দূত, পথচারী। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি, মাল বহন করে আনা বিভিন্ন পশুর আওয়াজ আর সৈন্যদের হাঁকডাক মিলিয়ে একেবারে নরক গুলজার অবস্থা! এসবের মধ্যেও আলাদা করা যায় এক অশ্বারোহীকে। দীর্ঘকায় এক পুরুষ। ধুলামাখা পোশাক, কোমরে বাঁধা চামড়ার কোমরবন্ধনী। মাথায় পাগড়ি, চোখে গভীর দৃষ্টি ও সতর্কতা। ঘোড়াটা তার কৃষ্ণবর্ণের। ওটার পায়ে লেগে থাকা কাদামাটি, বহু পথ পেরিয়ে আসার প্রমাণ।

দিল্লি দরওয়াজার দারোগাকে উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়ে শহরে প্রবেশ করে অশ্বারোহীটি। সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে আগ্রার মূল বাজারের দিকে। দূরে আগ্রা কেল্লা রোদে ঝলমল করছে। ঘোড়াটাকে সেই দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কেল্লার বিশাল প্রাচীরে প্রহরীদের পাহারা দিতে। তারা সতর্ক দৃষ্টি মেলে রেখেছে বাইরের দিকটায়। বাজারের ব্যস্ততা পাশ কাটিয়ে সোজা চলে এল কেল্লার মূল প্রবেশপথ অমর সিং দরওয়াজায়। এখান দিয়ে কেবল রাজদরবারে তলবপ্রাপ্তরাই ঢুকতে পারে।

আদিল অনুমতিপত্র দেখিয়ে বলল, ‘ম্যায় আদিল বেগ। বাদশাহের জন্য সংবাদ নিয়ে এসেছি সুবা-ই-বাংলা থেকে।’

দরওয়াজা দারোগা ফরমান পরীক্ষা করে নিচু গলায় বলল, ‘তুমি সোজা চলে যাবে দিওয়ান-ই-খাসে। লেকিন হোশিয়ার রেহনা, হুজুর। এ শহরের দেয়ালের ছায়াতেও বিশ্বাসঘাতক লুকিয়ে থাকে।’

কেল্লার ভেতরটা যেন অন্য এক জগৎ। রাস্তাগুলো পাথুরে। সেসবের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদাররা। প্রাসাদভবনের উঠানে মোগলদের বিখ্যাত চাহারবাগ। বাগানগুলো পারস্যের বাগানের আদলে করা। চারদিকে দেশি-বিদেশি হরেক রকমের ফুল ফুটে আছে। ওসবের গন্ধে চারপাশটা সুবাসিত। মালিরা চাহারবাগের পরিচর্যায় ব্যস্ত। ওসব দেখতে দেখতে অবশেষে আদিল হাজির হয় আগ্রা কেল্লার দিওয়ান-ই-খাসে। এখানে শুধু বাদশাহর প্রিয় সভাসদরাই আসার অনুমতি পায়।

দিওয়ান-ই-খাসের একদম মাঝখানে এক উঁচু আসনে বসে আছেন চতুর্থ মোগল সম্রাট নুরুদ্দিন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী। পেছনে খাস নকর, দুই পাশে বেশ কয়েকজন অমাত্য। আর খানিক দূর থেকে দাঁড়িয়ে আছে পাগড়ি পরা এক তরুণী, চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। আদিলকে দেখে বাদশাহ জাহাঙ্গীর বলে উঠলেন, ‘তুমিই বাংলার দূত? আদিল বেগ? ইসলাম খান কীভাবে সামলাচ্ছেন সুবা-ই-বাংলার বিদ্র্রোহীদের।’

আদিল সামনে এগিয়ে এসে চাগতাই তুর্কি ভাষায় বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘হুজুর, বারো ভূঁইয়াদের ঘাঁটিগুলো নদী আর খাল ঘিরে তৈরি। বর্ষার সময় ওগুলো দখল করা বেশ কঠিন। কিন্তু সুবাদার ইসলাম খান ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। শত শত নৌযান সংগ্রহ করা হচ্ছে। চলছে যুদ্ধের জোরদার প্রস্তুতি। সেসব সম্পর্কে আলা হজরতকে ওয়াকিবহাল করতেই আমাকে পাঠানো হয়েছে।’

‘তোমার যাত্রাপথে কি কেউ অনুসরণ করেছিল?’

‘না হুজুর...অন্তত আমার চোখে পড়েনি।’

বাদশাহ তাকালেন পাশে দাঁড়ানো সেই তরুণীর দিকে।

‘তবে ওর চোখে কিন্তু পড়েছে।’

সবাই অবাক হয়ে তাকাল সেই তরুণীটির দিকে।

‘দিল্লি থেকে বাংলার এই দূতের পেছনে ছায়ার মতো লেগেছিলাম। শেরগড় থেকে পাঁচ উজবেক ওর পিছু নিয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না বাংলার খবর আগ্রা পর্যন্ত পৌঁছুক। আগ্রায় ঢোকার আগের উঁচু টিলাটায় পাওয়া যাবে ওই উজবেকদের লাশ। গত রাতেই ওদেরকে পরপারে পাঠানো হয়েছে।’

আদিলের মুখ থেকে অজান্তেই বের হয়ে গেল, ‘তুমি কে?’

‘আমার নাম গুলরুখ। মোগল গুপ্তচর।’

সব শুনে বাদশাহ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আদিল বেগ খুঁজে বের করো কারা তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল? সেটার পেছনে রহস্যটাই–বা কী? সভা এখানেই শেষ।’

২.

সন্ধ্যা। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য একটু আগেই বিদায় নিয়েছে। আগ্রার বিখ্যাত গরম কমতে শুরু করেছে। উঁচু মিনারে দাঁড়িয়ে শিঙা বাজাচ্ছে কেল্লার পাহারাদার। রাতের পাহারা বাড়ানোর সংকেত ওটা। কেল্লার ভেতরের এক হাওয়াখানায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ—আদিল বেগ আর গুলরুখ। নীরবতা ভেঙে গুলরুখ বলে উঠল, ‘তুমি হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছ, ইসলাম খান শুধু বাংলার বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে লড়ছেন না। এই আগ্রা শহরের কিছু লোকও তাঁকে ধ্বংস করতে চাইছে।’

‘কী বলছ তুমি! এখানকার লোকজনই বাংলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে?’

সায় দিয়ে গুলরুখ মাথা ঝাঁকাল।

‘একসময় সুবা-ই-বাংলার রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ করত আহসানউল্লাহ নামের এক সাবেক আমির। এখন সে দরবারের প্রভাবশালী কয়েকজনের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করছে।’

‘কিন্তু কী লাভ এতে তার?’

গুলরুখ নিচু গলায় বলল, ‘কয়েক বছর আগে বিহারে আহসানউল্লাহর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ইসলাম খান। সে সময় তার ভাইকেও বন্দী করা হয়েছিল। সেটারই প্রতিশোধ হিসেবে সে চাইছে, কোনো না কোনোভাবে বাংলার অভিযান ব্যর্থ হোক। এতে বাদশাহর চোখে ছোট হয়ে যাবেন বাংলার সুবাদার।’

‘সবই তো বুঝলাম কিন্তু তুমি কেন আমাকে সাহায্য করছ, গুলরুখ?’

‘বিহারের সাবেক দিওয়ান (রাজস্ব বিভাগের প্রধান) শামসুদ্দিন খানের মেয়ে আমি। বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদে আমার আব্বা হুজুরকে হত্যা করিয়েছিল এই আহসানউল্লাহ। কেননা, তার দুর্নীতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমার আব্বা।’

৩.

কেল্লার অতিথিশালায় নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে আদিল যখন ফিরে এল, তখন আগ্রার আকাশে তারাগুলো বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে কোথাও করুণ সুরে বাঁশি বাজছে। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল টেবিলে থাকা একটি চিরকুট। তাতে লেখা, ‘জনাবে আলা আদিল বেগ, আপনি যাকে বিশ্বাস করছেন, তিনিই আপনার মৃত্যুর কারণ হবেন। আজ রাতের তৃতীয় প্রহরে কেল্লার পশ্চিম প্রাচীরের নিচে আসুন। প্রকৃত সত্য জানতে পারবেন।’

চিঠিটা পড়ে আদিল খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল। মরণফাঁদ নাকি সত্যের উন্মোচন? উপেক্ষা করার উপায় নেই।

রাত ১২টা। আগ্রা দুর্গের পশ্চিম প্রাচীরের কাছে হাজির হয়েছে আদিল বেগ। আকাশে অর্ধেকটা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। দূরে ধাতব কোনো কিছুতে লাঠি ঠুকছে কেল্লার প্রহরী। হয়তো সতর্কবাণী। কে বলতে পারে?

পাথুরে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে থাকে ও। নাগরা খুলে ফেলেছে, হাঁটছে নিঃশব্দে। গায়ে কালো চাদর। কোমরে ঝুলছে সিরোহি তলোয়ার আর কোমরের পেছনে কোমরবন্ধনীতে লুকানো খঞ্জর। তলোয়ারটা রাজস্থানের সিরোহিতে তৈরি করা। দামেস্ক ইস্পাতের এই তলোয়ার অন্যান্য সাধারণ তলোয়ারের চেয়ে হালকা আর সরু। অনেক দিনের সঙ্গী ওটা। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করার জন্য যথাযথ এক অস্ত্র।

সিঁড়ির নিচে পৌঁছেই সে থেমে গেল।

পাথরের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। মাথায় ঘোমটা, গায়ে সালোয়ার-কামিজ।

‘তুমিই আদিল বেগ?’ নিচু স্বরের জিজ্ঞাসা।

‘হ্যাঁ। তুমি কে?’

‘সাহেরা। আমির আহসানউল্লাহর সাবেক দাসী। আগ্রায় আসার পর থেকেই ওরা তোমাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। আগামীকাল তুমি যখন বাদশাহর খাস দরবারে থাকবে, তখন একজন গায়ক গান গাইবে। সেই গানই হবে সংকেত আর তখনই ছোড়া হবে বিষাক্ত ছুরি।’

‘এসব তথ্য আমাকে কেন বলছ?’

‘আমার ভাই আমির আহসানউল্লাহর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল। ও ছিল ফারসি অনুবাদক। মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয় যমুনায়। ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই।’

তাদের মধ্যে আরও কিছু কথাবার্তা চলছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে শোনা গেল ছুটে আসা কিছু পায়ের শব্দ।

আদিল এক ঝটকায় সারিবদ্ধ খিলানের ছায়ায় নিজেকে মিশিয়ে দেয়। ঠিক তখনই হাজির হলো তিন ছায়ামূর্তি। মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ‘ওকে এই দিকটাতেই যেতে দেখেছি!’

আদিল বুঝল, এটা ফাঁদ। কিন্তু কে তাকে এই ফাঁদে ফেলল? এত ভাবার সময় নেই।

সাহেরা বলে উঠল, ‘ওরা তোমার জন্য এসেছে। দৌড়াও!’ তারপর সে হারিয়ে গেল কেল্লার অন্ধকারে।

পালালে চলবে না। আক্রমণকারীদের কাছে নিশ্চয় কোনো না কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে। নিঃশব্দে স্তম্ভের আড়াল থেকে বের হলো। সামনেই পড়ে গেল এক আক্রমণকারী। আদিল দ্রুত বাঁ হাত দিয়ে ধরে ফেলে আক্রমণকারীর তলোয়ার ধরা কবজিটি, আর ডান হাতে নিজের খঞ্জরটা বসিয়ে দেয় আক্রমণকারীর বুকের বাঁ দিক বরাবর। কঠিন আঘাত। বুক থেকে হঠাৎ সব বাতাস বের হয়ে যাওয়ার মতো একটা আওয়াজ করে আক্রমণকারী পড়ে গেল পাথুরে মেঝেতে। পড়ার আগেই মৃত্যু নিশ্চিত। এটা দেখে বাকি দুই ছায়ামূর্তি একটু যেন থমকে গেল। সেই সুযোগে নিজের সিরোহি তলোয়ার বের করে ফেলল আদিল বেগ। চাঁদের আলোতে তলোয়ারের ফলকে দেখা গেল একরকম শীতল দীপ্তি। তলোয়ার আর ছায়ার নাচন চলল খানিকক্ষণ। আদিল বেগের পায়ের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারল না আক্রমণকারীদের কেউ। আদিল বেগ যেন নেচে বেড়াচ্ছে। প্রলয় নাচ যখন থামল, আক্রমণকারীদের একজন কাঁধে গুরুতর আঘাত আর অন্যজন কাটা হাত নিয়ে পালিয়ে গেল।

সব শান্ত। আদিল হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়াল পড়ে থাকা মৃতদেহটার পাশে। নিঃশব্দে হাত চালাল মৃত ব্যক্তির আচকানের ভেতর। আঙুলে ঠেকল একটা ভাঁজ করা কাগজ। তাতে দারুচিনির কালিতে ফারসিতে লেখা—‘লক্ষ্য পূরণ হওয়ার আগেই যদি ধরা পড়, তাহলে নিজের পরিচয় গোপন রেখো। জয় আমাদের হবেই।’

আদিল বেগের কপালে পড়ল চিন্তার ভাঁজ। এই ষড়যন্ত্র কোথায় গিয়ে শেষ হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এই রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে।

৪.

দিওয়ান-ই-খাসের খিলানগুলোর ফাঁকফোকর গলে ঢুকে পড়ছে শেষ বিকেলের আলো। বাদশাহ জাহাঙ্গীর বসে আছেন সিংহাসনে। সভাসদদের নিয়ে চলছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। হঠাৎ আদিল বেগকে দেখা গেল সভায় প্রবেশ করতে। উষ্কখুষ্ক বেশভূষা। চোখে সারা রাত না ঘুমানোর ক্লান্তি। আদিলের চোখগুলো এদিক–সেদিক ঘুরতে থাকে। কাকে যেন খুঁজছে। খানিকটা খোঁজাখুঁজি করতেই পেয়ে যায় গুলরুখকে। চোখাচোখি হতেই ইশারায় একজনের দিকে তাকাতে বলে সে। নির্দেশনামতো তাকাতেই চোখে পড়ে এক গায়কের দিকে। হাতে সেতার। সভা শেষে মনোরঞ্জনের জন্য ডাকা হয়েছে সেই গায়ককে। বাদশাহর প্রতি সম্মান জানিয়ে বিখ্যাত সুফি কবি আমির খসরুর সৃষ্টি রাগ বাহারে গজল শুরু করে গায়ক, ‘তুমি যদি প্রেম বোঝো, তবে প্রেমিকার ছায়াকেও ভালোবাসো...’

সভায় উপস্থিত সবাই গজলে মশগুল। কিন্তু আদিল তাতে মন দিতে পারছে না। আজকেই কিছু একটা ঘটতে চলেছে। গায়কের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না কেউ। কিন্তু আদিল আড়চোখে তাকিয়ে আছে গুলরুখের দিকে। আজ সে মোগল অভিজাত নারীর সাজে এসেছে। পরেছে ঘন রঙের পেশওয়াজ (লম্বা কুর্তার মতো পোশাক)। কিছুক্ষণ পরেই সেই পোশাকের লম্বা হাতার ভেতর থেকে লম্বা কিছু একটা বের করতে থাকে গুলরুখ। আদিল বুঝে যায় কী ঘটতে যাচ্ছে। গুলরুখের চোখে ফুটে উঠেছে ঘৃণা। পোশাকের থেকে বের করা ছুরিটা সর্বশক্তিতে ছুড়ে মারে বাদশাহর উদ্দেশে। আর তখনই কোমর থেকে খঞ্জরটা বের করে আদিল ছুড়ে মারে সেই ছুরির উদ্দেশে। লক্ষ্যভেদ করার আগেই গুলরুখের ছুরিটাকে থামিয়ে দেয় আদিলের খঞ্জর।

দরবারে শুরু হয়ে যায় হইচই! গুলরুখও পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তখনই তার পথ রোধ করে দাঁড়ায় সাহেরা। দ্রুততার সঙ্গে পোশাকের ভাঁজে রাখা ধাতব শিকল দিয়ে গুলরুখের গলা পেঁচিয়ে ধরে।

‘মোগল দরবারে খুন করে পালানো কি এতই সহজ?’—হিমশীতল কণ্ঠে বলে ওঠে সাহেরা। ধীরে ধীরে জোর বাড়ায় সেই শিকলে। দমবন্ধ হয়ে ঢলে পড়তে থাকে গুলরুখ। এমন বিশৃঙ্খলার মধ্যে বাদশাহকে রক্ষার জন্য তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ায় আদিল বেগ। মাটিতে থাকা একটা বর্শা তুলে নেয় হাতে। এরই মধ্যে শোরগোল শুনে দিওয়ান-ই-খাসের বাইরের প্রহরীরাও ছুটে আসে। তাদের মধ্যে থাকা একজন আচমকা তির ছোড়ার প্রস্তুতি নেয়। লক্ষ্য বাদশাহ। দেরি না করে আদিল বেগ হাতের বর্শাটা দিয়ে গেঁথে ফেলে বিশ্বাসঘাতকটাকে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর গুলরুখের নিথর দেহের পাশে এসে দাঁড়ান বাদশাহ।

‘এই বিশ্বাসঘাতকদের পেছনে কারা?’

আদিল হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘হুজুর, এই হত্যাচেষ্টার পেছনে আছে আহসানউল্লাহ ও তার দল। আপনাকে হত্যা করে শাহজাদা খসরু মির্জাকে সিংহাসনে বসাতে চায় এই ষড়যন্ত্রকারীরা।’

‘কিন্তু শাহজাদা তো অন্ধ। গত বছরই তাকে অন্ধ করে দিয়েছি। যদিও এই কাজের জন্য আমি অনুতপ্ত। কিছুই করার নেই, কেননা মোগল তখ্ত (সিংহাসন) সব সময় রক্ত চায়।’

‘শাহজাদাকে ভুল বুঝবেন না বাদশাহ। এসবের কিছুই জানেন না শাহজাদা। ষড়যন্ত্রকারীদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনাকে হত্যা করে মোগল রাজপরিবারের এমন কাউকে সিংহাসনে বসানো, যাকে সামনে রেখে নির্বিঘ্নে সাম্রাজ্য শাসন করা যাবে। আপনাকে সরিয়ে দেওয়ার পর তাদের লক্ষ্য হতো শাহজাদা খুররম (পরবর্তী সম্রাট শাহজাহান)।’

‘কিন্তু এত সব তথ্য জানলে কীভাবে?’

‘গত রাতে আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তখনই আমার সন্দেহ হয়। সকালে খোঁজ নিয়েছিলাম আগ্রার কোতোয়ালের (ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা) দপ্তরে। সেখান থেকে জেনেছি, গুলরুখের দাবি করা সেই পাঁচ উজবেকের মৃতদেহ কোথাও পাওয়া যায়নি। তখনই বুঝতে পারি মিথ্যা বলেছে গুলরুখ। আমাদের নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাইছিল।’

‘দারুণ কাজ করেছ আদিল বেগ। তুমি শুধু আমার প্রাণই বাঁচাওনি, মোগল সাম্রাজ্যকে এই কুচক্রীদের হাত থেকে রক্ষা করেছ। এখন তোমার কাজ হবে ষড়যন্ত্রকারীদের সমূলে ধ্বংস করা। আশা করি তুমি আমাকে হতাশ করবে না।’

‘জি হুজুর, আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করব।’

বাদশাহর দেওয়া নতুন মাকসাদ নিয়ে দিওয়ান-ই-খাস থেকে বের হয় আদিল বেগ। রাতের অন্ধকার দূর করতে এরই মধ্যে আগ্রা কেল্লায় জ্বলে উঠেছে মশালগুলো। সেগুলো কেল্লার মশালদানিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উঁচু মিনারে দাঁড়িয়ে শিঙা বাজাচ্ছে কেল্লার পাহারাদার। রাতের পাহারা বাড়ানোর সংকেত ওটা।