
ভাদ্র মাসের এক অসহ্য গরমের রাতে আইজল মিয়া যখন আধা ঘণ্টা ধরে হাতপাখা চালানোর পর তন্দ্রার দেখা পায়, ঠিক তখন শাহীনের মাইকে উচ্চস্বরে বেজে ওঠে—
‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা
ভালো না হাতের লেখা
আসো যদি বাঁশবাগানে
আসো যদি বাঁশবাগানে
আবার হবে দেখা গো
আবার হবে দেখা।’
আইজল ধড়মড় করে উঠে দাঁতে দাঁত ঘষে হারিকেনের সলতে উসকে দিলে হাত চেপে ধরে তার স্ত্রী জুলেখা। আইজল কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে জুলেখার অনুনয়ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ জলের মতো শান্ত হয়। জুলেখা ঘুমজড়ানো গলায় বলে, ‘কাজিয়া করেন না।’
আইজল রোষের সঙ্গে এক তীব্র ফুৎকারে হারিকেন নিভিয়ে দিয়ে চৌকিতে শবের মতো শুয়ে থাকে। জুলেখার প্রৌঢ় হাত স্বামীর রোগাপটকা শরীরকে দুর্বল আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে।
শাহীনের সঙ্গে আইজলের বিবাদ পুরোপুরি ব্যবসায়িক। দুজনই শব্দবণিক, তবে দুই প্রজন্মের। ত্রিশ বছর ধরে আইজল তেলিটারি গ্রামের তারকা ব্যক্তি। শুধু কলের গানের ব্যবসাদার হিসেবে নয়, সংগীতের সমঝদার হিসেবে তাকে পুরো ইউনিয়ন এলাকার মানুষ মান্য করে। ষোলো, বারো ও দশ ইঞ্চির প্রায় শ দুয়েক রেকর্ডের মালিক সে।
এত দিন আইজলের ব্যবসা একচেটিয়া চলছিল। ঘাঘট–তীরবর্তী এই অঞ্চলে রাস্তাঘাটের বালাই না থাকায় বাইরের মানুষ সচরাচর এমুখো হয় না। এলাকার বিয়েশাদি, হালখাতা, মেলা, পূজা-পার্বণের সময় কলের গান বাজিয়ে আইজল বিস্তর অর্থকড়ি কামিয়েছে। যারা টাকা দিতে অসমর্থ, তারা খেতের ধান বা আলু দিয়ে গান শুনেছে। তখনো ঘরে ঘরে রেডিও পৌঁছে যায়নি। ভাওয়াইয়া, চটকা বা বিচ্ছেদির বাইরে গান কেউ শোনেনি। সে সময় আইজল হিজ মাস্টার্স ভয়েস, কলম্বিয়া বা টুইন কোম্পানির নামীদামি শিল্পীদের গাওয়া বাংলা, উর্দু ও হিন্দি গান শুনিয়ে মানুষকে চমকে দিয়েছে।
চোঙার ভেতর আশ্চর্য দুনিয়া। কলের গানের বার্মাটিকের বাক্সে রেকর্ড বসিয়ে হাতল ঘোরালেই ভোজবাজির মতো গান বেরোতে শুরু করে। ছয় বা তিন মিনিট পর আবার বন্ধ হয়ে যায়। তখন ডিস্ক উল্টে দিলে নতুন গান শোনা যায়। ত্রিশ বছর ধরে গরুর গাড়িতে করে গ্রামে গ্রামে কলের গান নিরুপদ্রবে বাজিয়ে শুনিয়েছে আইজল। এই করে তার হালের গরু দুটো থেকে পাঁচটা হয়েছে। বাইশ হাত টিনের ঘর হয়েছে। আট বিঘা ধানি জমির মালিকও সে হয়েছে। রেডিওর ক্রমাগত সাফল্যের মধ্যেও তার ব্যবসা দিব্যি চলছিল। অথচ মাসখানেক ধরে এক নতুন উৎপাতের সামনে সে অসহায় হয়ে পড়েছে।
শাহীন আইজলের দূরসম্পর্কের ভাতিজা। কলের গানের নেশায় আইজলের পেছন পেছন ঘুরে বড় হয়েছে। আইজল ও তার কলের গান শাহীনের কাছে আজীবন ছিল বিস্ময়ের বস্তু। দেখামাত্র আইজলকে সে লম্বা সালাম দিয়ে আসছে। অথচ মাসখানেক আগে মাইক কিনে আনার পর শাহীন আমূল বদলে গেছে। শুধু মাইক নয়, সেই সঙ্গে ক্যাসেট ও মাইক্রোফোন নামের যন্ত্রও এনেছে। এদিকে বিদ্যুৎ নেই। ব্যাটারি দিয়ে শাহীন যন্ত্রগুলো চালায়। রাতদিন মাইক বাজিয়ে এলাকার মানুষের দৃষ্টি ইতিমধ্যে শাহীন আকর্ষণ করে ফেলেছে। এখন অহংকারে তার পা মাটিতে পড়ছে না। আইজলকে দেখলে সম্মান করা দূরের কথা, তার বাড়ির দিকে মাইকের মুখ রেখে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে রাতভর গানবাজনা শোনে। আইজল অনেকবার নিষেধ করলেও শাহীন গ্রাহ্য করেনি। আধুনিক ক্যাসেট ও মাইকের যুগলবন্দীর সামনে গ্রামোফোন কতটা অকার্যকর, সেটাই যেন রাতদিন প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গরুর গাড়ির যুগ শেষ। এখন রিকশাভ্যানের যুগ। ভোরবেলা আবদুল ভ্যানওয়ালার বেলের আওয়াজে আইজলের ঘুম ভেঙে গেল। জুলেখা ততক্ষণে উঠে সুপারিপাতার ঝাড়ু দিয়ে উঠান ঝাঁট দেওয়া শুরু করেছে। চারটে পান্তাভাত পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে খেয়ে আইজল কলের গান নিয়ে আবদুলের ভ্যানে উঠে বসল। গন্তব্য আট মাইল দূরের গ্রাম তালুক ইসাদ। সেখানকার প্রভাবশালী জোতদার জাফর হাজির মেয়ের ঘরের নাতির সুন্নতে খতনা উপলক্ষে কলের গান শোনানোর জন্য আইজলের ডাক পড়েছে।
হাজি সাহেবের বাড়িতে এলাহি কাণ্ড। পীরগাছা থেকে শামিয়ানা ভাড়া করে এনে টাঙানো হয়েছে। কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারে এলাকার বিশিষ্টজনেরা বসেছে। বাকিরা বসেছে চটের ওপর। আইজল কলের গান নিয়ে পৌঁছানোমাত্র কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তাকে ঘিরে ধরল।
চার পায়ায় সিংহমূর্তি আঁকা একটা শাল কাঠের টেবিলের ওপর গ্রামোফোন রেখে পিয়ারু কাওয়ালের একটা কাওয়ালি গানের রেকর্ড বসিয়ে ধীরে ধীরে ‘দ’ আকারের হাতল ঘুরিয়ে দিল আইজল। বাজতে শুরু করল—
‘মাদিনে কা মুসাফির হুঁ
মেরে হাকপে তওবা করনা।’
আইজল জানে, গানটা হাজি সাহেবের প্রিয়। দশ ইঞ্চির রেকর্ড, বাজবে ঠিক তিন মিনিট। এ সময় তার কিছু করার নেই। সে দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে একগাল হেসে কৌতূহলী মানুষের সামনে বিস্ময়ের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আইজলের গৌরব বেশিক্ষণ টিকল না। দূর থেকে সুর ভেসে আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে কাছে এলে স্পষ্ট হলো শাহীনের মাইকের বিকট শব্দ। কলের গানের অস্পষ্ট কাওয়ালি ছাপিয়ে মুহূর্তের মধ্যে শ্রোতাদের সব মনোযোগ কেড়ে নিল একটা সুপরিচিত গান—
‘আছেন আমার মোক্তার
আছেন আমার ব্যারিস্টার।।
শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে
তিনি আমায় করবেন পার
আমি পাপী তিনি জামিনদার।।’
মানুষ হই হই করে উঠে দাঁড়াল। চোখের নিমেষে আইজলের সামনে থেকে সব মানুষ সরে গেল। পতঙ্গ যেমন আগুন দেখলে তেড়ে যায়, তেমনি অভিভূতের মতো তারা শাহীনের মাইকের পেছন পেছন ছুটতে শুরু করল। শাহীন ভ্যান দাঁড় করাল আইজলের ঠিক সামনে। ব্যাটারিচালিত ক্যাসেট প্লেয়ারে একের পর এক নতুন সিনেমার গান বেজে আসরের সব আলো কেড়ে নিল। আইজলের রেকর্ড থেমে গেছে কখন, সেটা সে নিজেও টের পেল না।
শুধু ভ্যানওয়ালা আবদুল তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। সে বাহুতে একটা চিমটি কাটামাত্র আইজলের হতভম্ব দশা কাটল। প্রচণ্ড ক্রোধে জ্বলে উঠে সে হনহন করে বাড়ির পেছনে রওনা হলো। সেখানে বড় বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছে। গৃহকর্তা জাফর হাজি নিজে রান্নার তদারক করছেন। তার সামনে গিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে আইজল বলল, ‘এটা তোমার কেমন বিচার হাজি সাব?’
জাফর হাজি হাতের তালুতে মাংসের সুরুয়া নিয়ে পরখ করে দেখছিলেন। তিনি জিব দিয়ে সামান্য চেটে নিয়ে বললেন, ‘কী হইছে?’
‘কী ফির হয় নাই? এত বড় অপমান! মুই থাকতে তোরা শাহীনক ডাকাইছেন?’
কাঁধের গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে হাজি শান্ত গলায় বললেন, ‘এখন মাইকের যুগ। কান পাতি শুন, অ্যাটে থাকিয়াও কত জোরে আওয়াজ শোনা যাইতোছে। তোর কলের গান এত দূর শোনা যায়?’
আইজল ভীষণ গোস্স্যা হয়ে বলল, ‘তাইলে উয়াকে ডাকাইনেন হয়। মোক কেসক ডাকাইছেন?’
জাফর হাজির চোখ ক্রোধে জ্বলে উঠল। তিনি তর্জনী তুলে বললেন, ‘মোর একটামাত্র নাতি। আইজ তারে অনুষ্ঠান। কোনো কিছুর কম হউক মুই চাও না। কলের গান যারা শুনবার চায়, তামাক শুনাবু। যারা মাইকের গান শোনবে, তারা মাইকের গান শুনুক।’
বাবুর্চিদের সঙ্গে জাফর হাজি ব্যস্ত হয়ে পড়লে আইজল ধীরপায়ে চৌকো টেবিলের সামনে ফিরে এল। যাওয়ার সময় তার মধ্যে যে প্রজ্বলিত আগুন ছিল, তা নিভে গেছে। কলের গানের সামনে একজন মানুষও নেই। সবাই শাহীনের মাইকের সামনে গিয়ে গান শুনছে। বিস্ফারিত চোখে অদেখা নতুন যন্ত্রগুলো দেখছে। আইজলের চোঙের মতো তামাটে কলের গান ও বার্নিশ করা বার্মাটিকের বাক্স তারা বহুদিন বহুবার দেখেছে। সেগুলোর প্রতি একটা শিশুরও আর আগ্রহ নেই।
নীরবে কলের গান গুছিয়ে নিয়ে আবদুলের ভ্যানে উঠে বসল আইজল। আট মাইলের রাস্তা কম পথ নয়। পুরো রাস্তা সে একটা কথাও বলল না। পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। বাড়ির কাছে এসে আবদুল বলল, ‘জামাই, মন খারাপ নাকি?’
আইজল তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠে একটা কড়া জবাব দেবে, তার আগেই আবদুল আবার বলল, ‘মন খারাপ করি কী করমেন? নতুনের কাছে পুরাতুনক জাগা ছাড়ি দেওয়া নাগে। মোর দিক দেখেন না! মুই আছনু গাড়িয়াল। সারা জীবন গরুর গাড়ি চালাইছি। এখন ভ্যান আসিয়া আর গরুর গাড়ির খাওয়া নাই। মুই অ্যালা কী করোঁ? গরুর গাড়ি চলাইলে মোর প্যাটত ভাত জোটবে? মুই ভ্যান চালা শুরু করনু।’
আবদুলের মুখে কথাগুলো শুনে আইজল স্তব্ধ হয়ে গেল। আবদুল এক ক্লাসও স্কুলে পড়েনি। অথচ জীবনকে কত সহজভাবে নিতে শিখেছে। পরিবর্তন সর্বজনীন। সেই কথা কী সুন্দর করে বলল!
পরের এক মাস চরম বিভীষিকায় কাটল। এই তল্লাটে কলের গান আমদানি করার পর থেকে আইজল তারকাখ্যাতি উপভোগ করে আসছে। মানুষ একসময় বায়নার টাকা নিয়ে তার পিছু পিছু ছুটত। দিনের পর দিন অপেক্ষা করত, আইজলের আশ্চর্য কলের গান ভাড়া করে বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে। অথচ গত এক মাসে ভাড়ার জন্য কেউ তার কাছে এল না। শাহীনের মাইকের সামনে তার এত দিনের গড়ে তোলা ব্যবসা পাটকাঠির বেড়ার মতো ধসে পড়ল।
পড়ে থেকে কলের গানে ধুলা জমে গিয়েছিল। গত ত্রিশ বছরে এ রকম কখনো হয়নি। একদিন সকালে আইজল তার সাধের কলের গান ও তিল তিল করে জমানো সব রেকর্ড লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলল।
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আইজলের হুঁশ হলো। সে সারা দিন ভাঙা কলের গান ও রেকর্ডের টুকরা বুকে নিয়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদল। জুলেখা ভাত খেতে বারবার ডাকলেও ভ্রূক্ষেপ করল না।
সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে জুলেখা জোর করে ভাঙা টুকরাগুলো সরিয়ে ফেলল। আইজলের আবেগ ততক্ষণে থিতিয়ে এসেছে। সে হাতমুখ ধুয়ে মুড়ি-জল–পান খেতে বসেছে, এমন সময় দুজন লোক হনহন করে উঠানে ঢুকে পড়ল। হাঁক ছেড়ে তাদের একজন বলল, ‘কই বাহে আইজল? নাপাইচণ্ডীর মেলাত এবার কলের গানের আসর বসামো। হামরা তারে বায়নার টাকা ধরি আসছি। তোরা কিন্তুক অন্য কোনোটে ডেট ফেলান না। ঠিক আছে?’
আইজলের মনে হলো, তার গলায় মুড়ি আটকে গেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে মাদুরের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল। জুলেখা চিৎকার করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে লোকগুলো মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইল।
চোখ মুদবার আগে আইজলের মনে হলো, তার অতি চেনা কলের গানটি আবারও কোথায় যেন বাজতে শুরু করেছে।