অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

গল্প

পাঁচ দেয়ালের ঘর

শহরের শেষ মাথায় রাইহানার বাড়ি। এখানে তার জন্ম এবং জীবনের দুই–তৃতীয়াংশ পার হয়ে গেছে। বহুবার এ বাসা থেকে বের হতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু পারেনি। তার ধারণা, এখানেই তার মৃত্যু হবে। যদিও মৃত্যু নিয়ে সে ভাবে না। কারণ, মৃত্যু বলে বাস্তবে কিছু নেই। সে মনে করে মানুষের আর দশটা বিষয় বুঝতে না পারার মতো সাধারণ বিষয় হচ্ছে মৃত্যু। মানুষ কখনো মারা যায় না। তার এ রকম ধারণার কারণ তার নিজেরই মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। যদিও এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না, বিশেষ করে তার স্বামী সনক। সনক একজন আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। শহরের অনেক বিল্ডিংয়ের ডিজাইন তার করা। বিয়ের আগে রাইহানা তার স্বামীকে জানিয়েছিল, সে বিয়ের পর এই বাড়িতে আর থাকবে না। সনক এ রকম সিদ্ধান্তে যথেষ্ট খুশি ছিল। কিন্তু রাইহানার বাড়িটা আর ছাড়া হলো না। কারণ, সনক  তার নিজের বিশাল ফ্ল্যাট ছেড়ে এখানে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। সনকের মনে হয়, সেন্টারে থাকার চেয়ে পেরিফেরিতে থাকা ভালো। শান্তিতে থাকা যায়। রাইহানা এটাই ভয় পেয়েছিল। রাইহানা তো বটেই, সনকও শেষে স্থানের ফাঁদে পড়ল। কী এক ম্যাগনেটিক পাওয়ার! রাইহানার মনে হয়, হয়তো তারা স্পেস লুপে পড়ে গেছে।

দুই

চারতলা এ বাসার নাম ‘পাঁচ দেয়ালের ঘর’। কেন বাড়ির নাম পাঁচ দেয়াল হলো, সেটা রাইহানার দাদা বেঁচে থাকলে হয়তো জানতে পারত। বাসার ছাদের এক কোণে একটা লাইব্রেরি আছে, যেটা পাঁচ দেয়ালের। এই লাইব্রেরিতে রাইহানা প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু সময় বসে থাকে, বইগুলো বের করে আবার গুছিয়ে রাখে। কিন্তু কেউ তাকে মগ্ন হয়ে কোনো বই পড়তে দেখেনি। এ নিয়ে সনক একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল ‘কই তোমাকে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তে দেখি না কখনো! রাইহানা বলেছিল, ‘বইগুলো আমার সাথে গল্প করে, ওদের সাথে গল্প করতে করতে ওদের আর পড়াই হয় না।’ 

সনক রাইহানার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলে ‘পারসোনিফাই করছো।’ 

পাঁচ দেয়ালের লাইব্রেরি ঘরটা হতে পারে রাইহানার এ বাড়িতে থেকে যাওয়ার কারণ। কতবার ভেবেছে বাড়িটা ভেঙে নতুন করে গড়বে, কিন্তু পারেনি। মনে হয়েছে এই লাইব্রেরির মানুষগুলো হারিয়ে যাবে। দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো আছে বই। এখানে এলে মনে হয় তার, পৃথিবীতে কেউ মারা যায় না। মৃত্যু স্রেফ চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়ার উপলক্ষ। এবং সে আরও উপলব্ধি করেছে পুরো পৃথিবী মৃতরা নিয়ন্ত্রণ করছে। জীবিতরা মৃতদের হাতের পুতুল। এই বইঘরে এসব আলোচনা চলে। মৃতদের বয়স যত বাড়তে থাকে, তাদের মূল্য তত বাড়তে থাকে। তারা আরও অভিজ্ঞ হতে থাকে। সবচেয়ে মজার এবং আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মৃতদের হিউমার সেন্স। কী সুন্দর আস্তিক নাস্তিক মিলে গল্প করে। এত যে চিন্তার খেলা তবু কেউ কারও সঙ্গে বিরোধে নেই। মনে হয় অনেকগুলো রেখা ক্রসিং ছাড়াই ওভারলেপ করছে শুধু। এমনকি সেদিন সে এখানে দুজন ব্যক্তিকে আলোচনা করতে শুনছিল, যাদের একজন ছিল খুনি, আরেকজন নিহত। যারা বর্তমানে দুজনেই মৃত।  কিন্তু তারা একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাওয়ার মুহূর্ত নিয়ে আলোচনা করছিল, যেন নাটক শেষে স্ক্রিপ্ট নিয়ে মজা করছে।

রাইহানা চা খেতে খেতে মৃতদের কাজকর্ম দেখে। একবার সে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের বই ধরতেই ফ্রয়েড এসে রাইহানাকে জিজ্ঞেস করে—

খুকি, এত দিন পর আমাকে পড়তে মন চাইল?

আমি তো খুকি না, বুড়ি হয়ে যাচ্ছি রোজ।

হা হা করে হাসতে হাসতে ফের বলছে, আমিই তো ১৬৯ বছর বয়সী খোকা। 

তুমি কি মানুষের মন পড়তে পারতে? তোমার ‘টক থেরাপি’ কি কাজ করে আসলেই?

আমি তো এখনো পারি। না পারলে কি আর তুমি আমার বই ধরে দেখতে?

তা ঠিক। বলো তো আমি এখন কী ভাবছি?

এটা চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করো। আমাকে কেন করছো?

তুমি চ্যাটজিপিটিরও খবর রাখ?

বলেছি না আমরা দারুণভাবে জীবিত।

তাহলে বলো দেখি, আমি এত এত পুরুষ থাকতে সনককে কেন বিয়ে করতে গেলাম?

কারণ, তোমার আর ওর সেক্সুয়াল ফেটিশ এক।

ফ্রয়েডের সঙ্গে কথা বলা শেষ হতে না হতেই সামনে কার্ল গুস্তাভ ইউং হাজির।

শুরু হয়ে গেছে আমার বন্ধুর একরোখা আলাপ, সবখানে যৌনতাকেন্দ্রিক ভাইভ। ও সনককে বিয়ে করেছে জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে। তা ছাড়া সনক বাড়ির ডিজাইন করে, একজন ক্রিয়েটিভ ছেলে। একজন নারী নিরাপত্তার সিম্বল হিসেবে ঘর ভালোবাসে, সনক তার বাস্তব প্রতিফলন, তাই।

রাইহানার বুঝতে বাকি থাকে না, অল্প সময়ের ভেতরে এখানে তর্ক বাঁধতে যাচ্ছে।

তিন

রাইহানা, দু কাপ চা বানিয়ে সনকের সামনে এসে বসতেই সনক বলে ‘আজ আর অফিস যাচ্ছি না, বাসার নিচে কোমরপানি, গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকলে আবার গ্যারেজে নিতে হবে।’

তাই সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিল? 

একটা সেকেন্ডের জন্য দম নেয়নি।

রাইহানা সনকের দিকে চা এগিয়ে দিতেই খেয়াল করল সাদা চায়ের কাপে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাগ হয়ে আছে, লাভ বাইটের মতো। প্রতিদিন একই জায়গায় ঠোঁট ছুঁতে ছুঁতে একটা লুপ তৈরি হয়েছে কাপে। সনকের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, ওখানে কোনো লুপ তৈরি হয়নি। মানুষের ত্বকে স্মৃতি কতক্ষণ থাকে, মানুষ নিজেও জানে না। এমনকি মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই সব স্মৃতি আরও জীবন্ত হয়। রাইহানা জানে, কেউ কখনো মারা যায় না, মৃতরা আরও বেশি জীবিত এবং নিয়ন্ত্রক। 

সনক চায়ে চুমুক দিচ্ছিল আর মুঠোফোন স্ক্রল করছিল, যা রাইহানার একদম পছন্দ না। কিন্তু আচমকা সনক চিৎকার দিয়ে ওঠে এবং জোরে পড়তে থাকে, ‘পানিতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়লে বিদ্যুতায়িত হয়ে ৫ জন মানুষ…।’

গত রাতে তাদের এলাকায় এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছিল, আর তারা দিব্যি ঘুমাচ্ছিল, কিছুই জানতে পারেনি। সনক পুরো সংবাদ পড়ে শোনাল, তারপর চায়ে শেষ চুমুক দিতে দিতে বলল ‘দুঃখজনক’। 

রাইহানা পর্দা সরিয়ে দেখল বাইরে গাছের সতেজ পাতা, কিছু পাখির গা ঝাপটানো, রাস্তায় পানির ভেতর চলা রিকশার সর সর আওয়াজ, ভাতের হাঁড়ির ওলটানো তলার মতো আকাশের ফ্যাকাশে রং। কিছুটা দম নিয়ে, ফের ঝরবে, বোঝাই যাচ্ছে। 

প্রকৃতি বিড়াল স্বভাবের, মাছের কাঁটাসহ খেয়ে এমনভাবে ঘুমাবে, যেন কিছুই হয়নি। তার পেট ভরা, তো সব ভালো। 

রাইহানা নিজে সংবাদটি আবার পড়ল। রাস্তায় পানি জমে ছিল, মানুষ, গাড়ি রাস্তায় আসা–যাওয়া করছিল, ঠিক তখন রাস্তার ধারের দোকানের পাশে ঢোরা সাপের মতো নিরীহ একটা জীবন্ত বিদ্যুৎ তার ছিল, কেউ খেয়াল করেনি, পানিতে মিশতেই আশপাশে পাঁচজন মানুষ মুহূর্তে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায়। পাশেই মায়ের কোলে একটি শিশু ছিল, মা বুঝতে পেরে, শরীর নিস্তব্ধ হওয়ার আগেই কোলের বাচ্চাটিকে ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে, আর কয়েকজন মানুষ বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলে প্রাণে বেঁচে যায় শিশুটি। মা, ওই পাঁচজনের একজন আর জীবিত আছে তার শিশুটি। 

রাইহানার মনে হয়, এটাই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের খেলা, কেউ কাউকে বলে না কখন কীভাবে আর কী করতে হয়, কেবল হয়ে যায়, মানুষ করে ফেলে।

কল্পনায় বেঁচে যাওয়া বাচ্চাটির কথা স্মরণ করে শান্তি পায় রাইহানা। সেই সঙ্গে তার প্রশ্ন জাগে, এই বাড়ি আর এলাকা নিয়ে। এটাই প্রথম ঘটনা না। প্রতিবছর ঠিক আষাঢ় শ্রাবণে এই এলাকায় কোনো না কোনো অঘটন ঘটে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর মতো এর গল্পও তার অজানা। কিন্তু মাথায় লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, যা পাঁচ ইন্দ্রিয়ের বাইরে গিয়ে মানুষকে ঘর থেকে বের করে নেয়। তার মনে হতে থাকে সে নিজেই একটা ঘর, পাঁচ দেয়ালের। তার ভেতরটা চিৎকার করছে বেরোনোর জন্য, কিন্তু বেরোতে পারছে না। সে দ্রুত শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। গা থেকে ঝরতে থাকা পানির ফোঁটা দেখতে থাকে, ভেতরটা শির শির করে, মনে হয় শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল কিছু নেমে যাচ্ছে। সে চাইছে এই পানি তার ভেতরে ঢুকে যাক, কিন্তু পারছে না, কেবল ভিজছে তার বাহির। যেভাবে ভেজে এই বাড়ি বৃষ্টিতে।

চার

তুমি কীভাবে ঘর ছেড়েছিলে? আর পূর্ণিমাতেই কেন বের হয়েছিলে?

আমি তো ঘর ছাড়িনি, ঘরেই ফিরেছি, কপিলাবাস্তুতে। বাড়ির পুরুষেরা যেমন শাকসবজি কিনতে বের হয়, অফিস যায়, আমিও তাই করেছি।

রাইহানা সিদ্ধার্থের এমন কথায় হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে—

ঘরে কী নিয়ে ফিরলে, সবজি না মাছ?

আলো। রাহুল যখন আমার থেকে উত্তরাধিকারী চাইল, আমি তাকে আলো দিলাম। বোধ দিলাম।

ওটাই কি সেই পূর্ণিমা?

হ্যাঁ, মেটাফোরিক্যালি পূর্ণিমা অর্থ পূর্ণতা।

পূর্ণতার বিপরীত তো অপূর্ণতা। 

অপূর্ণতা আর অপূর্ণতা বোধ এক না। অপূর্ণতা উপলব্ধিতে পূর্ণ হয়। অমাবস্যায় চাঁদ নেই মানে, চাঁদ মরে গেছে এমন না, সে প্রস্তুত হয়। যখন পূর্ণ হয়, সব দেখা যায়।

রাইহানার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে, সে জানতে চায়, আমি তাহলে অপূর্ণ কেন?

অজ্ঞ, পাঁচ দেয়ালে বন্দী, তাই।

সিদ্ধার্থ মিলিয়ে যায়। দেখতে নিতান্তই সাধারণ মানুষের মতো। অবশ্য সব মৃতরাই সাধারণ মানুষ। জীবিতরা পদবির ভারে অসাধারণ ক্লাউন সেজে থাকে। তাদের সঙ্গে বসা যায় না।

বইঘরে ঠিক তক্ষুনি কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এসে হাজির। রাইহানার মাথায় হাত রেখে বলে—

তুমি যা জানতে চাও, তা কেন জানতে চাও, আগে সেটা জানো।

রাইহানা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে, জীবনে বহু সুযোগ এসছিল তার এ বাসা থেকে বেরোনোর। কিন্তু পারেনি। কোনো না কোনো অজুহাতে থেকে গেছে, হয়তো স্কুলটা কাছে, কলেজটা কাছে কিংবা মা–বাবার সঙ্গে থাকার আনন্দ অথবা অন্য কিছু। সনক নিজেও এখানে থাকে। শুধু সনক না, এ বাসায় একবার যে থাকতে শুরু করে মৃত্যুর আগমুহূর্ত অবধি আর বের হয় না। সনকের সঙ্গে সে–ও উত্তরায় ছিল কিছুদিন। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারেনি। এমনকি দেশের বাইরে গিয়েছিল ঘুরতে, একদম মন টেকেনি। যে মাত্র ফ্লাইট বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করল, পরম শান্তি পেল সে। এভাবেই থেকে গেল। সবাই কোনো না কোনোভাবে থেকে যায়, এই বাড়িতে। ফ্ল্যটের বাকি সদস্যরাও একই কথা বলে। রাইহানা এবার ধীরেই তার সত্যিকারের ভয়ের ভেতর ঢুকতে পারে। রাইহানার আচমকা মনে হয়, ওরা সবাই মৃত। তার গা হিম হয়ে যায়। 

দ্রুত ছুটে যায় বাড়ির দারোয়ানের কাছে। দেখে, গেটের সামনে টুলে বসে মুঠোফোন স্ক্রলিং করছে।

সিরাজ!

জি ম্যাডাম! উঠে দাঁড়ায় গেটম্যান।

দোকান থেকে কিছু পেঁয়াজ আনতে হবে। 

রাইহানা, তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে দেখে, লোকটি কমান্ড ফলো করছে, মানে জীবিত। তার মনে হতে থাকে হাতের মুঠোফোনটিও কমান্ড ফলো করে। এটিও জীবিত। দ্রুত নিজের শোবার ঘরে ছুটে আসে, সুইচ অন করতেই সিলিং ফ্যান ঘুরতে থাকে। বিছানায় নিজের শরীর তার স্বামীর শার্টের মতো ছুড়ে ফেলে জিরাতে চায়। রিমোট টিপে এসি অন করে আবার অফ করে। 

এরা সবাই কমান্ড ফলো করে। সবাই জীবিত। কিন্তু সবাই আটক, অধীন অর্থাৎ সবাই মৃত। তার চোখের সামনে ব্লার হয়ে যেতে থাকে জীবিত আর মৃতের ধারণা।

পাঁচ

একদিন সনক খেয়াল করে, তার টেবিলে রাখা প্রিয় ক্যাকটাসগাছ আর টেবিলে নেই, সেখানে আছে দেড় শ বছর বয়সী বনসাই। ড্রেসিং টেবিল সরিয়ে খাট থেকে দূরে রাখা। এ রকম ঘরের আরও ছোট ছোট পরিবর্তন সনকের চোখে পড়ল। কিন্তু সবচেয়ে অবাক হলো তার নতুন করা বাড়ির ডিজাইনে রাইহানার কিছু আঁকিবুঁকি দেখে।

কী এঁকেছ এখানে?

অনেকগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ। 

সনক বিরক্ত হয়েই জানতে চায়, মানুষ হাত দেখে ভবিষ্যৎ দেখে শুনেছি, আর তুমি বাড়ির নকশা দেখে ভবিষ্যৎ দেখছো?

বাড়ি তথা ভূমির অতীত আর ভবিষ্যতের সঙ্গেই তো জড়িত মানুষের ভবিষ্যৎ।

নিশ্চয়ই তোমার মৃতরা তোমাকে বলেছে এসব।

না, ওরা বলেনি।

রাইহানা, সনকের থেকে একটু সহনশীল আচরণ প্রত্যাশা করেছিল।

আচ্ছা, তোমরা যে এত বাড়ি বানাও, কোন বিষয়টা মাথায় রেখে বানাও?

অনেক কিছুই, সেমন ক্লাইন্টের চাহিদা, সাইট অ্যানালাইসিস, স্পেস প্ল্যানিং। তুমি এত সব বুঝবে না।

রাইহানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানতে চায় ‘কিন্তু ভূমির ইচ্ছা।’

ভূমির আবার ইচ্ছা কী?

রাইহানা বলতে শুরু করে সনকের কথার জবাব না দিয়ে।

বহু আগে, সময়টা অনুমেয় না, রাই নামে একটি মেয়েশিশু জন্মায়, রানির গর্ভে। মেয়েটির জন্মের তিন–চার বছর পরে রাইকে ঘিরে সবার সন্দেহ হয়। আর্য বংশীয় রাজপরিবারে কীভাবে অনার্য সন্তান জন্ম নেয়? গুঞ্জন রাজবাড়ি থেকে রাজ্যে ছড়াতে সময় নেয় না।

রাজা কিংবা রানি কারোর চেহারার সঙ্গে রাইয়ের চেহারার মিল ছিল না। রাই দেখতে শ্যামলা, চুল ঘন এবং শামুকের মতো প্যাঁচানো, ঠোঁট অল্প পুরু, যেখানে রাজা আর রানি দেখতে ছিল ফর্সা, লম্বা, খাড়া নাক। রাই যত বড় হতে থাকে, মা–বাবার সঙ্গে চেহারার পার্থক্য রাজাকে তত বিব্রত করতে থাকে। রানিকে ঘিরে সন্দেহ, রাজ্যে রাজার প্রভাব কমাতে থাকে। রাজদরবার থেকে রাজাকে রানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেওয়া হয়। অবশেষে রাজা সিদ্ধান্ত নেয়, রানিকে শুদ্ধিপরীক্ষা দিতে হবে। 

রাইহানা একটু দম নিল। সনক খেয়াল করে গল্পটা বলার সময় রাইহানাকে চঞ্চল, প্রাণবন্ত না বরং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।

‘পানি খাও’ বলেই সনক কাচের গ্লাসে পানি ঢেলে ওর দিকে এগিয়ে দেয়।

রাইহানা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে তলানির দিকে তাকায়, ভেতরের ছোট ছোট বুদ্‌বুদগুলো শান্ত হয় একসময়।

‘পানিও স্থির হয়, এমনকি মারা যায়।’ বলেই রাইহানা তার গল্পে ফিরে যায়—  

ওই রাজ্যে একটা নদী ছিল। নদীকে সবাই দেবী ভাবত। আত্মশুদ্ধির দেবী। বর্ষাকালে নদীর রূপ হতো ভয়ংকর। নদীর ঠিক মাঝখানের দিকে ত্রিমুখী স্রোতের কারণে একটা কুণ্ডলী তৈরি হতো। লোকে ভাবত দেবীর নাভি। ওখানে পড়ে যাওয়া, মানুষ, পশু, গাছ, নৌকা কিছুই বাঁচতে পারে না।

‘ট্রাই অ্যাঙ্গেল স্রোত’ সনক বলে।

হবে হয়তো। তবে ওই রাজ্য অপরাধীকে ধরে কুণ্ডলীতে ফেলে দেওয়া হতো। তারা মনে করত যদি কেউ প্রকৃত অপরাধী না হয়ে থাকে দেবীর আশীর্বাদে আবার ফিরবে। আর যদি না–ও ফেরে, শুদ্ধ হয়ে স্বর্গে যাবে। এবং যে ফিরবে, সে হবে দেবগুণে গুণান্বিত, সাধু। কিন্তু কেউই সেখান থেকে জীবিত ফেরেনি। স্বাভাবিক। 

রাজ্যের কল্যাণের জন্য, পরিবারের স্বার্থে রাজা রানিকে ওই কুণ্ডলীতে নিক্ষেপ করতে প্রস্তুত হয়।

আহা, তখন যদি ডিএনএ টেস্টের একটা ব্যবস্থা থাকত। বেচারি রানি! তারপর কী হলো? সনক জানতে চায়— 

রানি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে স্বামীর কথামতো জলকুণ্ডলীতে প্রবেশ কর। সাত বছরের রাই এত কিছু না বুঝলেও, তাকে ঘিরেই যে সব হচ্ছে, বুঝতে পারে। রাজকুমারী হয়েও শৈশব বলে কিছু ছিল না। চুপচাপ এক কোণে বসে থাকত। জন্মের ভেতর দিয়েই সে অপরাধী। 

রানি কুণ্ডলীতে প্রবেশ করার আগে একবারও রাজার দিকে তাকায়নি; তবে রাইকে বলেছিল, ‘বেঁচে থাকিস।’ গ্রামবাসী দারুণ খুশি। রাজাকে তারা ন্যায়ের প্রতীক মানতে শুরু করে। কেউ কেউ ভাবে রানি ফিরবে। অনার্যরা রাইকে তাদের জন্য পাঠানো দূত ভাবতে থাকে।

কাহিনিটা একরকম সীতার অগ্নিপরীক্ষা হয়ে গেল না?

অনেকটাই, পার্থক্য আগুনের জায়গায় পানি। বোধ, বিষয় এক।

রানি পাস করতে পারল?

না, আট দিন পর রানির মৃতদেহ রাজ্যে ফেরত আসে। অর্থাৎ সবার মনে হতে থাকে রানিই দোষী। রাই রাজার সন্তান না। কোনো এক অনার্য দাসের সন্তান। আর রানি অসতী। রাইয়ের প্রতি অনার্যদের স্নেহ ছিল আর আর্যদের ঘৃণা। রাজদরবারে রাজার ভাবমূর্তি যেন নষ্ট না হয়, সে চিন্তা করে, রাজা অমাত্যদের কথামতো রাইকেও পানি কুণ্ডলীতে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একজন অনার্য কৃষক এর প্রতিবাদ করেছিল ‘শিশু হত্যা মহাপাপ। রাইকে আমাদের দিয়ে দিন।’

কিন্তু কিছুই রাজাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে পারল না। সে রাইকে পানি কুণ্ডলীতে ফেলে দেয়। আর রাই চিৎকার করে বলছিল, ‘মা আমাকে বাঁচতে বলেছিল’ মিনিটের মধ্যেই রাই তলিয়ে যায়। একসময় বর্ষা থেমে যায়। নদী শান্ত হয়। রাজা নতুন বিয়ে করে। অনার্যরা অসন্তোষ নিয়েই কাজ করতে থাকে। তবে একটা অনার্য বাচ্চা ছেলে রোজ নদীতে রাইয়ের নামে ফুল দিত।

কী ফুল?

হলুদ কুমড়ো ফুল।

ভাগ্যিস গোলাপ দেয়নি। ছেলে বুদ্ধিমান, সেই ফুল দিয়েছে যে ফুলে ফল হয়।

রাইহানা সনকের কথায় কান না দিয়ে বলতে থাকে— 

নেক্সট বছর এত বেশি বন্য হয় যে পুরো রাজ্য ভেসে যায়। রাজার রাজ্য তলিয়ে যায়। আর্য অনার্য সবাই বিলীন হয়ে যায়। পুরো গ্রাম হয়ে যায় বিশাল নদী। তারপর বছরের পর বছর নদীটা বেঁচে ছিল। নদীকে ঘিরে নতুন সভ্যতা। এর ভেতর পৃথিবী আরও ম্যাচিউর হলো। নদী শাসন শুরু হলো। নদীগুলো গল্পের মতো, রাইয়ের মতো নাই হয়ে গেল। মাটি দিয়ে সব নদী কবর দেওয়া হলো। তার ওপর গজালো বড় বড় বিল্ডিং, সভ্যতা… 

রাইহানা একদম চুপ হয়ে গেল, যেন পাথরের মূর্তি। তারপর বিছানা থেকে উঠে দেয়ালে টাঙানো একটা নদীর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা সবকিছু মেরে ফেলি। তারপর ছবি বানিয়ে ঘরে টাঙিয়ে রাখি। এটাই আমরা।

সনক তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রাখে।

আমরা যে বাড়িটায় আছি, এটা সেই কুণ্ডলী। এই এলাকাটা ওই নদী ছিল।

সনক মুহূর্তে ভীত চোখে রাইহানার দিকে তাকায় ‘তুমি জানো কীভাবে?’ 

রাইহানা সনকের টেবিলে রাখা বনসাইয়ের কাছে গিয়ে শিকড়ে হাত রাখে—

গাছেরা সব জানে, মনে রাখে। কোনো গল্পই মরে না। যেমন কোনো মানুষ মরে না। কেবল রাই থেকে রাইহানা হয়ে যায়।