
প্রাচীন ইনকাদের কবিতা আর গান কেবল শব্দ আর সুরের সমষ্টি ছিল না। তা ছিল এক সভ্যতার আত্মজীবনী, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, ঐতিহাসিক স্মৃতি, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান আর দৈনন্দিন সংগ্রামের জীবন্ত দলিল। বাংলায় অনুবাদ করেছেন চন্দন চৌধুরী
অনেক আগের কথা, যখন আন্দিজ পর্বতমালার চূড়ায় সূর্যদেবতা ইন্তি (Inti) তাঁর সোনালি আলো ছড়াতেন আর চাঁদ দেবী মামাকুইল্লা স্নিগ্ধ কিরণে ঢেকে দিত উপত্যকা। সে এক প্রাচীন সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা। তারা কেবল বিশাল পাথরের শহরই গড়েনি, গড়েছিল এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জগৎ, যেখানে কবিতা আর গান ছিল তাদের প্রাণের স্পন্দন। এ শুধু বিনোদন ছিল না, ছিল জীবনের প্রতি ছত্রে মিশে থাকা এক পবিত্র অনুভব, তাদের ইতিহাস, বিশ্বাস আর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। চলুন, সেই ইনকাদের গল্প শুনি, তাদের সুর আর ছন্দের গভীরে ডুব দিই।
ইনকা সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল আনুমানিক ১৩ শতাব্দীতে এবং স্প্যানিশ বিজয়ের পূর্বে ১৬ শতকে এসে এটি দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। ইনকা সাম্রাজ্য ছিল বিশাল, যেন চারটি অঞ্চল মিলে তৈরি এক সুতোয় বাঁধা মহাদেশ। আজকের পেরু, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, চিলি আর আর্জেন্টিনার কিছু অংশজুড়ে ছড়িয়ে ছিল তাদের রাজত্ব আর তার প্রাণকেন্দ্র ছিল সুন্দর শহর কুসকো। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, এত বড় এক সাম্রাজ্যের কোনো লিখিত ভাষা ছিল না! তাদের সব গল্প, সব জ্ঞান, সব কবিতা আর গান বেঁচে থাকত কেবল মুখের কথায়।
বিশেষ কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁদের বলা হতো আমাউতা (Amauta)—মানে জ্ঞানী পণ্ডিত। তাঁদের কাজ ছিল এই মৌখিক সাহিত্যকে স্মৃতিতে ধরে রাখা আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়া। তাঁরা যেন ছিলেন জীবন্ত কুইপু (কুইপু ছিল গাঁটযুক্ত সুতার এক জটিল বিন্যাস, যেখানে অতীতের ঘটনাপঞ্জি, বংশতালিকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এমনকি কবিতা পর্যন্ত রেকর্ড করা থাকত), স্মৃতির গ্রন্থি দিয়ে বাঁধা এক একটি গল্প। তাঁদের গাওয়া হায়লি (Haylli) ছিল বিজয়ের আনন্দগান, হারাউই (Harawi) ছিল প্রেম আর বেদনার গভীর সুর আর আরাভি (Arawi) ছিল ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ। এই গানগুলো কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানে নয়, কৃষিকাজের সময়, উৎসবের দিনে, এমনকি সাধারণ দিনের অবসরেও বেজে উঠত আন্দিজের বাতাসে।
ইনকাদের জীবনে ধর্ম ছিল এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের কবিতা আর গানের এক বড় অংশই ছিল দেবতাদের উৎসর্গ করা। এই পবিত্র স্তোত্রগুলোকে তারা বলত জাইয়িস (Jaillis)। ভোরে সূর্য উঠলে বা সন্ধ্যায় ডুবে গেলে ইনকা পুরোহিতেরা সুর করে জাইয়িস গাইতেন। তাদের প্রার্থনা ছিল সৃষ্টিকর্তা উইরাকোচা (Wiracocha), সূর্যদেবতা ইন্তি, বজ্রদেবতা ইল্লাপা (Illapa), পৃথিবী মাতা পাচামামা (Pachamama) আর চন্দ্রদেবী মামাকুইল্লার (Mamaquilla) উদ্দেশে। তারা কেবল সূর্যকে উপাসনা করত না, উইরাকোচা ছিলেন তাদের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে, এক অদৃশ্য সত্তা, যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সূর্য ছিল তাঁর এক দৃশ্যমান রূপ মাত্র।
পাচাকুটেক, ইনকাদের সবচেয়ে মহান সম্রাটদের একজন, তিনিও ছিলেন এক কবি। তাঁর ১১টি পবিত্র স্তোত্র ছিল সেই জাইয়িসের অংশ, যা সিতুয়া রাইমি (Situa Raymi) নামের এক বসন্তকালীন শুদ্ধিকরণ উৎসবে গাওয়া হতো। ভাবুন তো, বসন্তের প্রথম অমাবস্যায়, নতুন করে জীবন শুরু করার আগে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি শহর কুসকোতে যখন এই পবিত্র সুর বেজে উঠত, কেমন এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি হতো! এসব গানে কেবল দেবতাদের প্রশংসা ছিল না, ছিল মানবজাতির কল্যাণ, সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি আর রোগমুক্তি কামনা। জেসুস লারা নামের একজন কেচুয়া পণ্ডিত তো এই জাইয়িসগুলোকে বিশ্বের মহান কবিতার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর মতে, এই স্তোত্রগুলো ইনকাদের আধ্যাত্মিকতার উচ্চ স্তরকে প্রকাশ করে।
শুধু দেবতাই নয়, ইনকাদের বীরযোদ্ধাদের নিয়েও জাইয়িস রচিত হতো। যদিও দুঃখের বিষয়, সেই বীরত্বপূর্ণ জাইয়িসগুলোর বেশির ভাগই সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে। তবে কিছু কৃষিবিষয়ক জাইয়িস এখনো টিকে আছে, যা ফসলের বীজ বোনার সময় বা ফসল কাটার মৌসুমে কৃষকেরা সম্মিলিতভাবে গাইত। এই গানগুলো কেবল খেতখামারে শক্তি জোগাত না, মনে করিয়ে দিত যে তাদের শ্রমই সাম্রাজ্যের ভান্ডার পূর্ণ করছে, যা খারাপ সময়ে সবার কাজে আসবে।
ইনকাদের ভাষা ছিল কেচুয়া (Quechua), যাকে তারা বলত রুনাসিমি (Runasimi), যার মানে ‘মানুষের মুখ’। এ এক অসাধারণ ভাষা, যা ছোট ছোট শব্দাংশজুড়ে বড় আর অর্থপূর্ণ শব্দ তৈরি করতে পারত। কেচুয়া ক্রিয়াপদে ছোট্ট একটি কণা যোগ করেই তারা মনের অসংখ্য সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশ করতে পারত। এই ভাষায় অনেক প্রতিশব্দ ছিল, আর ছিল নানা ধ্বন্যাত্মক শব্দ, যা শুনলেই মনের মধ্যে ছবি আঁকা যেত।
ইনকা কবিরা, যাঁদের আরাউইকুজ (Arawikujs) বলা হতো, তাঁরা তাঁদের কবিতায় কৃত্রিমতা পছন্দ করতেন না। তাঁদের কাছে ছন্দ বা মাত্রার চেয়েও বেশি জরুরি ছিল অর্থ আর কাব্যিক অনুভূতির গভীরতা। তাঁদের গান ছিল স্বাধীন, নমনীয়। প্রতিটি লাইনের অক্ষর সংখ্যা আলাদা হতো, কখনো পাঁচ-ছয়টি, কখনো আটটি। ছন্দ আর অনুপ্রাস থাকলেও তা অপরিহার্য ছিল না। কেচুয়া ভাষায় অনেক শব্দের শেষ অক্ষর একই রকম হওয়ায় ছন্দহীন পদ্যও (ব্ল্যাঙ্ক ভার্স) বেশ প্রচলিত ছিল। এই ভাষার প্রতিটি বাক্যে যেন মিশে থাকত প্রকৃতির ছন্দ, জীবনযাত্রার সরলতা।
ইনকা সাম্রাজ্যের বেশ কয়েকজন সম্রাট নিজেও ছিলেন কবি। ইনকা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মানকো কাপাক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট পাচাকুটেক ইনকা ইউপানকুই—উভয়ই তাঁদের কবিতার জন্য পরিচিত ছিলেন। মানকোর তিনটি জাইয়িস এখনো টিকে আছে। এই কবিতাগুলো ছিল প্রার্থনা, যেখানে দেবতারা মানুষের মঙ্গল কামনা করতেন।
পাচাকুটেকের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তাঁর রচিত স্তোত্রগুলো সিতুয়া উৎসবে গাওয়া হতো। তার প্রজ্ঞা শুধু কবিতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর রচিত প্রবাদ ও আইন আজও তাঁর দূরদর্শিতার প্রমাণ দেয়। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যের ভালো জিনিসকে হিংসা করে, সে নিজের জন্য তা থেকে খারাপ কিছু লাভ করে, ঠিক যেমন মাকড়সা ফুল থেকে বিষ আহরণ করে।’ তাঁর এই প্রবাদগুলো যেন জীবনের কঠিন সত্যগুলোকে সহজ করে তুলে ধরেছিল। এমনকি তাঁর মৃত্যুশয্যায়ও তিনি কবিতা রচনা করেছিলেন, যা তাঁর জীবনের শেষ কথা, এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধির প্রকাশ।
আরাউইকুজরা কেবল ধর্ম বা রাজার জয়গান গাইতেন না। তাঁদের কবিতায় উঠে আসত প্রেম, জীবনের টানাপোড়েন, আধ্যাত্মিকতা, রাজনীতি, এমনকি মাটির প্রতি শ্রদ্ধা ও দৈনন্দিন শ্রমের মর্যাদার কথা। তাঁদের বেশির ভাগ কাজ বেনামি থাকলেও, সম্রাট-কবিদের সৃষ্টিকর্ম আজও তাঁদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইনকাদের সংগীতজগৎ ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাঁদের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ছিল ড্রাম, ওকারিনা, ট্যাম্বুরিন, ঘণ্টা, ট্রাম্পেট (যা শঙ্খ, লাউ, সিরামিক বা কাঠ দিয়ে তৈরি হতো) এবং নর্তকদের পায়ে পরা শিমের খোসার নূপুর। কুজকোতে যখন জাইয়িস গাওয়া হতো, তখন একদল মহিলা মূল্যবান পাথর বসানো সোনালি ড্রাম বাজাতেন। তাঁদের সংগীত ছিল যেন স্বর্ণালি সুরের ঝরনাধারা।
আজকের আন্দিয়ান সংগীত, যা আমরা শুনি, তার মূল রয়েছে ইনকাদের সময়ের সংগীতে। বাঁশি, যা একটি পঞ্চস্বর স্কেলে, একটি মাইনর কি-তে বাজানো হয়, সেই সুর আজও আন্দিজের পাহাড়ে পাহাড়ে অনুরণিত হয়, তার স্বতন্ত্র শব্দে ভরা থাকে এক গভীর বিষাদ আর আনন্দ। এই সংগীত ছিল ইনকাদের আনন্দ-বেদনার নিত্যসঙ্গী।
ইনকাদের লেখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু তাদের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে তারা খুব যত্নে সংরক্ষণ করত। এই অসাধারণ পদ্ধতিটির নাম ছিল কুইপু (Quipu)। কুইপু ছিল গাঁটযুক্ত সুতার এক জটিল বিন্যাস, যেখানে অতীতের ঘটনাপঞ্জি, বংশতালিকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এমনকি কবিতা পর্যন্ত রেকর্ড করা থাকত। কুইপুকামাইওক (Quipucamayocs) নামের একদল বিশেষজ্ঞ এই গাঁটগুলো পড়ে ইতিহাস পাঠ করতেন। তাঁরা ছিলেন যেন চলন্ত লাইব্রেরি।
দুঃখের বিষয়, স্প্যানিশ বিজয়ীরা আসার পর অধিকাংশ কুইপু ধ্বংস হয়ে যায়। যে কয়েকটি টিকে আছে, সেগুলোর জটিলতা আজও সম্পূর্ণভাবে বোঝা যায় না। কুইপুকামাইওকদের বিশেষ জ্ঞান তাঁদের সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়েছে। তবু এই কুইপুগুলো ইনকাদের জ্ঞান সংরক্ষণের এক বিস্ময়কর প্রমাণ।
ইনকাদের জীবনে সিতুয়া রাইমি, বা ‘উজ্জ্বল উৎসব’, ছিল এক বিশেষ দিন। বসন্তকালে, প্রথম অমাবস্যায় এই শুদ্ধিকরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। এই সময়টা ছিল কোয়া-রাইমি (Coya-Raymi) মাসের, অর্থাৎ চন্দ্রদেবী মামাকুইল্লার মাস। এই সময়েই বর্ষা শুরু হতো আর রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ত। সম্রাট পাচাকুটেক এই উৎসব শুরু করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা উইরাকোচা আর অন্যান্য দেব-দেবীকে ধন্যবাদ জানাতে, যেন তাঁরা মানুষকে রোগমুক্ত রাখেন।
এই উৎসবে বিশেষ একধরনের রুটি তৈরি করা হতো, যার নাম সাঁকু (Sancu)। এতে মেশানো হতো পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সী শিশুর কপালে ফুটো করে বের করা কয়েক ফোঁটা রক্ত। অসুস্থ মানুষ আর বিদেশিদের শহর ছেড়ে যেতে হতো, আর কুকুরদেরও শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো, যেন কোনো অপবিত্রতা উৎসবের পবিত্রতা নষ্ট না করে।
উৎসব শুরু হতো সূর্যমন্দিরের সামনে চার শ সশস্ত্র পুরুষের সমাগমে। তারা চিৎকার করে বলত, ‘ওহে অসুস্থতা, দুর্যোগ, দুর্ভাগ্য এবং বিপদ, এই ভূমি ছেড়ে যাও!’ এই মন্ত্র ধ্বনি–প্রতিধ্বনিত হতে হতে সাম্রাজ্যের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। তারপর সবাই কুসকোতে ফিরে আসত আর শুরু হতো সংগীত আর নৃত্য। সম্রাট থেকে শুরু করে সবাই নাচত, নদীতে স্নান করত। রাতে তারা মশাল জ্বালাত আর আকাশ লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ত, যেন সব মন্দ দূর হয়ে যায়।
পরের দিন ছিল ভোজের দিন আর সবাই চিচা (একধরনের ভুট্টার বিয়ার) পান করত। সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তিটিও উৎসবে অংশ নিত। এই দিনে, আলানসিতুয়া সাকি (Alansitua Saki) নামের একটি গান গেয়ে নাচত সবাই। এই গান ছিল সৃষ্টিকর্তা, সূর্য আর বজ্রকে সুরক্ষার জন্য ধন্যবাদ জানানোর আর আরও একটি সুস্থ বছরের প্রার্থনার।
লামা বলিদান আর ইয়াহুয়ার-সাঁকু (Yahuar-sancu) বা রক্তমিশ্রিত সাঁকু গ্রহণ ছিল এই উৎসবের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুরোহিতেরা বলতেন, যারা নিষ্পাপ হৃদয়ে এই সাঁকু গ্রহণ করবে, সূর্য তাদের পুরস্কৃত করবেন, সন্তান আর সুখী বছর দেবেন। এই উৎসবে গাওয়া ১২টি জাইয়িস স্তোত্র ইনকাদের গভীর বিশ্বাস আর প্রকৃতির সঙ্গে তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে তুলে ধরত।
প্রাচীন ইনকাদের কবিতা আর গান কেবল শব্দ আর সুরের সমষ্টি ছিল না। তা ছিল এক সভ্যতার আত্মজীবনী, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, ঐতিহাসিক স্মৃতি, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান আর দৈনন্দিন সংগ্রামের জীবন্ত দলিল। জাইয়িসের গভীর আধ্যাত্মিকতা, কেচুয়া ভাষার সাবলীল কাব্যিকতা আর বৈচিত্র্যময় গান ও নৃত্যের রূপ ইনকা সংস্কৃতির এক অসাধারণ চিত্র তুলে ধরে।
আজ স্প্যানিশ বিজয়ের পর ইনকাদের অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের কিছু গল্প, কিছু গান, কিছু কবিতা আজও আন্দিজের বাতাসে বেজে ওঠে। সেই সুর আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্মৃতির মর্যাদা, সংস্কৃতির দৃঢ়তা আর আত্মার অমরতা। প্রাচীন ইনকাদের কবিতা আর গান যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা রয়েছে, যা মানব ইতিহাসের এই বিস্ময়কর অধ্যায়টিকে আজও আমাদের সামনে জীবন্ত করে তোলে।
সম্রাট পাচাকুটেকের রচিত স্তোত্র:
হে স্রষ্টা, সবকিছুর মূল,
অশেষ উইরাকোচা,
উজ্জ্বল বসনধারী প্রভু
তুমি প্রাণ সঞ্চার করো এবং সবকিছু সুবিন্যস্ত করো,
তুমি বলো, ‘পুরুষ হোক! নারী হোক!’
গঠনকর্তা, নির্মাণকর্তা,
তুমি সবকিছুকে জীবন দিয়েছ:
তাদের রক্ষা করো,
তাদের জীবন করো সমৃদ্ধ, সৌভাগ্যময়,
নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ।
তুমি কোথায়?
বাইরে? ভেতরে?
এই পৃথিবীর ওপরে মেঘেদের মাঝে?
এই পৃথিবীর নিচে ছায়াদের মাঝে?
আমার কথা শোনো!
আমাকে উত্তর দাও!
হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করো আমার প্রার্থনা!
যুগ যুগ ধরে
আমাকে বাঁচতে দাও,
আমাকে তোমার বাহুতে জড়াও,
তোমার হাতে ধারণ করো,
এই অর্ঘ্য গ্রহণ করো
তুমি যেখানেই থাকো না কেন, হে আমার প্রভু,
হে আমার উইরাকোচা।
হে স্রষ্টা,
হে হ্রদের প্রভু,
উইরাকোচা, সবকিছুর জোগানদাতা,
কর্মঠ উইরাকোচা,
উজ্জ্বল পোশাকে ভূষিত:
পুরুষকে সুখে বাঁচতে দাও,
নারীকেও শান্তিতে থাকতে দাও,
মানুষের বংশবৃদ্ধি হোক,
তাদের জীবন হোক আশীর্বাদপূর্ণ ও সমৃদ্ধ।
তুমি যাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছ
তাদের রক্ষা করো
যুগ যুগ ধরে,
ধারণ করো তোমার হাতে।
সৃষ্টিকর্তা, সবকিছুর শেষ
সবকিছুর শুরু
হ্রদের প্রভু
সক্রিয়, উদ্যোগী উইরাকোচা,
পর্বতের প্রভু
প্রার্থনার প্রভু
অনুষ্ঠানের প্রভু
অসীমের প্রভু,
সৃষ্টিকর্তা, সবকিছুর শেষ,
যে পুরস্কৃত করে ও দান করে:
সব সম্প্রদায় ও মানুষেরা মঙ্গল হোক
এবং যারা বাইরে বা ভেতরে যাত্রা করে, তাদেরও।
হে প্রভু,
ভাগ্যবান, সুখী, বিজয়ী উইরাকোচা,
মানুষের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়:
তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তোমার সেবক ও দরিদ্ররা,
যাদের জীবন দিয়েছ আর নিজ নিজ স্থানে স্থাপন করেছ:
তারা যেন সুখী ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়
তাদের সন্তান ও বংশধরদের সাথে;
তারা যেন কোনো গোপন বিপদে না পড়ে
নির্জন পথে;
তারা যেন দীর্ঘজীবী হয়
কোনো দুর্বলতা বা ক্ষতি ছাড়াই,
তারা যেন আহার করে, তারা যেন পান করে।
..... .....
হে আমার প্রভু,
আমার স্রষ্টা, সবকিছুর উৎস,
পরিশ্রমী কর্মী
যে সবকিছুর মধ্যে জীবন ও শৃঙ্খলা তৈরি করো,
যে বলে, ‘তারা আহার করুক,
তারা এই পৃথিবীতে পান করুক:’
আলু ও ভুট্টা বৃদ্ধি করো,
সব খাদ্য বাড়ুক—
যাদের তুমি জীবন দিয়েছ,
যাদের প্রতিষ্ঠিত করেছ।
তুমি যে আদেশ করো,
যে তোমার আদেশ পূরণ করে,
তাদের সংখ্যা বাড়াও।
যাতে মানুষ কষ্ট না পায়,
আর কষ্ট না পেয়ে তোমার ওপর বিশ্বাস রাখে।
তুষারপাত না হোক
শিলাবৃষ্টি না হোক,
সবকিছু শান্তিতে রক্ষা করো।
হে প্রভু উইরাকোচা,
তুমি বলো,
‘দিন হোক, রাত হোক!’
তুমি বলো,
‘ভোর হোক, আলো ছড়িয়ে পড়ুক!’
তুমি সূর্যকে, তোমার পুত্রকে,
প্রতিদিন আনন্দে ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়ে চলতে বলো,
যাতে তোমার সৃষ্ট মানুষ আলো পায়:
আমার প্রভু উইরাকোচা,
তোমার ইনকা জাতির ওপর আলোকবর্ষণ করো,
আপনার সেবকদের আলোকিত করো,
তুমি যাদের পথ দেখিয়েছ,
তাদের বাঁচিয়ে রাখো
সুখী ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত করে
তাদের রক্ষা করো
শান্তিতে,
রোগমুক্ত, ব্যথামুক্ত।