
আমাদের স্কুল বেদখল হয়ে গেছে। মিলিটারি এখানে ক্যাম্প বানিয়েছে। তাদের অত্যাচারে গ্রামবাসীর অবস্থা খারাপ। স্কুলের মাঠে কোনো গরু-ছাগল চরতে পারে না। মিলিটারিরা ধরে ধরে জবাই করে রান্না করে খায়। ভয়ে আর কোনো গরু-ছাগলও স্কুলের আশপাশে আসে না। মিলিটারি দেখলে গরু-ছাগলও পালিয়ে যায়। তাতেই তারা মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে না। তারা গ্রামের মধ্যে ঢোকে। গৃহস্থের বাড়ি থেকে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে চলে যায়। এমনিতেই পুরো গ্রামে বুড়ো মানুষ আর শিশু ছাড়া আর কেউ নেই। যুবক বয়সী নারী-পুরুষ সব নদীর ওপারে চলে গেছেন।
আমার নাম বাবুল। আমি পড়ি ক্লাস ফাইভে। আমি আমাদের বাড়িতে রয়ে গেছি। এর কারণ, আমার দাদা চোখে দেখেন না। আমিই আমার দাদার লাঠি। তাঁকে নিয়ে চলতে-ফিরতে হয় আমাকেই। দাদা বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারেননি। দাদিও পারেননি। আমার আব্বা-আম্মা আমাদের নানাবাড়িতে চলে গেছেন। নানাবাড়ি এখান থেকে ১৪ মাইল দূরে। সেখানে যেতে দুইটা নদী পার হতে হয়। পাকিস্তানি মিলিটারিরা নদী খুব ভয় পায়।
তারা নাকি গোসলও করে না। এই জন্য কোনো পাকিস্তানি মিলিটারি যেখান দিয়ে যায়, সেখানকার বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, আধা মাইল দূর থেকেও মানুষ বুঝতে পারে, ওই যে পাকিস্তানি মিলিটারি আইল।
গ্রামে যুবক বয়সী কেউ নেই, তাই তারা বৃদ্ধদেরও ধরে ধরে আনে। মিলিটারি আর রাজাকাররা তাদের ওপর অত্যাচার করে। টাকাপয়সা আদায় করে। আর কারও ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে শুনলে তো কথাই নেই। তাঁর বাড়ির সবকিছু লুট করে। আর আসার সময় বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
হঠাৎ গুলির শব্দ। বেলা তিনটা। আমি আমাদের রাখাল ছেলে রাজার সঙ্গে ঘরের পেছনে বসে ১৬ ঘুঁটি খেলছিলাম। শব্দ শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমরা মাটিতে শুয়ে পড়লাম। এসব নিয়ম এখন সবাই জানে। গোলাগুলির সময় মাটিতে শুয়ে পড়তে হয়। গুলি তাহলে মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে।
ভয় ভয় লাগছে। এই দিনে দুপুরে আবার গোলাগুলি কেন!
আমাদের স্কুলের পুকুরে রোজ একটা-দুটো করে মানুষ ফেলে দেওয়া হয়। এসব খবর আমার অন্ধ দাদাও জানেন। পাশের বাড়ির ল্যাংড়া দাদু বলেন। আমি দাদাকে নিয়ে পাশের বাড়ির খানকা ঘরে যাই। ল্যাংড়া দাদু হাঁটতে পারেন না। কিন্তু দুনিয়ার খবর থাকে তাঁর কাছে।
আজ হঠাৎ গোলাগুলি কেন!
সন্ধ্যা নাগাদ সব স্তব্ধ হয়ে গেল। দাদা বললেন, চল, তোর ল্যাংড়া দাদুর কাছে যাই। ঘটনা জেনে আসি। আসার আগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর অনুষ্ঠানও শুনে আসব।
সন্ধ্যার সময় দাদাকে সঙ্গে নিয়ে চললাম পাশের বাড়িতে। ঝিঁঝি ডাকছে, কুকুরের ডাক, শিয়ালের ডাকও ভেসে আসছে। দুটো পগারের মধ্য দিয়ে পথ। বিষকাটালির ঝোপ পথের দুধারে। জোনাকিদের হাট বসেছে।
ল্যাংড়া দাদু বললেন, আজকে মফিজ পাগলাকে মেরে ফেলেছে রাজাকাররা। মফিজ পুরোপুরি উন্মাদ একটা ছেলে। শীতকালে সে পুকুরের জলে গা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সারাক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলে। সে নাকি রাজাকারদের দেখে বলেছে, ওই, তোরা কি মায়ের দুধ খাস নাই? মায়ের সঙ্গে কেউ বেইমানি করে? যা রাইফেল নিয়া পলায়া যা। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দে। এই কথা শোনার পর রাজাকাররা মফিজকে গুলি করেছে।
দাদা বললেন, মফিজকে তো এই রাজাকাররাও চেনে। ও যে পাগল, এটা তো ওদের জানা। তারপরও গুলি করল?
রাজা বলল, মফিজ পাগলাকে রাজাকাররা গুলি কইরা মারছে। আমাগো একটা গরু মিলিটারিরা জবাই কইরা খাইছে। আমি এই হারামজাদাগুলানরে জব্দ করুম।
আমি বললাম, কেমন করে করবি রাজা। ওদের হাতে তো রাইফেল আছে।
রাজা বলল, আপনি একটা বুদ্ধি দেন। কেমনে জব্দ করা যায়।
আমি বললাম, আমার মাথায় তো কোনো বুদ্ধি আসে না।
আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে।
কী সেটা?
জামালগোটা।
রাজাকারগুলানের তরকারির সঙ্গে জামালগোটা মিশায়ে দিব। তারপর সবগুলান হাগু করতে করতে শেষ হয়া যাবে।
কেমনে করবি?
আরে আমি শসা, কুড়া, জামালগোটা নিয়া স্কুলের সামনে দিয়া গেলে ওরা নিজেরাই সব কাইড়া নিব।
তোকে যদি গুলি করে?
করলে করবে।
রাজা তা-ই করল। পরের দিন সকালবেলা একটা ডালাতে কিছু শসা, আলু, জামালগোটা আর কুমড়া সাজিয়ে নিয়ে চলল সে স্কুলের দিকে।
স্কুলের সামনে গিয়ে সে হাঁক পাড়তে লাগল, লাগব তরিতরকারি। লাগব তরিতরকারি।
স্কুলের গেটে পাহারায় ছিল দুটো পাঞ্জাবি মিলিটারি। তারা ডাকল, এ লাড়কা, ইধার আও।
রাজা তার ডালা নিয়ে গেল তাদের কাছে।
তুম মুক্তি হ্যায়?
নেহি হুজুর। মে পাকি হ্যায়।
তোমহারা পাস ক্যায়া হ্যায়?
তরকারি হ্যায়। সবজি হ্যায়।
কোয়ি হাতিয়ার নেহি?
নেহি হুজুর।
খা কে দিখাও। (খেয়ে দেখাও)
রাজা শসা কচ কচ করে খেল।
বহুত আচ্ছা হ্যায়। ইয়ে সাব আনাস রাখকে চালি যাও। বহুত দিন কোয়ি আনাস নেহি খায়া। পেট ক্লিয়ার নাহি হোতা। কাল জরুর পেট ক্লিয়ার হোগা।
রাজা বলল, এইটা পেট পরিষ্কার করার জন্য খুব ভালো। খেয়ে নিয়ো। রাতের বেলা খেয়ো। সকালে তাহলে পেট পরিষ্কার হবে।
দিন ম্যায় নেহি খায়েঙ্গা?
দিনে বাকি সবজি খেতে পারো। রাতে এই সবজিটা গোশতের সঙ্গে রেঁধে খেয়ো।
সেন্ট্রি দুজন তখন লঙ্গরখানার বাবুর্চিকে ডাকে। সুন, দোপাহার ম্যায় ইয়ে আনাস কো অর রাতপে উয়ো আনাসকো পাকাও।
আমার দাম?
দাম ক্যায়া! তোমকো গোলি নেহি মারা ইয়ে তেরা খুস নাসিব হ্যায়...
রাজা চলে এল।
আমি উত্তেজিত। রাজা কী হলো, সব বল। রাজা সব খুলে বলল। আমি বললাম, যা, নদীর ওপারে যা। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দে। আজ রাতেই যেন এই ক্যাম্পে তারা হামলা চালায়।
রাজা বলল, যাব।
আমাদের একটা সাইকেল ছিল। মিলিটারির ভয়ে সেটা পুকুরে পানিতে ডোবানো ছিল। সেটা তোলা হলো। রাজা সেই সাইকেলে চড়ে ছুটল। সে সিটে চড়তে পারে না। রডের নিচে দিয়ে দুই প্যাডেলে পা রেখে সে ভালো সাইকেল চালায়।
জামাল ফিরল বিকেল চারটার দিকে। সে জানাল, মুক্তিযোদ্ধারা আজ আসবেন। রাতের খাবারের পর পরিস্থিতি দেখবেন বায়োনোকুলারে। যদি দেখেন ওরা সবাই পায়খানার দিকে ছুটছে, তাহলে আক্রমণ করবেন। তা নাহলে ওদের অস্ত্র বেশি। পারা যাবে না।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন মিজান মামা। আমার নিজের মামা। সন্ধ্যার পরপর সব কৃষকের মতো পোশাক পরে, মাথায় মাথাল আর ধানের বোঝা নিয়ে হাজির হলেন আমাদেরই বাড়িতে।
রাজা বলল, একটা বায়োনোকুলার না কী কইলেন, আমারে দেন, আমি সুপারিগাছে উইঠা দেখি অরা কী করে।
রাজা সুপারিগাছে উঠেছে। স্কুল মাঠে মিলিটারিরা আলো রেখেছে অনেক। দূর থেকে বায়োনোকুলারে দেখে সে বলল, হ, আমার অষুধে কাম হইছে। অরা সবাই খালি পায়খানায় যাইতেছে। এক লগে এতজন কেমনে যাইব। সব লাইন কইরা মাঠেই কাম সারতেছে।
মিজান মামা বললেন, চলো, দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুদিক থেকে আক্রমণ করব।
আমরা মাটিতে শুয়ে আছি।
মিজান মামারা আমাদের স্কুলের দিকে গেছেন।
স্কুলের মাঠে আলো।
বাইরে অন্ধকার। গাছপালা। সেই গাছের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে তাঁরা গুলি ছুড়তে লাগলেন। একযোগে। একটু পরে চিৎকার উঠল, জয় বাংলা।
মিজান মামা এসেছেন। মুক্তিরাও এসেছেন। তাঁদের কাছে প্রচুর পাকিস্তানি অস্ত্র, গোলাবারুদ। তিনি বললেন, বাবুল, রাজা, চল। আজ রাতেই নদীর ওপারে যেতে হবে। কালকেই আরও আরও মিলিটারি চলে আসবে। পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে।
আমি, রাজা, বাবুল চললাম মিজান মামার সঙ্গে।
দাদা-দাদি গেলেন না।
পরের দিন আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিল পাকিস্তানি মিলিটারিরা। দাদা-দাদির লাশ আমরা পাইনি। ছাইয়ের সঙ্গে হয়তো মিশে গিয়েছিল তাদের দেহ। মিশে গিয়েছিল বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে।