
রতনকাকুদের বাড়ি থেকে এই যে এতটা পথ হেঁটে এলাম, তখন কিন্তু ভয় করেনি। এখন করছে। বুক কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে।
অন্তু, আকাশ আর টুপুর অবস্থা কী? ওরাও কী ভয় পাচ্ছে? ওদেরও কী বুক কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে!
আর রতনকাকুর?
নাহ কাকু নিশ্চয় ভয় পাচ্ছেন না। এ রকম অমাবস্যারাতে বিলের মাঝখানকার দিঘির ধারে যিনি আমাদের ভূত দেখাতে নিয়ে এসেছেন তাঁর কি ভয় পাওয়ার কথা!
সন্ধ্যাবেলাই রতনকাকুদের বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম। চার বন্ধুর একজনেও বাড়িতে আসল কথাটা বলিনি। বলেছি, কাল শুক্রবার, স্কুল বন্ধ, এ জন্য রতনকাকুদের বাড়িতে বসে চাঁদের পাহাড় সিনেমাটা দেখব। বইটা পড়ে যেমন মুগ্ধ হয়েছি, কাকু বলেছেন, সিনেমাটা দেখেও তেমন মুগ্ধ হব।
এসব অবশ্য রতনকাকুই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ভূত দেখাবার প্রস্তাবে আমরা যখন লাফিয়ে উঠেছি তখনই কাউকে কিছু না বলার প্রতিজ্ঞাটা তিনি করিয়েছেন। সেই শর্তে রাজি হয়েই এসেছি আমরা। যদিও আকাশ একটু গড়িমসি করছিল। কারণ, ভূতে ওর বিশাল ভয়। আমরা সাহস দিয়ে এনেছি। আর কাকুর উৎসাহ তো ছিলই। কথায় কথায় বলছিলেন, কিচ্ছু হবে না। আমি আছি। সঙ্গে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ থাকবে। একে পাঁচজন মানুষ, তার ওপর টর্চ, ভূত বাবাজি সামনে আসার সাহস পাবে না।
সন্ধ্যা হতে না-হতেই ঘোরতর অন্ধকার চারদিক। এক হাত দূরের কিছুও দেখা যায় না। চারদিকে ঝিঁঝি ডাকছে, চৈত্র মাসের হাওয়া বইছে, বাদুড় উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে।
সবাই পাশাপাশি হাঁটছি। কাকুর হাতের টর্চ মাঝেমধ্যে জ্বলছে। এভাবে আমরা িদঘির পাড়ে এলাম। শ খানেক বছরের পুরোনো ভাঙাচোরা ঘাটলায় বসলাম।
কাকু টর্চ নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, ‘খবর কিরে তোদের?’
আমাদের মধ্যে টুপু সবচেয়ে সাহসী। সে বলল, ‘আমার খবর ভালো।’
‘ভয় পাচ্ছিস না তো?’
‘নাহ একদমই না।’
‘অন্তুর খবর কী?’
অন্তু বলল, ‘আমিও তেমন ভয় পাচ্ছি না।’
‘তার মানে একটু একটু পাচ্ছিস!’
অন্তু কথা বলল না।
কাকু বললেন, ‘আকাশ, তোর দশা কী?’
‘দশা’ শব্দটা শুনে আকাশ একটু হাসার চেষ্টা করল। হাসিটা জমল না। কোনোরকমে বলল, ‘দশা ভালোই’।
‘গলা শুনে তো মনে হচ্ছে নারে।’
তারপর কাকু ধরলেন আমাকে। আমি বসেছি তাঁর পাশে। কনুই দিয়ে একটা গুঁতা দিলেন। ‘তোর কাহিনি কিরে, শুভ?’ ঢোক গিলে বললাম, ‘কাহিনি খারাপ না।’
‘খারাপই মনে হচ্ছেরে ভিতুর ডিম। গলা দিয়ে তো দেখছি আওয়াজই বের হচ্ছে না। শোন, এখানে আমরা পাঁচজন মানুষ। এত মানুষের সামনে ভূত আসবে না। উত্তরপাড়ের ওই জঙ্গল থেকে নিশিরাতে তেনাই বেরোন। ওই দিকটাতেই ঘোরাঘুরি করেন। অমাবস্যায় সন্ধ্যার পরপরই বেরোন। অনেকেই দেখেছে। আমার ভাগনে মন্টু দেখেছে দুবার। একবার ওর সঙ্গে আমিও ছিলাম। নিজ চোখে দেখলাম। মন্টুটা বেজায় সাহসী। অমাবস্যার দিন আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়। রাতে কাউকে কিছু না বলে এই িদঘির পাড়ে এসে বসে থাকে তাঁকে দেখার জন্য।’
টুপু শুকনো গলায় বলল, ‘তেনায় দেখতে কেমন?’
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবি। আগে দেখি তো, টর্চের আলো িদঘির ওপাড় পর্যন্ত পৌঁছায় কিনা। তেনার আগমন ঘটলে এক ফাঁকে টর্চের আলো ফেলব। দেখি তখন অবস্থাটা কী দাঁড়ায়।’
কিন্তু কাকুর টর্চলাইট জ্বলল না। দু-তিনবার চেষ্টা করলেন। না, জ্বলছে না। কাকু অবাক। ‘আরে, এটা কী হলো? টর্চ তো জ্বলছে না।’
আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। ‘টর্চ জ্বলছে না?’
অন্ধকারে কাকুকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তিনি যে টর্চ নাড়াচাড়া করছেন, বোঝা যাচ্ছে। জ্বালাবার চেষ্টা করছেন, বোঝা যাচ্ছে। না টর্চ জ্বলছে না। কী হবে এখন? এই অন্ধকারে টর্চ ছাড়া...
কোনোরকমে বললাম, ‘ব্যাটারি শেষ হয়ে গেল কাকু?’
‘তাতো হওয়ার কথা না। আজই নতুন ব্যাটারি লাগিয়েছি। পুরোনো টর্চ, সমস্যা হচ্ছে বোধ হয় অন্য জায়গায়।’
তারপর আমাদের সাহস দিলেন। ‘ভয় পাবি না। একজন আরেকজনের হাত ধরে বসে থাক। শুভ, তুই ধর আমার হাত।’
আমি রতনকাকুর হাত ধরলাম। কাকু বললেন, ‘তোর হাত কাঁপছে। বললাম না ভয় পাবি না। আমি আছি।’
এ সময় অদ্ভুত একটা দৃশ্য ফুটে উঠল িদঘির উত্তর পাড়ে। সেদিকে তাকিয়ে আমাদের বুক হীম হয়ে গেল। শাদা আলখাল্লা পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখা যায় না, মুখের কাছটা অন্ধকার, দেখা যাচ্ছে শুধু শরীর। আলখাল্লার ভেতর ছোট ছোট দুটো সাদা আলো জ্বলছে। মুহূর্তের জন্য এক জায়গায় দাঁড়াল সে, তারপর একবার পুবে যায়, একবার পশ্চিমে।
কাকু ফিস ফিস করে বললেন, ‘দেখ দেখ ভালো করে তেনাকে দেখ। ইস্ টর্চটা যদি ঠিক থাকত...’
আমাদের কারোরই কথা বলার শক্তি নেই। বুক ধুগবুগ করছে, হাত-পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি তেনার দিকে। প্রত্যেকেই ধরে রেখেছি প্রত্যেকের হাত, তার পরও এমন করে একজন চেপেছি আরেকজনের দিকে, পারলে এ ওর কোলে চড়ে বসি। দমবন্ধ সবারই।
দেড়-দুই মিনিটের বেশি তেনায় থাকলেন না। যেমন হঠাৎ করে এসেছিলেন, তেমন করেই মিলিয়ে গেলেন।
কাকু বললেন, ‘কিরে, কেমন দেখলি?’
টুপু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘চলুন কাকু, বাড়ি যাই।’
‘দাঁড়া যাচ্ছি। এত তাড়া কিসের।’
আকাশ বলল, ‘ভয় করছে।’
‘এখন আর ভয়ের কিছু নেই।’
অন্তু বলল, ‘যদি আমাদের এদিকটায় আসেন?’
অন্তুর কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি িদঘির পশ্চিমপাড়ে আবার উদয় হয়েছেন তেনায়। ধীরে ধীরে যেন আমাদের দিকে আসছেন।
কাকু ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘সর্বনাশ! আমাদের দিকে আসছে মনে হয়।’
ভয়ে আতঙ্কে আমাদের তখন ফিট হওয়ার উপক্রম।
কাকু বললেন, ‘ভয় নেই, ভয় নেই। আমি আছি।’
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘কাকু, আমি ফেন্ট হয়ে যাচ্ছি।’
কাকু লাফ দিয়ে উঠলেন। ‘বলিস কী! না না, কেউ ভয় পাবি না। ভয়ের কিছু নেই।’
তারপর চিৎকার করে বললেন, ‘অনেক হয়েছেরে মন্টু। আর না। ওরা খুব ভয় পাচ্ছে। চলে আয়।’
আমাদের তখন এমন অবস্থা, প্রত্যেকেই যেন রতনকাকুর কনুইয়ের বড় রকমের একটা করে গুঁতা খেয়েছি। কী, ঘটনা কী?
কাকু তখন হো হো করে হাসছেন। ‘আরে গর্ধবগণ, পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। মন্টু আর আমি প্ল্যান করে করেছি। মন্টু আজ সকালে আমাদের বাড়িতে এসেছে। ও হচ্ছে মহা সাহসী। ওকে আমি আগে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। মুখে কালো কাপড় বেঁধে, শাদা আলখাল্লায় নিজেকে ঢেকেছে সে আর ছোট্ট খেলনা দুটো টর্চের একটা এক হাতে ধরেছে পায়ের দিকে, একটা বুকের দিকে। ব্যস, অতিসহজ ভূত। আর আমার টর্চ ঠিকই আছে, নড়াচাড়া করার ফাঁকে ব্যাটারিগুলো ওলটপালট করে দিয়েছিলাম। এ জন্য জ্বলেনি। এখন দেখ, এই যে জ্বলছে।’
বাটন টিপে মন্টুর ওপর টর্চের আলো ফেললেন কাকু। মুখে কালো কাপড় আর আলখাল্লা খুলতে খুলতে মন্টু তখন হা হা করে হাসছে।
ফেরার সময় কাকু বললেন, ‘শোন ভিতুগণ, আমি আর মন্টু এখানে তেনাকে দেখেছি, এটা ডাহা মিথ্যা। তোদের বুঝ দেওয়ার জন্য বলেছি। ভূত বলে আসলে কিছু নেই। ভূত ব্যাপারটা লোকে বানিয়েছে। ভূত থাকে আমাদের মনে, চিন্তা-চেতনায়, স্বপ্নে আর কল্পনায়। বাস্তবে ভূত নেই।’
মন্টু আমাদের সঙ্গে ফিরছিল। সে বলল, ‘কোনো কোনো মানুষ নিজেই ভূত। যেমন আমি।’ বলে আবার সেই হাসি। হা হা হা।