গল্প

মোটুমামার অভিযান

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

মোটুমামা তপু আর তোতাকে নিয়ে গ্রামে এসেছে। সে শখের গোয়েন্দা। গ্রামে এসেই রহস্যের সন্ধান পেয়ে গেছে। হাবু নামে এই গ্রামে বিশ-বাইশ বছরের এক ছেলে ছিল। সে পরপর কয়েক বছর আন্তজেলা সাঁতার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেই হাবুকে তিন দিন হলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মোটুমামা বলল, ‘গোয়েন্দা যেখানে যায়, রহস্য সেদিকে ধায়। আমরা এখানে আসার আগেই রহস্য চলে এল। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে হাবুকে খুঁজে বের করা।’

বিকেলবেলা ওরা গেল মিয়াবাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে। ঘন ঝোপঝাড়ে বিকেলবেলায় পুকুরপাড় অন্ধকার হয়ে আছে। একটানা পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। অনেকগুলো পাখি কিচিরমিচির করছে। থেমে থেমে একটা পাখি কোয়াক কোয়াক করে ডেকে উঠছে। গা ছমছমে অবস্থা।

পুকুরের একপাশে বাঁধানো ঘাট। চারদিকে ঝাঁকড়া গাছ। পুকুরের দিকে নুয়ে আছে।

মোটুমামা পুকুরঘাটে গিয়ে বসল। তপু আর তোতা গিয়ে বসল মোটুমামার পাশে।

মোটুমামা বলল, ‘ভূতের কারবার দেখেছিস?’

তপু বলল, ‘ভূত কোথায় দেখলে?’

মোটুমামা বলল, ‘কড়ইগাছের শুকনো ফল পড়ল পুকুরে। হালকা পাতার মতো ফল। পানিতে ভেসে থাকার কথা। সেই ফল পানিতে ভেসে না থেকে ডুবে গেল।’

তপু বলল, ‘মামা, পুকুরের পানির নিচে ভূত আছে।’

‘তুই কীভাবে বুঝলি?’

‘পুকুরের চারপাশে গাছ। পুকুরের পানি ঝকঝক করছে। সেখানে কোনো পাতা পড়ে নেই। গাছের পাতা পড়ে পুকুরের পানি নোংরা হয়ে থাকার কথা। পুকুরে আছে পানি-ভূত। সে পানি খায় না। গাছের পাতা খায়।’

তোতা বলল, ‘মামা, ভয় লাগছে। চলো বাড়ি যাই।’

তপু বলল, ‘হ্যাঁ মামা। চলো যাই। বালতি নিয়ে আসি।’

মোটুমামা জিজ্ঞেস করল, ‘বালতি এনে কী করবি?’

তপু বলল, ‘পুকুরের পানি নেব। পানি-ভূতের পানি পরীক্ষা করে দেখা হবে।’

মোটুমামা কিছু বলল না। উঠে পড়ল। সে এখনো ঘটনা বুঝে উঠতে পারেনি। ওরা বাড়ির ভেতর চলে গেল।

তপু বালতিতে করে পুকুরের পানি নিয়ে এল। মোটুমামা আগ্রহ নিয়ে তার কাজ দেখছে। তপুর বুদ্ধির ওপর মামার আস্থা আছে। তপু আরেকটা বালতিতে বাড়ির কুয়া থেকে পানি নিয়ে এল। মোটুমামা এক বালতি টিউবওয়েলের পানি নিয়ে এল।

তপুর হাতে টুকরো করে ভাঙা পাটকাঠি। সে পাটকাঠির একটা টুকরা কুয়ার পানি ভরা বালতিতে ফেলে দিল। পাটকাঠি পানির ওপর ভাসতে থাকল। তপু বলল, ‘মামা, পাটকাঠি ভাসছে।’

মোটুমামা বলল, ‘পাটকাঠি পানিতে ভাসবে, এটাই জগতের নিয়ম। ছোটবেলায় চিকন পাটকাঠি দিয়ে আমরা ছিপের ফাতনা বানাতাম।’

এরপর তপু টিউবওয়েলের পানিভর্তি বালতিতে পাটকাঠির টুকরা ফেলল। পাটকাঠির টুকরা এবারও ভেসে থাকল। মোটুমামা বলল, ‘বিরাট জ্ঞানী মানুষ তুই, তপু। পাটকাঠি পানিতে ভাসে এটা আবিষ্কার করে দুনিয়ার মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে চাইছিস!’

তপু এবার পাটকাঠির টুকরা পুকুরের পানিভর্তি বালতিতে ফেলে দিল। মোটুমামা অবাক হয়ে দেখল হালকা পাটকাঠি ধীরে ধীরে পানিতে ডুবে গেল।

মোটুমামা জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা কী হয়েছে?’

‘পুকুরের পানিতে কোনো পাতা নেই। তোমার সামনে কড়ইগাছের শুকনো ফল পুকুরের পানিতে ডুবে গেল। তার মানে কী দাঁড়ায়?’

‘কী দাঁড়ায়? পুকুরের পানির নিচে ভূত আছে? পানি-ভূত, পাতা খায়?’

তপু বলল, ‘দেড় শ থেকে দু শ বছরের পুরোনো পুকুর। অনেক দিন হলো কেউ সেখানে গোসল করে না।’

ঘটনা দেখে মোটুমামার গলা শুকিয়ে গেছে। সে ঢোক গিলে বলল, ‘তোর কী মনে হয়?’

তপু বলল, ‘অনেক দিন ধরে পানিতে গাছের পাতা পড়েছে। সেই পাতা জমা হয়েছে পুকুরের পানির নিচে। গাছের জমা পাতায় একধরনের গ্যাস তৈরি হয়েছে। সেই গ্যাসের কারণে পানির ঘনত্ব কমে গেছে। ওই পুকুরের পানি সাধারণ পানির থেকে পাতলা হয়ে গেছে। এখন সেখানে হালকা কিছু পড়লেই ডুবে যায়। হাবুমামা কোনোভাবে পড়ে গেছে পুকুরে। সে ডুবে গেছে। আর উঠতে পারেনি।’

মোটুমামা ঘটনা নানাকে বলল। নানা ঘটনা শুনে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। গ্রামের মানুষজনের ভেতর উত্তেজনা দেখা গেল। তাঁরা সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। কেউ কেউ বললেন, ‘এই পুকুরে মাছ বাঁচে না।’

আরেকজন বললেন, ‘হাঁস নামে না পুকুরের পানিতে।’

নানা বললেন, ‘পুকুরে জাল ফেলা দরকার। হাবু পুকুরে ডুবে গেলে সে জালে আটকাবে।’

তপু বলল, ‘জাল পুকুরের তলা পর্যন্ত না পৌঁছালে ​লাভ নেই।’

ছোট মানুষ বলে কেউ তার কথায় আর গুরুত্ব দিল না। হাবু পুকুরে ডুবে গেছে না গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে, সেই আলোচনা থেমে গেল।

পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে মোটুমামা এসেছেন উঠোনে। তিনি চোখ মেলে হকচকিয়ে গেছেন। উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে হাবু। মোটুমামা ‘হাবু!’ বলে আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠল। মোটুমামার চিৎকারে তপু আর তোতা বিছানা ছেড়ে উঠে এল। হাবুমামাকে দেখে তাদের চোখও ছানাবড়া হয়ে গেছে। ঘটনা জানা গেল হাবুর কাছে। সে গিয়েছিল যশোরে। সেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোল্ড মেডেল সাঁতার প্রতিযোগিতা ছিল। মোটুমামা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হাবুর দিকে। সে মরেনি, বেঁচে আছে! তপু আর তোতা তাকিয়ে দেখে হাবুমামার গলায় সোনার মেডেল ঝুলছে।