গ্রাফিকস: প্রথম আলো
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বৈষ্ণবী নারী সাধক

জানকী দাসীর ছ’কুড়ির আখড়া

সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা। প্রায় দেড় শ বছর আগে এক বৈষ্ণবী সেখানে উপাসনার জন্য রাধামাধবের আখড়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেনতেন আখড়া নয়, ছ’কুড়ি নারী সাধকের আখড়া। বিশাল সে আখড়ায় ঠাঁই নিয়েছিলেন ১২০ জন বৈষ্ণবী।

১৯১০ সালে প্রথম প্রকাশিত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইটির পূর্বাংশ খণ্ডের পরিশিষ্ট অংশে এই আখড়ার তত্ত্ব পাওয়া যায়। সেখানে লেখা রয়েছে, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে জানকী দাসী বৈষ্ণবী কর্তৃক সুনামগঞ্জের পাথারিয়ায় এই রাধামাধব মন্দির ও আখড়া প্রতিষ্ঠিত হয়।

তবে এটুকুই। গেল এক শ বছরের বেশি সময় ধরে এ নিয়ে লেখক, গবেষকদের আর তেমন কোনো অনুসন্ধান বা লেখাজোখা নেই। তাই তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়া। আর সে সন্ধানেই জানকী দাসীর পাশাপাশি মিলে গেল বাংলার ঐতিহ্যবাহী রামায়েত সম্প্রদায়ের খোঁজ। এক শতাব্দী ধরে এই সম্প্রদায় বিষয়েও তেমন কিছু জানা যায় না। যদিও একসময় বাংলায় শ্রী ও রামায়েত সম্প্রদায় প্রভাবশালী ছিল।

সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে শান্তিগঞ্জ উপজেলা। শান্তিগঞ্জের পাথারিয়া বাজারে অটোরিকশা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করতেই লোকজন দেখিয়ে দেয় আখড়ার পথ। সেই পথ ধরে আখড়ার গেট খুলে ঢুকতেই সরু রাস্তা। পথের শেষ হয়েছে পুরোনো সুরমা নদীর ঘাটে। আর নদীর তীরে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে আখড়া।

‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত আখড়ার বর্ণনায় বলেছেন, ‘মঠ, অস্থল বা আখড়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ী গুরুদের আবাস স্থান।’ আখড়া বৈষ্ণব সাধকদের আশ্রয় ও ভজন–সাধনের জায়গা। সাধারণত সেখানে একটি বিগ্রহ মন্দির, প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান গুরুর সমাধি এবং মোহান্ত ও সহবাসী শিষ্যদের কিছু বসবাসের ঘর থাকে। তা ছাড়া উদাসী ও তীর্থ যাত্রীদের আশ্রয়ের জন্য থাকে ধর্মশালা।

সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে শান্তিগঞ্জ উপজেলা। শান্তিগঞ্জের পাথারিয়া বাজারে অটোরিকশা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করতেই লোকজন দেখিয়ে দেয় আখড়ার পথ। সেই পথ ধরে আখড়ার গেট খুলে ঢুকতেই সরু রাস্তা। পথের শেষ হয়েছে পুরোনো সুরমা নদীর ঘাটে।

এখানেও তাই। পাশাপাশি সারিবদ্ধ তিনটি পাকা ঘর। তিনটিই চুন-সুরকির। প্রথমটি আকারে বেশ বড়, সেটিই রাধামাধব মন্দির। মাঝেরটি তার চেয়ে ছোট জানকী দাসীর সমাধি মন্দির। তৃতীয়টি ছোট আকারের ঝুলন মন্দির। এটি বঙ্গীয় স্থাপত্যরীতির চৌচালা ছাদের। এর উল্টো দিকেই ছিল ছনের তৈরি কিছু কুঁড়েঘর। সেখানেই থাকতেন বৈষ্ণবীরা।

আখড়াটি ২০০৩ সাল থেকে ইসকন পরিচালনা করছে। মন্দিরের অপর পাশেই নতুন গড়ে তোলা হয়েছে আখড়ার বেশ কয়েকটি সাধারণ আধা পাকা ঘর। চত্বরের মাঝে নাটমন্দির।

পুরোনো রাধামাধব মন্দির

তারই একটি ঘরে টেবিল–চেয়ারে বসে কাজ করছিলেন আখড়ার বর্তমান পরিচালক পরমপতি জনার্দন দাস ব্রহ্মচারী। ২০২০ সাল থেকে এই আখড়া পরিচালনা করছেন। তিনি যখন ভার নেন তখন এখানে মন্দির আর চারদিকে আখড়ার কিছু ছনের ঘর ছিল। জানকী দাসীর আখড়া নিয়ে প্রশ্ন করতেই বললেন, জানকীর আখড়া এটিই। তিনিই এটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বললেন, তাঁর সময়ে এই আখড়ায় ১২০ জন নারী সাধক বা বৈষ্ণবী অবস্থান করতেন।

জানকী দাসীর বাবা ছিলেন জমিদার। জমিদারি ছিল কাছের দোয়ারাবাজারে। এখন সে গ্রামের নাম চুনিগাঁও। পৈতৃক সম্পত্তি ভোগ করার দ্বিতীয় কেউ ছিল না। কেউ বলে জানকী বিয়ে করেননি, কেউ বলে অল্প বয়সে স্বামী চলে গিয়েছিলেন। পরে তিনি বাবার দেওয়া অনেক সম্পদের অধিকারী হন।

জনার্দন দাস জানান, ব্রিটিশ আমলের সেই সময়ে অনেক সাধু–সন্ন্যাসী, মোহান্তরা এখানে যাওয়া–আসা করতেন। তাঁদের সঙ্গে জানকী বৃন্দাবন ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি স্থির করলেন, পৈতৃক সব সম্পত্তি ভগবানের সেবায় উৎসর্গ করবেন। পরে তিনি একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নাদেশ পান।

এ সময় তিনি বৈয়াখাউরি নামের জায়গায় একটি মন্দির তৈরি করেন। তবে সেখানে উপযুক্ত পরিবেশ না মেলায় পাথারিয়ায় ২০ একর জায়গা কিনে নিজে এই রাধামাধব জিউর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া আখড়া চত্বরের বাইরে বাকি ৬৪ একর ফসলি জমির আয় দিয়ে মন্দির চলত। এখানকার বিগ্রহ কাঠের তৈরি। তিনি এই রাধামাধব বিগ্রহের নামেই সব সম্পত্তি উইল করে দিয়ে যান।

১৯১০ সালে প্রথম প্রকাশিত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইটির পূর্বাংশ খণ্ডের পরিশিষ্ট অংশে এই আখড়ার তত্ত্ব পাওয়া যায়। সেখানে লেখা রয়েছে, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে জানকী দাসী বৈষ্ণবী কর্তৃক সুনামগঞ্জের পাথারিয়ায় এই রাধামাধব মন্দির ও আখড়া প্রতিষ্ঠিত হয়।

আখড়ার ভেতরে একটি পুরোনো, জরাজীর্ণ মঠ। সেখানেই তাঁর সমাধি। সেখানে পড়ে আছে জ্বালানি কাঠের স্তূপ, পরিত্যক্ত জিনিসপত্র ও আবর্জনা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পাথারিয়ার তালুকগাঁও গ্রামে গড়া এই মন্দির প্রায় দু–তিন শ বছরের পুরোনো। একসময় এখানে নিয়মিত ভক্তদের আরাধনা, শঙ্খ আর ঢাকের তালে কীর্তনের সুর বাজত। আজ ঐতিহাসিক নিদর্শনটি সংস্কারের অভাবে বেহাল। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলেও স্থাপত্যগুলোতে এখনো সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টি পড়েনি। স্থানীয় লোকজন বলেন, এখনই সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে এসব চিরতরে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আখড়ার ব্রহ্মচারী জানিয়েছেন, বালাগঞ্জ সদরের কোনো একটি আখড়ায় জানকী মা দেহত্যাগ করেছিলেন। তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয় এই আখড়া চত্বরে। জানকী দাসীর পর বাবাজিরা এই আখড়ার হাল ধরেন।

ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে সাধুরাই এই আখড়া পরিচালনা করতেন। এখন এখানে আগের কোনো সাধকই নেই।

ব্রহ্মচারী সাধুর কাছে জানতে পারি, নদীর ওপারের গ্রামে এখনো একজন নারী সাধক রয়েছেন, যিনি এই মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। সম্ভবত তিনিই একমাত্র জীবিত নারী সেবায়েত, যিনি এই আখড়ার আশ্রয়ে ছিলেন। নাম তাঁর সেবাদাসী বৈষ্ণবী।

সেবাদাসী বৈষ্ণবী

পুরোনো সুরমা নদীর ওপারের গ্রাম কান্দিগাঁও। সম্পূর্ণ গ্রামটি ঘিরে আছে জল। সেখানে গড়েছেন আখড়া। আখড়া বলতে একটি ছোট্ট কুটির, অসমাপ্ত মন্দিরের কাঠামো আর ফাঁকা জায়গা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ৮৫ বছরের আশপাশে বয়স। চেহারায় ব্যক্তিত্ব প্রখর। সেবাদাসী বৈষ্ণবী আখড়ায় একাই থাকেন। ছবি তুলতে চাইলে তুলে রাখা সাদা শাড়ি পরে, কপালে তিলক কেটে, হাতে জপমালা নিয়ে সামনে এসে বসলেন।

সেবাদাসী পাথারিয়ার আখড়ায় কাটিয়েছেন প্রায় অর্ধশত বছর। স্বাধীনতাসংগ্রামের ২০ বছর আগে ভেক নিয়েছিলেন। থাকতেন সে সময় থেকে। ২০০৩ সালে ইসকন দায়িত্ব নেওয়ার পর আখড়াছাড়া হন। পরে কাছেই এই আখড়া গড়ে বাস করতে থাকেন অবিবাহিত এই বৈষ্ণবী। মাঝখানে অবশ্য ১৯৭১ সালে একবার আখড়া ছাড়তে হয়েছিল। সে সময় আখড়ায় আগুন ধরিয়ে বইপত্রসহ অন্যান্য জিনিস সব পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

জানকী দাসীর কথা তুলতেই সেবাদাসী বললেন, বাউল ধর্ম এখানে জানকী মা–ই এনেছেন। সে দুই শ বছর আগের কথা হবে। পাথারিয়ায় মায়ের সমাধি মন্দিরের কথায় আক্ষেপ তাঁর মুখে। জানালেন, আগে সেখানে ভোগ–আরতি হতো। এখন অবহেলায় ময়লা–আবর্জনার ভাগাড়–ঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

সেবাদাসী জানান, তাঁরা রামায়েত সম্প্রদায়ের। তবে এখন আর এ সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে নেই। রামানন্দ এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে তাঁরা রামানন্দী বা রামায়েত, রামাইৎ বা রামাৎ। এঁদের তিলকসেবা রামানুজদের মতোই, তবে ঊর্ধ্বরেখা কিছুটা হ্রস্ব। গলায় থাকে রুদ্রাক্ষের মালা। তাতে গুটি থাকে সতেরো, উনিশ, একুশ, চুয়ান্ন বা এক শ আটটি।

আখড়া বৈষ্ণব সাধকদের আশ্রয় ও ভজন–সাধনের জায়গা। সাধারণত সেখানে একটি বিগ্রহ মন্দির, প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান গুরুর সমাধি এবং মোহান্ত ও সহবাসী শিষ্যদের কিছু বসবাসের ঘর থাকে। তা ছাড়া উদাসী ও তীর্থ যাত্রীদের আশ্রয়ের জন্য থাকে ধর্মশালা।

বাংলার আদি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে রামায়েত অন্যতম। কোম্পানি ও ব্রিটিশ আমলে লেখা বিভিন্ন বইয়ে বাংলার রামায়েত সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু গেল এক শ বছর ধরে বাংলায় রামায়েত সম্প্রদায়ের তেমন খোঁজ পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, চৈতন্যের প্রসারের সময় এই সম্প্রদায় সংকুচিত হয়। তবে ফকির–সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পরে এদের ব্যাপক কোণঠাসা করা হয়। বৈষ্ণবদের মধ্যে একমাত্র রামায়েত সম্প্রদায় ফকির–সন্ন্যাসী বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।

বাংলাদেশে একসময় রামায়েত সম্প্রদায়ের প্রচুর আখড়া ছিল। ঢাকা শহরে সবচেয়ে বড় ও বহুল পরিচিত রামাবতী আখড়া ছিল সূত্রাপুরের লালবিহারী আখড়া।

‘পূর্ববঙ্গের জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ’ বইয়ে জেমস জয়েস জানিয়েছেন, চতুর্দশ শতকের শেষ দিকের প্রখ্যাত রামানুজের শিষ্য ছিলেন রামানন্দ। বঙ্গদেশের হিন্দুদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুশাসনের দিক দিয়ে এই সম্প্রদায় অনেক কঠোর। রামাবতরা পূজা করেন শুধু বিষ্ণু ও রামচন্দ্রকে। তিনিই রামাবত সম্প্রদায়ের দেবতা। কখনো কখনো মেয়েদের এই সম্প্রদায়ভুক্ত করা হতো। তাঁদের সঙ্গে আচরণ করা হতো বোনের মতো। তবে মারাত্মক কোনো অনৈতিক কাজ চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করা হতো।

ছ’কুড়ির আখড়া

জেমস জয়েস আরও পর্যবেক্ষণ করেছেন, রামাবতরা বহু শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন। যাঁরা সর্বাধিক কৃচ্ছ্রসাধন করতেন তাঁরা ছিলেন তাপসী। দিগম্বর হয়ে সারা গায়ে ছাই মেখে গোটা ভারতবর্ষ তাঁরা চষে বেড়াতেন। রামাবতদের সাধু-সন্ন্যাসীরা সব সময় গাঁজা টেনে বুঁদ হয়ে থাকেন বলে বারবার উল্লেখ রয়েছে। মোহাবিষ্ট হয়ে রামের চিন্তায় তাঁরা বিভোর থাকেন। বাংলা অঞ্চলের রামাবতরা নামকাওয়াস্তে কাপড় পরেন। কোমরে সুতলি ও কটিদেশে নেকড়া তাঁদের আচ্ছাদন। বেশির ভাগ রামাবত লম্বা চুলে খোঁপা বাঁধেন।

‘ভক্তমালা’ গ্রন্থে রামানুজের শিষ্য পরম্পরায় প্রথমে রামানুজ, দ্বিতীয় দেবাচার্য্য, তৃতীয় রাঘবানন্দ ও চতুর্থ রামানন্দ বলা হয়েছে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’–এও রামানন্দকে রামানুজের চতুর্থ শিষ্য বলা হয়েছে।

অক্ষয়কুমার দত্ত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় বইয়ে রামানন্দী সম্প্রদায় নিয়ে লিখেছেন, শ্রী রামচন্দ্র তাদের ইষ্ট দেবতা। তবে বিষ্ণুর অন্যান্য অবতারও তারা স্বীকার করে। তবে কলি কালে রামোপাসনারই প্রাধান্য মনে করে বলে তারা রামাৎ। রামানুজদের মতো তারা রাম-সীতার পৃথক বা যুগল মূর্তির আরাধনা করে, অন্যান্য বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতোই তুলসী ও শালগ্রামশিলাকেও ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। কেউ কেউ বিষ্ণুর অন্য মূর্তিরও পূজা করে থাকে। তবে রামায়ণ, শ্রী ভাগবত ও ভগবত–জাতীয় উল্লিখিত নিয়মশৃঙ্খলাই এদের বিধান।

এ সম্প্রদায়ভুক্ত সংসার-বিরক্ত বৈরাগীরা অনেকেই রাম ও কৃষ্ণের মুহুর্মুহু নাম উচ্চারণ ছাড়া আর কোনো প্রকার পূজার প্রয়োজন স্বীকার করেন না। শ্রীরাম এঁদের বীজমন্ত্র এবং ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয়রাম’ বা ‘সীতারাম’ তাঁদের অভিবাদন-বাক্য।

ভারতের সব তীর্থস্থানে সফর করাই রামাবতদের মূল কাজ। আহার ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা ছাড়াই রামাবতরা দ্বারকা থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পর্যন্ত নিঃসংকোচে ঘুরে বেড়াতেন।

চতুর্দশ শতকে রামপূজকদের রামায়েত সম্প্রদায়কে সুসংগঠিত করেন সাধু রামানন্দ ও তাঁর শিষ্যরা। বর্ণভেদের সেই মধ্যযুগে ব্রাহ্মণ্য–প্রাধান্যকে অস্বীকার করে রামানন্দ দুঃসাহসী বিপ্লবী মনের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর ১২ জন প্রধান শিষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এক মুসলমান তাঁতি—কবীর। অন্য একজন চামার রুই দাস, আরেকজন নাপিত সেনা। রামানন্দের নারী শিষ্যদের মধ্যে পদ্মাবতীর নাম স্মরণীয়।

তাঁর সময়ে এই আখড়ায় ১২০ জন নারী সাধক বা বৈষ্ণবী অবস্থান করতেন। জানকী দাসীর বাবা ছিলেন জমিদার। পৈতৃক সম্পত্তি ভোগ করার দ্বিতীয় কেউ ছিল না। কেউ বলে জানকী বিয়ে করেননি, কেউ বলে অল্প বয়সে স্বামী চলে গিয়েছিলেন। পরে তিনি বাবার দেওয়া অনেক সম্পদের অধিকারী হন।

রামানুজের শিষ্য থাকা অবস্থায় রামানন্দ ভারতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন। ফিরে এলে অন্য শিষ্যরা অভিযোগ তোলেন, ভ্রমণে রামানন্দের আহারের নিয়ম রক্ষা হয়নি, যা কি না রামানুজের গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। সহশিষ্যরা তাঁর সঙ্গে আহারে আপত্তি তুললে রামানুজ তা অনুমোদন করেন। আলাদা জায়গার আহারের এ আদেশে রামানন্দ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি সেই সমাজ থেকে সরে নিজের সম্পূর্ণ আলাদা গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরাই রামানন্দী। রামানন্দীদের আচার অনুষ্ঠান রামানুজদের চেয়ে কম সুনির্দিষ্ট। বলা যায়, আহার ও স্নানের ক্ষেত্রে তাঁদের কঠোর নিয়ম নেই। রামানন্দ চেয়েছিলেন অসুবিধাজনক বন্ধন থেকে তাঁর অনুসারীদের মুক্ত করতে। তিনি পণ্ডিতদের অবধূত বা মুক্ত করেন। লক্ষণীয় যে এই সম্প্রদায়ের বৈরাগী এবং অন্যান্য জাতি বা বর্ণের ভ্রুক্ষেপ না করে একসঙ্গে খায় ও পান করে।

ভক্তিমালায় জোর দিয়ে বলা হয়েছে, রামানন্দীদের মতবাদে বর্ণের পার্থক্য অগ্রহণযোগ্য। তারা বলে, ভগবান ও ভক্তের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু ভগবান মৎস্য, বরাহ, কূর্ম ইত্যাদি নিকৃষ্টরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই ভক্তও চামার, কোলি, ছিপি বা অন্য নিম্নবর্ণের মধ্যে জন্ম নিতে পারে। রামানন্দ মূলত ধর্মীয় অনুশাসন থেকে জাতপাতের ভেদাভেদ বাতিল করেছিলেন।

জানকী দাসীর সমাধি

বিভিন্ন সম্প্রদায়কে রামানন্দী বৈষ্ণব শাখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১২ জন প্রধান বা সবচেয়ে বিশিষ্ট। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী কবীর ছিলেন, বলাবাহুল্য নিম্নবর্গের। অন্ধ, মহান কবি ও বিষ্ণুভক্ত সুরদাস ছিলেন আরেক বিখ্যাত রামানন্দী। বলা হয়, সুরদাস ১ লাখ ২৫ হাজার পদ রচনা করেছিলেন। যেসব অন্ধ ভিক্ষুক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ান এবং বিষ্ণুর স্তবক গান তাঁদের সাধারণত সুরদাসী বলা হয়। সে হিসেবে তিনি এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা।

রামানন্দের তপস্বী ও অনুসারী যারা রামানন্দী, রামাবত বা রামাইৎ নামে পরিচিত, তারা গাঙ্গেয় ভারতের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। একসময় আগ্রায় তপস্বী জনসংখ্যার ৭ দশমাংশ ছিল রামানন্দী।

ঐতিহাসিক ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পুরো সময়টিতে রামায়েত সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন লেখায় ফকির–সন্ন্যাসী আন্দোলনে তাদের ভূমিকার কথা পাওয়া যায়।

আঠারো শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন ছিল এই ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, যা ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত চলেছিল। এই বিদ্রোহ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফকির–সন্ন্যাসী অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলিম সাধকদের একটি প্রতিরোধ। মাদারিয়া তরিকার সুফি সাধক মজনু শাহর ডাকে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন ৫০ হাজারের বেশি সন্ন্যাসী, ফকির, কৃষক এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, মালদা, কোচবিহারসহ বাংলার বিভিন্ন জায়গায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল।

অসিত নাথ চন্দ্র ‘দ্য সন্ন্যাসী রেবেলিয়ন’ বইয়ে জানান, ১৭৬৩ সালে তাঁতিদের সহায়তায় ঢাকার কারখানায় তাদের প্রথম আক্রমণের পর ফকির-সন্ন্যাসীরা আবার রাজশাহী জেলার রামপুর বোয়ালিয়া কারখানায় আক্রমণ করেন এবং কারখানা ও কিছু জমিদারি সম্পত্তি লুট করেন। ১৭৬৬ সালে, রামানন্দ গোসাঁই বা রামানন্দী সম্প্রদায় কোচবিহার জেলার দিনহাটার কাছে লেফটেন্যান্ট মরিসনের অধীন ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে একটি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন এবং একই বছরের আগস্ট মাসে গোসাঁইরা একটি নিশ্চিত বিজয় লাভ করেন।

তবে বিদ্রোহ শেষের পর থেকে রামায়েত একমাত্র সম্প্রদায়, যাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় না। এক শ বছর ধরে বাংলাদেশি কোনো গবেষককে রামায়েত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়নি। সুফি কালান্দরীদের মতো তারাও লুপ্তপ্রায়।

রামায়েত সম্প্রদায়ের হয়ে কান্দিগাঁওয়ে এখন একাই আছেন সেবাদাসী বৈষ্ণবী। সন্ন্যাস নিয়েছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন সচ্চিদানন্দ বাবাজি। তিনি জানান, তাঁর সময়ে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে পাথারিয়া আখড়ায় ৫০–৬০ জন বৈষ্ণবী ছিলেন।

জানকী দাসীর কথা তুলতেই সেবাদাসী বললেন, বাউল ধর্ম এখানে জানকী মা–ই এনেছেন। সে দুই শ বছর আগের কথা হবে। পাথারিয়ায় মায়ের সমাধি মন্দিরের কথায় আক্ষেপ তাঁর মুখে। জানালেন, আগে সেখানে ভোগ–আরতি হতো। এখন অবহেলায় ময়লা–আবর্জনার ভাগাড়–ঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

আখড়ার প্রসঙ্গে সেবাদাসী বলেন, তাঁর বাবা জানকী দাসীকে দেখেছেন। তিনি দেখেননি। ‘৯ বছর বয়সে বাবা-মায় আখড়ায় দেয়। আগে তো ছ’কুড়ি বৈষ্ণবী ছিল, কিন্তু আমি তিন কুড়ির কম দেখছি। এখন আর কেউ বেঁচে নেই। আমিই রইছি। সব শেষ।’ তিনি বলেন, ‘আগে আখড়ার অনেক উন্নতি ছিল। ভক্ত, শিষ্য ছিল। প্রতিদিন ভোগ চড়ত। এখন ইসকন আসার পর আর নাই।’

আখড়ার সঙ্গে সেবাদাসীর সম্পর্কের শুরু নিয়ে বললেন জানকী মায়ের কৃপার কথা—‘আমার মায়ের যখন গর্ভে ছিলাম, দশ মাস পুরা হবার পরও তখনো আমি খালাস হই না। আগে তো এত ডাক্তার ছিল না। পাথারিয়া আখড়ায় নিয়া গেল আমার বাবায়। লইয়া গেছুন বাদে সেখানে জানকী মা বাক্যসিদ্ধা আছিলাই। জানকী মা যেটা কইছিল, সেটাই ফলছে। ওই যে নিত্যানন্দ দাস আর জানকী মা। তাদের বলার পর চরণামৃত দিলা। খাওয়ার পর পাঁচ মিনিটেই আমি খালাস।’

সেবাদাসী জানান, জানকী মা–ই গুরু ছিলেন। তারপর মোহান্ত হন নিত্যানন্দ, তারপর সচ্চিদানন্দ মোহন, এরপর রামসুন্দর বৈষ্ণব। উনি ২৫–৩০ বছর আগে দেহ রাখেন। আখড়ায় তাঁর সমাধি রয়েছে। উনি দেহ রাখার পরই ইসকন আখড়া অধিকার করে।

কান্দিগাঁও গ্রামের পথে কথা হয় আরেক বয়োবৃদ্ধ—মহামায়ার সঙ্গে। তিনি দীক্ষা নিয়েছেন বনমালী গোসাঁইয়ের কাছে। তিনি বলেন, জানকী মা বাক্‌সিদ্ধা ছিলেন। তাঁর ভাষ্য, জানকী মায়ের জন্ম নূরপুর, সেখানেই নাড়ি পোঁতা। বিধবা হয়েছিলেন ছোটবেলায়। এখানে আসার সময় ভারত বাউল নামের একজন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সম্ভবত তিনিই জানকী মায়ের আধ্যাত্মিক গুরু। তাঁর সঙ্গে এসে মন্দির প্রতিষ্ঠা ও আখড়া গড়েন তিনি। পরে সেই ভারত বাউল চলে যান। বিগ্রহের নামে জারি করা জানকী মার করা উইল ইসকনের কাছে আছে বলে শুনেছেন।

সেবাদাসী জানান, জানকী মা প্রথম যেখানে মন্দির করেছিলেন, সেই বৈয়াখাউরিতে এখন আখড়া নেই, মানুষজন নেই। রামায়েত সম্প্রদায়ের লোকজন পাওয়া যাবে বালাগঞ্জের আবদুল্লাপুরের আখড়ায়। সেই আখড়া জমজমাট।

মহামায়ার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্ধ বৈষ্ণবী সরস্বতী। শুনছিলেন আর সায় দিচ্ছিলেন তাঁর কথায়। যদিও তাঁর কণ্ঠে গান শোনা হয়নি, তবু তাঁর মুখ দেখে মনে পড়ল রামায়েত গোসাঁই সুরদাস ও সুরদাসী সম্প্রদায়ের কথা। ‘অখিয়া হরি দর্শন কি পিয়াসী, দেখো চাহাত কমল নয়ন কো, নিশি দিন রহত উদাসী…’