Thank you for trying Sticky AMP!!

নিরহংকার এক বিদ্বানের বিদায়

১৪ এপ্রিল মারা গেলেন লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খান। তাঁকে শ্রদ্ধা।

শামসুজ্জামান খান (২৯ ডিসেম্বর ১৯৪০—১৪ এপ্রিল ২০২১)

‘শোনো, একটা দুঃসংবাদ দেব! শামসুজ্জামান খান মারা গেছেন।’ পয়লা বৈশাখ ১৪২৮, পয়লা রমজান দুপুরবেলা এ খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে রইলাম খানিক। চোখ ভিজে আসতে লাগল আপনা–আপনি।

উপন্যাস লিখছি। ফেব্রুয়ারিতে শেষ করতে পারিনি, মার্চেও না। ফেসবুক-ফোন সব বন্ধ করে লিখছি। সেই যে আমার যারা ভোর এনেছিল সিরিজের এখানে থেমো নার পরের পর্ব। বইমেলায় বের করতেই হবে, এই জেদ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ধীরে ধীরে লিখছি। লিখতে গিয়ে জগত-সংসারের খবর রাখা বন্ধ করেছি। শামসুজ্জামান খান যে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্বিবদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, কিছু্ই জানি না।

অথচ তাঁর সঙ্গে দেখা হলো ১৭ মার্চে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। শামসুজ্জামান খান স্যার সভাপতি। আমি অন্যতম আলোচক।

শামসুজ্জামান খানকে ‘স্যার’ ডাকতাম। তিনি বিভিন্ন কলেজে পড়িয়েছেন, শিক্ষকদের আমরা স্যারই বলি। তাঁকে চিনি আমার স্কুলজীবন থেকে। আমি রংপুরে কচি-কাঁচার মেলা করতাম—‘অন্বেষা কচি-কাঁচার মেলা’। ঢাকা থেকে আমাদের কাছে যেত কচি ও কাঁচা নামের পত্রিকা, সেখানে শামসুজ্জামান খানের লেখা থাকত।

আমার জন্য তিনি ছিলেন মাথার ওপর বিটপীর ছায়ার মতন। আমার এই সামান্য অকৃতী জীবনের পরম প্রাপ্তি ও সৌভাগ্য যে আমি অনেক বড় বড় মানুষের স্নেহ ও প্রশ্রয় পেয়েছি। তাঁদের অনেককেই আমি জ্বালাতন করেছি, করি। আজ মনে হলে সংকোচবোধ করি যে কত বড় বড় মানুষকে কত সামান্য কারণে বিরক্ত করেছি। যেমন আমার এই উপন্যাসধারা লিখতে গিয়ে যখনই কোনো সংশয় দেখা দিত, ফোন করতাম আনিসুজ্জামান বা শামসুজ্জামান খানকে। শামসুজ্জামান স্যারকে বলতাম, স্যার, ১৯৬৯ সালের ওই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আর কে ছিলেন। তিনিও জবাব দিতেন। স্যার, কলকাতার কাছেই বইটার লেখক কে? আপনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ওই উপন্যাসের রেফারেন্স দিয়েছেন। তিনি বলতেন, গজেন্দ্রকুমার মিত্র। এটা স্যারকে জিজ্ঞেস না করে গুগল করলেই হয়। তবুও তাঁকেই ফোন করতাম। মা বইয়ের ১০০তম মুদ্রণ উপলক্ষে বাতিঘরের অনুষ্ঠানে আলোচনা করতে হবে, শামসুজ্জামান স্যারকে বলি! বলতেই তিনি রাজি। দ্য ব্যালাড অব আয়েশার প্রকাশ উপলক্ষে বাতিঘরের অনুষ্ঠানে স্যারকে আসতে বলিনি, স্যার ফেসবুকে দেখে নিজেই এসে হাজির হয়েছেন। এত স্নেহ করতেন আমাকে!

এখন স্যারের মৃত্যুর পর আমার হাহাকার লাগছে। আমরা সত্যিই অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম। আমার ওই উপন্যাস লিখতে গিয়েই আনিসুজ্জামান স্যারের আমার একাত্তর পড়ছি আর মনে হচ্ছে, আনিসুজ্জামান স্যারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি, আপনার সঙ্গে কি থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকার কার্যালয়ে শেখ কামালের দেখা হয়েছিল?

আনিসুজ্জামান স্যারের বইগুলো পড়ি, তাঁর জীবন কত বর্ণাঢ্য, কত বড় বড় গবেষণা করেছেন, দেশ-বিদেশের কত বড় মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, আর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কত বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এত বড় একটা মানুষ আমার মতো ছোট মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন কেন? একই অনুভূতি হচ্ছে শামসুজ্জামান খান স্যারের চলে যাওয়ার পর। এত বড় লোকসংস্কৃতিবিদ, লোকসংস্কৃতি নিয়ে যাঁর সিরিয়াস গবেষণাধর্মী গ্রন্থ আছে ১২টির বেশি, আর সম্পাদনা করেছেন ভলিউমের পর ভলিউম, যাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮০-এর বেশি, তিনি আমার মতো অর্বাচীনের সঙ্গে কথা বলার মতো সময় পেতেন কীভাবে? বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলোর সম্পাদনা কাজের সঙ্গে তিনি নীরবে, নেপথ্যে যুক্ত থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকায় তাঁর কথা উল্লেখিত আছে।

শামসুজ্জামান খানের কতগুলো বই আমার হাতের কাছে থাকে। এগুলোর মধ্যে আছে ঢাকাই রঙ্গরসিকতা ও রঙ্গরসের গল্পসমগ্র আর কতগুলো আছে আমার লেখার টেবিলে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে একটা গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়েছিল। তিনিই মহাপরিচালক হিসেবে আয়োজন করেছিলেন। তাতে জননেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব প্রমুখের মুখে বেশ কিছু ‘ক্রিটিক্যাল’ মুহূর্তের ‘ক্রিটিক্যাল’ ভাষ্য সরাসরি শোনা গেছে, যা আমার খুব কাজে লাগে। মাত্র কালকেই বইটা বের করে পড়ছিলাম। স্যারের অটোগ্রাফও চোখে পড়ল। গত মঙ্গলবারেই মেরিনাকে বলছিলাম, কতগুলো জিনিস জানার জন্য মনে হয় ফোন করি, আনিস স্যারকে, জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে, এ বি এম মূসা ভাইকে, সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাইকে; তখন মনে হয়, কেউ তো নেই। কীভাবে চারদিক শূন্য হয়ে এল! এই তালিকায় শামসুজ্জামান খানের নাম যোগ হবে এক দিনের মাথাতেই, ভাবতেই পারছি না।

বইমেলার শুরুতেই অন্য আলোর জন্য শামসুজ্জামান খান লেখা দিলেন। আমরা প্রকাশ করলাম। আমরা চেয়েছি, তিনি লেখা দেননি, এমন কখনো হয়নি। অসাধারণ পণ্ডিত, ভীষণ কর্মোদ্যোগী মানুষটা ছিলেন মাটির মানুষ।

সার্টিফিকেট অনুসারে তাঁর জন্ম ১৯৪০, আসলে ১৯৩৭। ৮৪ বছর বেঁচেছিলেন। তাঁকে দেখে অবশ্য কখনোই বৃদ্ধ মনে হয়নি।

এত বেশি বয়সের মানুষটা কেন সব অনুষ্ঠানে আসতেন? উফ্​, এখন মনে হচ্ছে, কাজটা মোটেও ভালো হয়নি। ২০২১-এর ১৭ মার্চের অনুষ্ঠানের মঞ্চের ছবিতে দেখছি, আমরা সবাই মাস্ক পরা, স্যার মাস্ক খুলে রেখেছেন। ইশ্​, কী অমোচনীয় ভুল।

করোনা আমাদের নিঃস্ব করে ফেলল। ১৯৭১ সালের বুদ্ধজীবী হত্যার ফলে সৃষ্ট শূন্যতা আজও পূর্ণ হয়নি, ২০২০-২১ সালে কোভিডে আমাদের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী মানুষদের তিরোধান কত যে বিপন্ন ও অসহায় করে তুলছে আমাদের, মর্মে মর্মে বুঝতে পারছি!