Thank you for trying Sticky AMP!!

সময়টা যখন দস্তয়েভস্কিয়ান

এ মাসেই ছিল ‘লেখকদের লেখক’ ফিওদর দস্তয়েভস্কির ২০০তম জন্মদিন

বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত জেমস জয়েসের ইউলিসিস-এর প্রকাশনার ১০০ বছর হতে যাচ্ছে সামনের ২ ফেব্রুয়ারি। সেটা নিয়ে কাজ করছি, এমন সময়ে খেয়াল হলো ২০০তম জন্মবর্ষ চলছে রাশিয়ান ফিওদর দস্তয়েভস্কির, যিনি লিখে গেছেন ঠিক এর আগের শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটা, নাম দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ এবং যার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েই ‘কারামাজভ’-এর ৪০ বছর পর জয়েস তাঁর ইউলিসিসকে বানাতে পেরেছিলেন ‘ইউলিসিস’।

উপন্যাসশিল্পে জয়েসের বড় কাজ ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’ বা ‘চেতনার ধারাস্রোত’ নামের গদ্যরচনার প্রকরণকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে যাওয়া। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়ে গেছেন কী করে টানা দীর্ঘ বাক্যে আমাদের মাথার মধ্যে একই সময়ে চলতে থাকা ডজনখানেক পরস্পরবিরোধী ভাবের প্রকাশকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। জয়েস বলে গেছেন, মানুষের মনের এই বিক্ষিপ্ত ভাবনা-সেলাইয়ের কাজটা তিনি শিখেছিলেন অখ্যাত এক ফরাসি লেখকের লেখা পড়ে। আর আদ্রেঁ জিদ বলছেন যে, না, এই প্রকরণের মূল স্রষ্টা দস্তয়েভস্কি। সেই দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে জয়েস বলেছেন এই কথা: ‘আধুনিক গদ্যের স্রষ্টা হিসেবে দস্তয়েভস্কির নাম অন্য যেকোনো লেখকের চেয়ে আগে আসবে। তিনিই আমাদের গদ্যকে এর এখনকার স্বরগ্রামে তুলে দিয়ে গেছেন। ঢঙ্গি-ন্যাকা ন্যাকা হাসির নায়িকা দিয়ে ভরা রোজকার সাজানোগোছানো ভিক্টোরিয়ান যে উপন্যাস—যেগুলোয় না আছে কল্পনাশক্তি, না আছে ভায়োলেন্স—সেটাকে প্রথম গুঁড়িয়ে দিয়েছিল দস্তয়েভস্কির বিস্ফোরণধর্মী লেখাগুলোই।’

এটা দস্তয়েভস্কির লেখার প্রধান গুণ—এই যে সাহিত্যের পাতায় মানবপৃথিবীকে ফুটিয়ে তুলবার কাজে ‘সহিংস’ হয়ে উঠতে পারা। তাঁর ট্রেডমার্ক বৈশিষ্ট্য হলো মানবমনের গূঢ়তম অন্ধকার প্রদেশে ঢুকে আমাদের নিষ্ঠুর মনস্তাত্ত্বিক এক্কাদোক্কা খেলাগুলোর বিশ্লেষণ করতে করতে হঠাৎ সেখানে পৃথিবীর আসল খেলা বুঝে ফেলার আলোটা জ্বালানো। এ কথার বিশ্লেষণে পরে যাব, আপাতত তাঁর দ্বিতীয় বড় গুণের কথাটা বলি। সেটা হলো ‘আইডিয়া’ বা চিন্তা ও দর্শন-আশ্রিত লেখালেখি। আইডিয়াভিত্তিক কথাসাহিত্যে তিনি এতটাই শক্তিমত্তা দেখিয়েছেন যে তাঁর গল্প-উপন্যাসের কারণে দর্শনের কিছু তত্ত্ব এমনকি নতুন দিকে বাঁক নেয়। আইডিয়া হিসেবে সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ, দর্শন হিসেবে অস্তিত্ববাদ, আর পড়াশোনার তত্ত্ব হিসেবে মনোবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব ও সাহিত্যসমালোচনা, ইত্যাকার বিষয়ের কারিকুলামই বদলে দিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। একজন লেখক চিন্তার জগতে এতটা তোলপাড় তুলতে পেরেছিলেন বলেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, চিন্তার ক্ষেত্রে দস্তয়েভস্কি থেকে তিনি যতখানি শিখেছেন, ততখানি আর কারও কাছ থেকেই শেখেননি। আর আলব্যের কাম্যু যখন বলেন, কার্ল মার্ক্স না, বিশ শতকের সবচেয়ে বড় ভবিষ্যদ্বক্তা ফিওদর দস্তয়েভস্কি, তখন দার্শনিক ও সমাজ-রাজনীতির বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট হয় আমাদের কাছে।

ফ্রানৎস কাফকাকে বলা হয় আধুনিক কথাশিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘প্রফেটিক’, কারণ, কাফকা নাকি তাঁর লেখায় বিশ্বযুদ্ধ, নাৎসি বর্বরতা ও ইহুদি নিধনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। আর ‘প্রফেটিক’ লেখক হিসেবে দস্তয়েভস্কি? ১৮৭০-এর দিকে লেখা তাঁর দ্য ডেমনস উপন্যাসে তিনি জোর করে চাপানো সাম্যবাদী আদর্শের ধারণা যে আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও চিন্তার স্বাধীনতার জায়গাটায় আঘাত হানবে, সেটা বলে গিয়েছিলেন। এর প্রায় ৫০ বছর পরে আসে সোভিয়েত কমিউনিজম এবং মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির নামে ঠিক তা-ই করা হয়, যা দ্য ডেমনস উপন্যাসে করেছিল নায়ক পিওতরের বিপ্লবী বাহিনীর লোকেরা—শাতভ নামের একজনকে খুন করার মধ্য দিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তাদের বিপ্লবের বোধ। পিওতরকে আমরা বলতে শুনি, বিপ্লব যখন আসবে, তখন ‘সিসেরোর জিব কেটে ফেলা হবে, কোপার্নিকাসের চোখ খুঁচিয়ে তোলা হবে, শেক্‌সপিয়ারকে পাথর মারা হবে’, এবং সবই ‘সাম্যের নামে।’ কখনো ক্ষমতায় এলে রাশিয়ার বিপ্লবীরা কী করবে, তার এর চেয়ে বড় ভবিষ্যদ্বাণী আর কী হতে পারত? তবে বলে রাখি, দস্তয়েভস্কি মানেই বৈপরীত্যে ভরা কিছু। এ মানুষটাই নিজে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন বিপ্লবে।

জেমস জয়েস যেমন দস্তয়েভস্কিকে ভালোবাসতেন তাঁর লেখার ভেতরকার উন্মাদনাগ্রস্ত শক্তিমত্তার জন্য, আলব্যের কাম্যু কিন্তু তাঁকে অত পছন্দ করতেন ওই একই উপন্যাসের (দ্য ডেমনস) কিরিলভ চরিত্রটার জন্য। অস্তিত্ববাদী ঘরানার লেখক কাম্যু খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন উপন্যাসে আত্মহত্যার পক্ষে কিরিলভের পরস্পরবিরোধী দার্শনিক যুক্তিগুলো পড়ে। উপন্যাসে আমরা দেখি কিরিলভ ‘মানব-ঈশ্বর’ হতে চায়। কীভাবে? তার ধারণা, কোনো কারণ ছাড়া যদি আত্মহত্যা করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে মানুষ সত্যিই স্বাধীন। কারণ, আত্মহত্যার মতো একটা কাজের পেছনে কোনো স্বার্থ থাকে না বলে ওই কাজ মানুষের সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক নিয়মের বিরোধী। অতএব, মানুষের পক্ষে কেবল ওভাবেই সম্ভব কোনো ‘মানব-ঈশ্বর’–এ রূপ নেওয়া—যে পৃথিবী ‘ঈশ্বর-মানব’ যিশুকে তার মাটিতে জায়গা দেয়নি, সেই পৃথিবীতে মানুষের স্বাধীনতার চূড়ান্তকে ছোঁয়া।

দস্তয়েভস্কির লেখার ধাঁচকে ভায়োলেন্ট বা সহিংস বলার পেছনে জেমস জয়েসের মাথায় যা কিছু কাজ করেছে, সেটা বুঝতে হলে দৃশ্যপটে সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে আনতেই হবে। ফ্রয়েড স্পষ্ট বলতেন যে কোনো তাত্ত্বিক মনোবিদ না, লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কিই আমাদের মানবমনের মনস্তাত্ত্বিক ঝড়ঝঞ্ঝার প্রথম বড় মাপের বয়ানকারী। তাঁর নভেলা নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড ও চার প্রধান উপন্যাস—ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, দ্য ইডিয়ট, দ্য ডেমনস ও তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ—যদি পড়েন তো দেখবেন সব কটির এক একক বৈশিষ্ট্য রয়েছে: ওখানে চরিত্রের মনস্তত্ত্ব নিয়ে যে পরিমাণ সাতচাড়া খেলা হয়েছে, তাতে মনে হবে এদের লেখক নিজে আর কিছু না হোন একজন ঝানু মনোবিদ। কিসের মনোবিদ? দস্তয়েভস্কি আগ্রহী আমাদের মনের সেই তথাকথিত ‘প্যাথলজিক্যাল’ অবস্থার নিরীক্ষণে, যার চক্করে পড়ে মানুষ পাগল, খুনি, অপরাধী ও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তিনি আগ্রহী আমাদের বিশেষ কিছু আবেগের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে, যেমন আমাদের ভেতরকার খুনে ক্রোধ, আমাদের জুলুমবাজি কর্তৃত্বপরায়ণতার ঝোঁক, নিজেকে ধ্বংস করবার জেদ এবং প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত-অপমানিত হওয়া নিয়ে আমাদের অনুভূতি। এই সব আবেগের যৌক্তিক প্রকাশে তাঁর চরিত্রেরা সমর্থ বলে সংগত কারণেই দেখা যায় তাঁর উপন্যাস ভরে আছে চিন্তাশীল বা ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ দিয়ে।

এর মধ্যে ভায়োলেন্স কোথায়? ভায়োলেন্স আসলে থাকে দস্তয়েভস্কির গদ্যে, তাঁর কাহিনির প্লটগুলোর নাটকীয় বাঁক বা মোচড়ের মধ্যে। এ মানুষটার নিজের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয়তার ভরা। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে, একবার। ১৮৪৭ সালে তিনি ‘পেত্রাশেভস্কি সার্কেল’ নামের এক ইন্টেলেকচুয়াল দলে যোগ দেন, যাদের মন্ত্র ছিল সোশ্যালিজম। এরপরই তাঁর এক গোপন বিপ্লবী সংস্থায় নাম লেখানো এবং শেষে ১৮৪৯ সালে সার্কেলের সব সদস্যসহ গ্রেপ্তার হওয়া। আট মাস কারাগারে রাখার পরে পুরো দলটাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলার জন্য আনা হলো এক বড় স্কয়ারে। এবার প্রথম তিন সদস্যকে নেওয়া হলো গুলিতে মারার জায়গায়, তখন দস্তয়েভস্কি নিজে মরার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন পরের লাইনেই। ঠিক সে মুহূর্তে জানা গেল, সম্রাট তাঁকে প্রাণভিক্ষা দিয়েছেন। এই ‘নকল মৃত্যুদণ্ড’ ছিল শাসকদের তরফে সাজানো এক খেলা, যাতে বিপ্লবীরা আজীবন মনে রাখে ওভাবে মৃত্যু দেখে আসার কথাটা। দলের একজন চিরদিনের মতো পাগল হয়ে গেল সেদিনই, আর আরেকজন এর ১৭ বছর পর লিখলেন ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট

এই ‘নকল মৃত্যুদণ্ডের’ পর তাঁর সাইবেরিয়াতে নির্বাসনও হয়েছিল, আর এরই সঙ্গে তাঁর ছিল মৃগীরোগ। এই সবগুলো বিষয়ই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিরিখে নাটকীয়, যেমন নাটকীয় তাঁর বাবার মৃত্যু—তাঁর কঠিন, কঠোর, সন্দেহপ্রবণ বাবা, যাঁকে নিয়ে বলা হয়ে থাকে যে তিনি খুন হয়েছিলেন নিজের চাকরদের হাতে। এতগুলো নাটকীয় ঘটনার সঙ্গে আবার আছে দস্তয়েভস্কির লিখে জীবিকা নির্বাহের অঙ্গীকার। সব সময় জুয়া খেলতেন বলে সব সময়ই টাকার দরকার হতো তাঁর, আর টাকা উপার্জনের জন্য তাঁকে ‘ডেডলাইন’ বা সময়সীমা মেনেই লিখে যেতে হতো। এই সব মিলে একটা চাপ, একটা প্রেশার কুকারের মধ্যে বসে নিজের স্বাধীনতাকে ভোগ করার আনন্দ বা গ্লানিবোধ—অতএব, কলম হাতে নিলেই তাঁর মধ্যে চলে আসত খ্যাপামি। সেভাবেই লিখতেন তিনি। লেখার বিষয়? খুন, খুনি, অপরাধী, মানুষের সহিংস মনমানসিকতা, নারীকে নিয়ে পুরুষের টানাটানি, ধর্মকে চ্যালেঞ্জ জানানোর আবার নাস্তিকতাকে ধসিয়ে দেওয়ার উসকানি, মানুষের নৈতিক দায়, অপরাধ ও পাপের প্রতি সমাজের নীরব সমর্থন, মানবতার বর্তমানের বিভ্রান্তিকর রক্তপাত ও অসুখে ভরা চেহারা, যার দিকে ঈশ্বরের দয়ামায়ার হাতটা বাড়ানো থাকলে সম্ভবত অন্য রকম হতো সবকিছু, কিন্তু কিছুই অন্য রকম হয় না। কারণ, মানুষ নিজের অস্তিত্বের নিয়ন্ত্রক অর্থে বেশি মাত্রায় স্বাধীন। অতএব, ‘সবকিছু থেকেই পচা গন্ধ বেরোচ্ছে, কারণ, সবকিছুর পেছনে বড় নায়ক হিসেবে কাজ করছে শয়তান।’

ফ্রানৎস কাফকা দস্তয়েভস্কিকে বলতেন তাঁর ‘রক্তের আত্মীয়’। দস্তয়েভস্কির দ ব্রাদার্স কারামাজভ-এ একটা খুন হয়—পিতৃহত্যা। তিন কারামাজভ ভাইয়ের চতুর্থ ভাই, তাদের একই পিতার অবৈধ এক সন্তান, সেখানে খুন করে বিষাক্ত ধরনের পিতা চরিত্র ফিওদর কারামাজভকে। কিন্তু সমাজের চোখে পিতার খুনি বড় ছেলে দিমিত্রি কারামাজভ। এবার দিমিত্রির বিচারপর্ব দেখি আমরা। দেখি যে মানুষের গড়া আদালত কতটা স্বেচ্ছাচারী ও বেখেয়ালি হতে পারে। কাফকা এখান থেকেই নিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত দ্য ট্রায়াল উপন্যাসের সূত্র, আর আরও নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যে যুক্তির সরলরেখায় না চলে অ্যাবসার্ডিটির কুহকী পথে যাত্রার দীক্ষা।

খুন তাঁর ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসের নায়ক রাসকলনিকভও করেছিল। সে খুন করে বসেছিল বন্ধক-ব্যবসা করা এক বুড়িকে। ওই খুনের পেছনে তার দুর্বল যুক্তি ছিল—বুড়িকে মেরে বুড়ির টাকা দিয়ে মানুষকে সাহায্য করা যাবে। যুক্তি এমনও ছিল যে শুভ ও অশুভের ধারণা স্রেফ কিছু কুসংস্কার, আর নৈতিক অর্থে নিখুঁত করে দেখলে আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষদের জন্য ‘অপরাধ’ বলে কিছু থাকতেই পারে না। আর খুনটার পেছনে তার সবল যুক্তি ছিল—সাধারণ মানুষেরা শুধু বাচ্চা পয়দা করুক, অন্যদিকে আমাদের মধ্যে যারা অসাধারণ মানুষ, তারা পৃথিবীর নিয়ম ভাঙুক, কারণ, তা না হলে পৃথিবী এগোবে না। এই লেখা পড়ে নিৎসেও ছাত্র হয়ে গেলেন দস্তয়েভস্কির।

এ লেখার ১৩-১৪ বছর পর লেখা দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ-এর মূল নায়ক ইভান কারামাজভ খুনি রাসকলনিকভের মতো করেই বুঝতে পারল যে যদি কোনো ঈশ্বর না থাকে, যদি আত্মার অমরত্ব বলে কিছু না থেকে থাকে, তাহলে আমাদের যেকোনো কাজই নৈতিক বিচারে সিদ্ধ—‘অল ইজ পারমিটেড’। সে তার ছোট ভাই দেবতুল্য আলিয়োশা কারামাজভকে বলল, সবকিছু করার অনুমতি এই পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তারপরও আমরা নিজেরা আমাদের যার যার কাজের জন্য দায়ী, তবে আমাদের মনের মধ্যে কী ইচ্ছা ঘুরপাক খায়, সে জন্য তো আর আমরা দায়ী না। পিতার খুনের পর সেই ইভানেরই মনে হলো, বদ পিতার মৃত্যু দেখার ইচ্ছা মনে পুষে চলে সে-ও একইভাবে দায়ী এই খুনের দায়ে। দস্তয়েভস্কি বলতে চাইলেন, অশুভ কিছু কেবল এ জন্য ঘটে না যে কিছু অপরাধী অশুভকে ঘটায়; অশুভ বরং ঘটে সমাজে বিরাজমান এক নৈতিক আবহাওয়ার জন্য, যেখানে সবাই মনে মনে অশুভকে পুষে চলে।

এই যে সর্বব্যাপী এক অশুভের বোধ, এই যে খুঁতগ্রস্ত স্বাধীনতা হলেও সেটার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এই দুই কারণেই ‘সহিংস’ লেখক দস্তয়েভস্কি (তাঁকে বলা হয় ‘মানব ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম শিল্পী’) আমাদের সময়ে এসে আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক, মাঝখানে ২০০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি জরুরি। কারণ, এ পৃথিবী এখনো যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, গণহত্যা ও স্বৈরাচার দিয়ে ভরা; এবং এখানে বিচরণ করা নীতিহীন, ধর্মহীন মানুষেরা আজও তাদের নিজেদের বিশ্বাস, সংস্কার, দুর্দশা ও জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার যার যার বোধের সামনে দাঁড়িয়ে অপরাধবোধে ভোগা একদল কারামাজভ, একদল রাসকলনিকভ।

এই মহানতম লেখকের দ্বিশত জন্মবর্ষে তাঁর প্রতি অপার শ্রদ্ধা। জয়েস ক্যারল ঔটস বলেছেন, লেখা শিখতে হলে কাফকা, জয়েস, কাম্যুর মতো করে আমাদের এই ‘বিভ্রান্তিজনক, ভায়োলেন্ট ও ট্র্যাজিক লেখালেখির মানুষটার কাছেই যেতে হবে, কারণ, আমাদের সময়টাই এমন।’

জানা-অজানার ৭ দস্তয়েভস্কি

১. ফিওদর দস্তয়েভস্কির জুয়ার নেশার কথা সর্বজনবিদিত। একবার জুয়ার দায় শোধ করতে তিনি চুক্তি স্বাক্ষর করলেন যে ওই বছরের ৯ নভেম্বরের মধ্যে নতুন এক উপন্যাস লিখে জমা দিতে না পারলে তাঁর তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সব বইয়ের স্বত্ব তিনি প্রকাশককে সামান্য টাকার বিনিময়ে দিয়ে দেবেন। পরে ওই চুক্তির কারণে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট লেখা থামিয়ে মাত্র ২৬ দিনে তাঁকে শেষ করতে হয়েছিল দ্য গ্যাম্বলার নামের উপন্যাসটি। বাংলা অনুবাদে এর নাম হলো জুয়াড়ি

২. ২৫ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস পুওর ফোক লিখে অনেক নাম করার পর জার নিকোলাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো দস্তয়েভস্কিকে। শুধু তিনিই নন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো একদল মানুষকে। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়ানোর ঠিক আগে নকল তরবারি দিয়ে গলা কাটার মহড়া হয়েছিল দলের সবার। তারপর সেই বিখ্যাত ‘নকল মৃত্যুদণ্ড’। কিন্তু শেষ মুহূর্তে খবর আসে, তাঁদের মাফ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন শাস্তি হচ্ছে চার বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় কঠিন শ্রমের দণ্ড। এ কারণে দস্তয়েভস্কিকে সাইবেরিয়াতেও কাটাতে হয়েছিল।

৩. সাইবেরিয়ার চার বছর তাঁর জন্য একদমই ভালো যায়নি। কারণ, ওখানে বহুবার মৃগীরোগের ভয়াল খিঁচুনির শিকার হতে হয় তাঁকে। আর এর থেকেই জন্ম নিল তাঁর অন্যতম প্রধান উপন্যাস দ্য ইডিয়ট

৪. লেখক হিসেবে জীবদ্দশায় দস্তয়েভস্কি এতই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন যে দ্বিতীয় জার আলেকজান্ডার রাজপ্রাসাদে তাঁকে লেখা থেকে পাঠের আমন্ত্রণই শুধু জানাননি, অনুরোধ করেছিলেন জারের ছেলেকে পড়ানোরও। ভাবা যায়, এই একই পরিবার একসময় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিল!

৫. ফ্রান্‌ৎস কাফকার দ্য ট্রায়াল, আলবেয়ার কাম্যুর দ্য আউটসাইডার, সামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো—বিখ্যাত এসব অস্তিত্ববাদী লেখার গোড়া কিন্তু দস্তয়েভস্কির উপন্যাস দি নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড (১৮৬৪)। ব্যক্তিমানুষের জীবনে করণীয় ও এক বিশেষ কর্মে জীবনের অর্থ সন্ধানকেন্দ্রিক লেখালেখির ওই শুরু। ওটিই পৃথিবীর প্রথম অস্তিত্ববাদী উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত।

৬. দস্তয়েভস্কির প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে অসুখী সম্পর্কের শেষ হয় তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি তাঁর উপন্যাস দ্য গ্যাম্বলার–এর স্টেনোগ্রাফার মেয়েটিকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর শুধু সুখের সময়ই যায়নি, এই স্ত্রীই লেখক স্বামীর জুয়ার নেশা ও ঋণের বোঝা কমিয়ে প্রথমবারের মতো সংসারটিকে গুছিয়ে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসেন।

৭. আমরা জানি, জ্যঁ পল সার্ত্রে ও আলবেয়ার কাম্যুর পথপ্রদর্শক দস্তয়েভস্কি। কিন্তু কয়জন এ তথ্য জানি যে তাঁর উপন্যাস নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড রালফ এলিসনকে তাঁর বিখ্যাত অদৃশ্য মানব লেখার পথ দেখিয়েছিল?

সূত্র: উইকিপিডিয়া