অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জন্মদিনে শ্রদ্ধা

পিকাসো যখন কবি

পাবলো পিকাসো আধুনিক চিত্রকলার বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, এ কথা আমরা জানি। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন এমন এক কবি, যিনি শব্দকে তুলির মতো ব্যবহার করে ভাষার ক্যানভাসে এঁকেছেন শিল্পের এক নতুন রূপ। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে তিনি প্রায় সাড়ে ৩০০ কবিতা ও ৩টি নাটক রচনা করেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা তাঁর এই সাহিত্যিক সময়কালকে সাধারণভাবে ‘অপ্রয়োজনীয় বিরতি’ মনে করা হয়। যদিও পরবর্তীকালে গবেষকেরা দেখিয়েছেন, পিকাসোর কবিতা তাঁর শিল্পচর্চারই ধারাবাহিক সম্প্রসারণ। দৃশ্যশিল্পের ভাষাকে শব্দে রূপান্তরের একধরনের পরীক্ষা।

১৯৩৫ সাল ছিল পিকাসোর জীবনের এক সংকটময় মোড়ের বছর। ব্যক্তিগত জীবনে তখন তিনি গভীর বিচ্ছিন্নতার সময় পার করছিলেন ওলগা খোখলোভার সঙ্গে, যিনি ছিলেন তাঁর স্ত্রী, পরে সম্পর্কের ইতি ঘটে। একই সময়ে প্রেমিকা মারি-তেরেজ ওল্তের জন্ম দেন পিকাসোর ঔরসজাত কন্যাসন্তান মায়াকে। এমনতর মানসিক টানাপোড়েনের সময়ই তিনি আঁকা বন্ধ করে ঝুঁকেছিলেন লেখার দিকে।

স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী, লেখক ও ভাস্কর হাইমে সাবার্তেস, যিনি পিকাসোর বন্ধু ও দীর্ঘদিনের সহচর ছিলেন, তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, পিকাসোর মধ্যে তখন একধরনের অদম্য তাড়না তৈরি হয়েছিল। তিনি সবখানে লিখতেন—চেয়ারের হাতল, হাঁটুর ওপর বা টেবিলের কোণে। জায়গা বা পরিবেশ তাঁর কাছে কোনো বাধা ছিল না, যতক্ষণ না কেউ এসে তাঁর একাগ্রতা ভাঙত। এ সময় থেকেই আঁকার পাশাপাশি পিকাসো ধীরে ধীরে কবিতার জগতে প্রবেশ করেন।

১৯৩৫ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে তিনি প্রায় সাড়ে ৩০০ কবিতা ও ৩টি নাটক রচনা করেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা তাঁর এই সাহিত্যিক সময়কালকে সাধারণভাবে ‘অপ্রয়োজনীয় বিরতি’ মনে করা হয়। যদিও পিকাসোর কবিতা তাঁর শিল্পচর্চারই ধারাবাহিক সম্প্রসারণ।

পিকাসোর কাছে কবিতা ছিল তাঁর শিল্প-অনুসন্ধানের সম্প্রসারণ, হাইমে সাবার্তেসের ভাষায়, লেখালেখি যেন তাঁর পুরোনো উদ্বেগগুলোর নতুন ব্যাখ্যা এনে দিয়েছিল।

পিকাসোর কাছে কবিতা ও চিত্রকলা ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল প্রকাশের দুই সমান্তরাল ভাষা। তাঁর কবিতা আর ছবিতে ভাবনা ও প্রকাশের মধ্যে একধরনের গঠনগত মিল দেখা যায়—দুই ক্ষেত্রেই বিষয়কে ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রবণতা স্পষ্ট।

রুশ ভাষাবিদ ও সাহিত্যতাত্ত্বিক রোমান ইয়াকবসন, যিনি আধুনিক ভাষাতত্ত্ব ও কাঠামোবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলেছিলেন, ‘আন্তঃসংকেত অনুবাদ’ বলতে বোঝায় একধরনের চিহ্নব্যবস্থা থেকে আরেক চিহ্নব্যবস্থায় রূপান্তর। পিকাসো এই ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছিলেন—তিনি ছবির কিউবিস্ট–বিন্যাসকে ভাষার রূপে প্রকাশ করেছেন, যেন রং ও শব্দ একই শিল্পরেখায় মিলেমিশে যায়।

পিকাসো বলছিলেন, ‘যখন আমি কবিতা লেখা শুরু করি, তখন আমি নিজের জন্য শব্দের একটি প্যালেট তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেমনভাবে একজন চিত্রশিল্পী রঙের প্যালেট তৈরি করেন।’ এই স্বীকারোক্তি তাঁর চিন্তা ও প্রকাশের প্রক্রিয়াকে স্পষ্ট করে। রঙের প্যালেটে যেমন তিনি ছায়া-আলো মেলাতেন, তেমনি কবিতার পঙ্‌ক্তিতে শব্দগুলোকে রঙের মতো ছড়িয়ে দিতেন।

পিকাসো চিত্রকলার তিনটি ধারা—বিশ্লেষণাত্মক কিউবিজম, পুনর্গঠনধর্মী কিউবিজম এবং কোলাজ কবিতার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছিলেন।

পিকাসো ছবির ক্ষেত্রে যেমন রূপ, রং ও কাঠামোকে ভেঙে নতুনভাবে সাজাতেন; তেমনি শব্দের মধ্যেও অর্থকে খণ্ডিত করে নতুনভাবে গড়ে তুলতেন। তাঁর কবিতায়ও সেই একই অনুসন্ধান—বাস্তবকে বিশ্লেষণ, পুনর্গঠন আর নতুন দৃষ্টিতে প্রকাশ, এসব ছিল।

পিকাসোর বিশ্লেষণাত্মক কিউবিজম ধারা মূলত বস্তুকে ভেঙে তার নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস—যেখানে একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দৃশ্যমান হয়। এই ভাবনার প্রতিফলনই দেখা যায় তাঁর ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সালের কবিতায়—

‘মেডুসার ভেলাটি নিজেকে সমুদ্রের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে
পাখির পকেট-আয়নার প্রতিফলিত তরঙ্গকে আপন বাহুতে ধারণ করতে চায়...’

যখন আমি কবিতা লেখা শুরু করি, তখন আমি নিজের জন্য শব্দের একটি প্যালেট তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেমনভাবে একজন চিত্রশিল্পী রঙের প্যালেট তৈরি করেন।
পাবলো পিকাসো

এখানে ‘লা’, ‘সমুদ্র’, ‘আয়না’, ‘শৃঙ্খল’ আর ‘পাখি’—সব উপাদানই আলাদা স্তরে ভেঙে গিয়ে আবার নতুন বিন্যাসে ফিরে আসে। প্রতিটি স্তবক যেন একই মোটিফের নতুন গঠন। এই পুনর্গঠনপ্রক্রিয়ায় পিকাসো চিত্রকলার জ্যামিতিক ছন্দকে ভাষায় রূপান্তর করেছেন। ফলে তাঁর এ ধরনের কবিতায় বস্তুর একাধিক দৃষ্টিকোণ একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে—যেমন ছবিতে মুখ, পাখা বা কোনো বস্তু বহু স্তরে বিভক্ত হয়ে নতুন আকার পায়।

পিকাসোর পুনর্গঠনধর্মী কিউবিজম ধারা ছিল আরেক ধরনের পদ্ধতি, যেখানে বিভিন্ন আকৃতি, রং ও বস্তু একত্র করে নতুন গঠনকাঠামো তৈরি করা হতো। এ পর্যায়ের কাজ তুলনামূলকভাবে বেশি বিমূর্ত ও রঙিন। পিকাসো এখানে বস্তুর বাস্তব রূপকে ভেঙে তাঁর স্মৃতি ও সারমর্মের প্রতীকী পুনর্গঠন করেছেন।

১৫ জুন ১৯৩৬ সালের এক কবিতায় তিনি লিখেছিলেন—

‘রসুন নিজের তারা-ঝরা শুকনা পাতার রং দেখে হাসে,
গোলাপকে উপহাস করে যে খঞ্জরের মতো তার রং রসুনের গায়ে বিঁধিয়ে দেয়…’

ব্রাসির ক্যামেরায় পাবলো পিকাসো

এই কবিতায় রসুনের গন্ধ, রং ও গঠন মিলেমিশে একধরনের বিমূর্ত নান্দনিক সত্তা তৈরি করেছে। কবিতাটি ধীরে ধীরে জটিলতা ঝরিয়ে এসে থেমেছে এই পঙ্‌ক্তিতে, ‘তার রং রসুনের গায়ে’—যা বস্তুটির মূল সত্তা বা আত্মরূপের প্রতীক।

এ ধরনের কবিতায় দৃশ্যের বাস্তবতা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, থেকে যায় শুধু অনুভূতির ছাপ—যেমন ছবিতে কখনো রঙের প্রবাহই বস্তুর চেয়ে বেশি অর্থ তৈরি করে।

পিকাসোর কাছে কবিতা ও চিত্রকলা ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল প্রকাশের দুই সমান্তরাল ভাষা। তাঁর কবিতা আর ছবিতে ভাবনা ও প্রকাশের মধ্যে একধরনের গঠনগত মিল দেখা যায়—দুই ক্ষেত্রেই বিষয়কে ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রবণতা স্পষ্ট।

কোলাজ হলো এমন এক শিল্পধারা, যেখানে বিভিন্ন কাগজ, কাপড়, সংবাদপত্রের টুকরা বা অন্য বস্তু একসঙ্গে জুড়ে তৈরি করা হয় একটি চিত্র, অর্থাৎ বাস্তব উপাদান মিশে যায় শিল্পের ভেতরে। পিকাসোর একমাত্র কোলাজধর্মী কবিতা ‘১৪ ডিসেম্বর ১৯৩৫’ তৈরি হয়েছিল এই কৌশলে—সংবাদপত্রের টুকরা ও বিজ্ঞাপনের বাক্যাংশজুড়ে। তিনি লিখেছিলেন—

‘আবেভিল—আয়াসিও—আলজিয়ার্স—আঁজে—অঁতিব—বিয়ারিৎজ...
শহীদ বা অপহৃত শিশুরা… এবং বড়দিনের বার্তা…’

এখানে বাস্তব তথ্য ও ভাষার খণ্ডাংশ একত্রে মিশে তৈরি হয়েছে একধরনের কাব্যিক অবজেক্ট। এই কবিতায় ভাষা ঠিক অর্থের বাহন নয়; বরং নিজেই দৃশ্যমান বস্তুরূপে উপস্থিত—যেমন পিকাসো তাঁর ক্যানভাসে পত্রিকার কাগজ ব্যবহার করে অর্থ ও বস্তুর সীমানা ভেঙেছিলেন।

এই কোলাজধর্মী কবিতায় পাঠক সংবাদ ও শব্দের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, যেখানে শব্দের মানে নয়, তার দৃশ্যমান উপস্থিতিই মুখ্য। পিকাসোর কবিতার পুনরাবৃত্ত মোটিফগুলো—খাবার, দেহ ও রং তাঁর চিত্রজগতেরই সম্প্রসারণ। তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে আসে টুকরা টুকরা দৃশ্য—খাবার, আয়না, সিগারেট, মাছ, নারীদেহ, মৃত্যু—সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে তাঁর ভাষার নিজস্ব ক্যানভাস।

একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন—

‘সেই মুহূর্ত থেকে—দুপুরের খাবারের টেবিলে বাধ্যতামূলক বিরতি না নিয়েই—
আমি লিখে যেতে পারতাম,
চিজ আর টমেটোর সঙ্গে মিশে থাকা
অসংখ্য অতিশয়োক্তির ভেতরে বসে।’

এই লাইনগুলোতে দেখা যায়, দৈনন্দিন জীবনের একেবারে সাধারণ দৃশ্য—লাঞ্চ টেবিল, পনির, টমেটো—এসব হঠাৎ ‘ভাষা’র মধ্যে কিউবিস্ট রূপ নেয়। দৈনন্দিন বাস্তবতা এখানে শিল্পের উপাদান হয়ে উঠতে থাকে। এই কবিতাগুলোতে ব্যবহৃত শব্দ নিজেই বস্তু, অর্থ থেকে কিছুটা স্বাধীন, আবার একই সঙ্গে পিকাসো কখনো বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন নন। তিনি দৈনন্দিন উপাদানকে শিল্পে রূপান্তরিত করেন, মুছে ফেলেন না। এই দ্বন্দ্বই তাঁর কবিতার প্রাণশক্তি।

পিকাসোর কবিতায় প্রচলিত বাক্যগঠন প্রায় অনুপস্থিত। তিনি বলেছিলেন, ‘অন্যের তৈরি নিয়মের সঙ্গে আমার শব্দকে জোর করে মানিয়ে না নিয়ে আমি বরং নিজের নিয়ম নিজেই তৈরি করতে পছন্দ করি।’ ফলে পিকাসোর কবিতায় অনেক সময়ই যতিচিহ্ন নেই, বাক্য ভাঙা, অর্থের সীমানা অস্পষ্ট। তাঁর কবিতাগুলো একপ্রকার অবিরাম প্রবাহের মতো, শুরু ও শেষের নির্দিষ্ট সীমা নেই।

অন্য এক কবিতায় দেখা যায়—

‘কনুই দুটি টেবিলের কিনারা পেরিয়ে বেরিয়ে আছে—
একটি আরেকটির চেয়ে একটু বেশি সামনে,
বাঁ হাত ধরে রেখেছে ইতিমধ্যে লেখা পৃষ্ঠা,
অন্য হাতটি নতুন কাগজের ওপর—
আর পেনসিলের অগ্রভাগ ঠিক এখানে—যেখানে আমি চাপ দিই।’

এখানে লেখার ক্রিয়া নিজেই কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। শব্দের গতি, হাতের ভঙ্গি, কাগজের প্রান্ত, সব একসঙ্গে মিলেমিশে একধরনের দৃশ্যচিত্র নির্মাণ করে।

পিকাসোর কবিতায় ‘এবং’ শব্দটি কেবল ক্রিয়া বা ভাবের সংযোগ নয়; বরং গতির প্রতীক—গতি সৃষ্টির শক্তি। এই অবিরাম গতি তার কিউবিস্ট চিত্রকলার গঠনগত গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমন একটি রেখা অন্যটিকে টেনে নেয়, তেমনি একটি শব্দও আরেকটিকে টানে, বদলায়, এগিয়ে নিয়ে যায় পরবর্তী রূপে।

পিকাসোর কবিতা তাঁর শিল্পচেতনারই আরেক প্রকাশ। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এই সাহিত্যিক সময়কাল তাঁর জীবনের বিরতি নয়; বরং নতুন দিকের আরেকটি গভীর অনুসন্ধান। তাঁর শব্দচিত্রে যেমন রয়েছে চিত্রকলার জ্যামিতিক গঠন, তেমনি রয়েছে ভাষার মুক্তপ্রবাহ।

পিকাসো নিজে বলেছেন, ‘আমি খুঁজি না, আমি পাই।’

শিল্প-ইতিহাসবিদ ও সাংস্কৃতিক–গবেষক এমিলি সিৎসিয়া যথার্থই বলেছেন, পিকাসোর সাহিত্যিক সময়কালকে ‘অপ্রযুক্তিশীল সময়’ নয়; বরং এক ‘উৎপাদক নিরীক্ষামূলক পর্ব’ হিসেবেই দেখা উচিত।

পিকাসোর কবিতা একজন শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি—যিনি রং, শব্দ ও আকার—সবকিছুকে এক ভাষায় মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।