ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রামকৃষ্ণের কোলাজ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রামকৃষ্ণের কোলাজ

বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামকৃষ্ণের সাক্ষাতে আসলে কী ঘটেছিল

এ মাসে ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণবার্ষিকী। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল রামকৃষ্ণের, ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট বিকেল চারটায়। একজন যুক্তিবাদী মানুষের সঙ্গে একজন ভক্তিবাদী মানুষের সাক্ষাতে কী ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে?

রামকৃষ্ণ একবার বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বয়স তখন ৬২ বছর, রামকৃষ্ণের ৪৬। সময়টি বিদ্যাসাগরের জীবনের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলার পর্ব। বিদ্যাসাগর তখন জীবন্ত কিংবদন্তি। কলকাতার বাইরে থেকে মানুষ কলকাতা এলে কালীঘাটের মন্দির যেমন দেখতে যায়, তেমনি দেখতে যায় বিদ্যাসাগরকে। কোনো পুণ্যের যোগ না থাকা সত্ত্বেও মানুষ তাঁর ছাপানো ছবি পয়সা দিয়ে কিনে ঘরে টাঙিয়ে রাখে। ইতিমধ্যে রানি রাসমণির মন্দিরের পূজারি গদাধর চট্টোপাধ্যায়ও রামকৃষ্ণ পরমহংসে পরিণত হয়েছেন। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির অনেকের জন্যই তীর্থে পরিণত হয়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামকৃষ্ণের এই সাক্ষাতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর চার বছরের মধ্যে ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিদ্যাসাগর’ বইতে এভাবে আছে:
‘পরমহংস আসিবামাত্র বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে সমাদরে গ্রহণ করিবার জন্য অগ্রসর হইবেন, অমনি পরমহংস বিদ্যাসাগর সমীপে গৃহতলে উপবিষ্ট হইয়া বলিলেন, “খানা ডোবা খাল বিল পার হইয়া এইবার সাগরে আসিয়া পড়িলাম।” প্রত্যুত্তরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন, “এসে পড়েছেন, আর তো উপায় নেই, দুই-এক ঘটি নোনা জল তুলিয়া লইয়া যান, এ সাগরে নোনাজল ভিন্ন আর কিছুই পাইবেন না।” পরমহংস বলিলেন, সাগর তো কেবল লবণের নহে, ক্ষীর-সমুদ্র, দধি-সমুদ্র, মধু-সমুদ্র প্রভৃতি আরও অনেক সমুদ্র আছে। আপনি তো আর অবিদ্যার সাগর নহেন, আপনি বিদ্যার সাগর। আপনাতে রত্ন লাভই হইয়া থাকে, যখন আসিয়াছি রত্নই লইয়া যাইব। নোনা জল কেন তুলিব?” এইরূপ কথা-কাটাকাটির পর পরস্পরের কথাবার্তা খুব জমিয়া গেল, আলাপও বহুক্ষণ ধরিয়া হইল। নিকটস্থ সকলে সে আলাপে পরম তৃপ্তি অনুভব করিলেন।’

তবে এই সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ আছে ‘শ্রীম’ ছদ্মনামে রামকৃষ্ণের এক পরম ভক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখা পাঁচ খণ্ডের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ গ্রন্থে। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর ২২ বছর এবং বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯০৮ সালে এই বইয়ের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। যার প্রথমেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামকৃষ্ণের সাক্ষাতের দীর্ঘ বিবরণ আছে।

দুই.

কারও মতে অজ্ঞেয়বাদী, কারও মতে নাস্তিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হিন্দু সাধু রামকৃষ্ণের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তাঁর সম্পর্কে তিনি তেমন জানতেনও না। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের হেডমাস্টার মহেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলে তিনি মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেমন পরমহংস? তিনি কি গেরুয়া পরে থাকেন?’

বিদ্যাসাগরের দেওয়া সময়ে, ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট বিকেল চারটায়, মহেন্দ্রনাথ ও আরও দুজনকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন—এ জন্য রামকৃষ্ণ একটু স্নায়ুর চাপে ছিলেন বোধ হয়। আসার পথে গাড়িতে প্রথমে ‘বালকের ন্যায় আনন্দে গল্প করিতে করিতে’ এলেও একটু বাড়ির কাছাকাছি এসে চিন্তিত ও ‘ভাবাবিষ্ট’ হয়ে পড়েন। বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সময় মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেন, ‘জামার বোতাম খোলা রয়েছে, এতে কিছু দোষ হবে না?’

তবে বিদ্যাসাগরের প্রতি রামকৃষ্ণের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। তিনি বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য এবং লোকহিতকর নানা কাজ সম্পর্কে অনেক শুনেছিলেন। অবশ্য যে আরেকটি কারণে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তা হলো, বিদ্যাসাগরকে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে আমন্ত্রণ জানানো।

মাহিষ্য কৈবর্ত শ্রেণির নারী, কলকাতার জানবাজারের রানি রাসমণি গঙ্গার তীরে একটি মন্দির স্থাপন করেন। কিন্তু একজন শূদ্র নারীর বানানো মন্দিরে পৌরোহিত্য করতে কোনো ব্রাহ্মণ রাজী হচ্ছিলেন না। অবশেষে রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নামের একজন ব্রাহ্মণ মন্দিরের পুরোহিত হতে রাজী হন। সেই রামকুমারের ছোট ভাই ছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। রামকুমারের মৃত্যুর পর গদাধর নিজেই মন্দিরের পূজাকার্যে নিয়োজিত হলেন এবং একসময় তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংস হিসেবে আবির্ভূত হন। রামকৃষ্ণ সে সময়ের বিখ্যাত অনেক লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন, আবার অনেক বিখ্যাত লোক তাঁর কাছে গেছেন, তাঁর গ্রাম্য সরলতায়, একধরনের ধর্মীয় উদারতায় ও কথাবার্তায় তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং আধ্যাত্মিকতায় আশ্রয় খুঁজেছেন। এভাবে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বকে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে নিয়ে যেতে পারলে সেটি সে সময় রামকৃষ্ণের মুকুটে একটি দামি পালক গুঁজে দিত।  

রামকৃষ্ণ পরমহংস

তিন.

বিদ্যাসাগরের দেওয়া সময়ে, ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট বিকেল চারটায়, মহেন্দ্রনাথ ও আরও দুজনকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন—এ জন্য রামকৃষ্ণ একটু স্নায়ুর চাপে ছিলেন বোধ হয়। আসার পথে গাড়িতে প্রথমে ‘বালকের ন্যায় আনন্দে গল্প করিতে করিতে’ এলেও একটু বাড়ির কাছাকাছি এসে চিন্তিত ও ‘ভাবাবিষ্ট’ হয়ে পড়েন। বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সময় মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেন, ‘জামার বোতাম খোলা রয়েছে, এতে কিছু দোষ হবে না?’

সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার প্রথম ঘরটিতে বিদ্যাসাগর দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণকে অভ্যর্থনা জানান। কথোপকথন শুরু করার আগেই রামকৃষ্ণ আবার ‘ভাবাবিষ্ট’ হলেন, বললেন, ‘জল খাব।’ বিদ্যাসাগর ব্যস্ত হয়ে জল দিতে বললেন, বর্ধমান থেকে আসা মিষ্টিও খেতে দিলেন।
বিদ্যাসাগরের প্রশংসা দিয়ে শুরু করেন রামকৃষ্ণ:

রামকৃষ্ণ: ‘আজ সাগরে এসে মিললাম। এত দিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি, এইবার সাগর দেখছি।’
বিদ্যাসাগর: (সহাস্যে), ‘তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান!’
রামকৃষ্ণ: না গো! নোনা জল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর! তুমি ক্ষীরসমুদ্র!
বিদ্যাসাগর: ‘তা বলতে পারেন বটে।’  

এই কথোপকথনে বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছিলেন। কিন্তু তাঁর চেয়ে ষোলো বছরের বড়, সে সময়ের কলকাতার সম্ভবত সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে রামকৃষ্ণ ‘তুমি’ করে সম্বোধন করছিলেন। এ রকম সৌজন্যহীনতা সাধু, পীরদের মধ্যে দেখে আমরা অভ্যস্ত। ভক্তদের তুলনায় নিজেদের কৃত্রিমভাবে ঊর্ধ্বে স্থাপন করার এটি একটি তরিকা বটে!

এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই সাক্ষাৎ আর কথোপকথন হয়েছে একজন ইহবাদী, সেক্যুলার ও মুক্তবুদ্ধির মানুষের সঙ্গে একজন কালী উপাসকের; তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদের সঙ্গে একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন ব্যক্তির। অলৌকিকতায় সামান্যতম বিশ্বাসহীন একজন ব্যক্তির সঙ্গে যিনি দেখা করতে এসেছেন, তাঁর যখন-তখন, যত্রতত্র নানা ‘অলৌকিক’ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। অবতারবাদের ধারণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন, এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে যিনি সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, ভক্তদের কাছে তিনি স্বয়ং ‘অবতার’!

সংস্কৃত দর্শনের দুর্ধর্ষ পণ্ডিত বিদ্যাসাগরকে রামকৃষ্ণ নানা দার্শনিক বিষয়েও জ্ঞান দিলেন! ভক্তিবাদের রহস্য সম্পর্কে নীতি-উপদেশ দিয়ে বোঝাতে চাইলেন পাণ্ডিত্য-পুঁথিগত বিদ্যা অসার, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করা উচিত, মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার অর্থ নেই, ঈশ্বর ভক্তিই আসল। রামকৃষ্ণ সেদিন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে পাঁচ ঘণ্টা ছিলেন। প্রায় পুরো সময় তিনিই কথা বলেছেন, বিদ্যাসাগর অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে শুনে গেছেন, মৃদু হেসেছেন, মাত্র কয়েকটি বাক্য বলেছেন। এই বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলন করার বা বহুবিবাহ রোধ করার পক্ষে হিন্দুশাস্ত্র ধরে বিতর্ক করে কত বড় বড় পণ্ডিতকে ধরাশায়ী করেছেন, কিন্তু তিনি রামকৃষ্ণের সঙ্গে কোনো তর্কে জড়ালেন না। ভাবের জগতে বিরাজ করা একজন আধ্যাত্মিক সাধুর ভাবের কথাবার্তার জবাব দিয়ে তাঁর সঙ্গে বিতর্কে জড়ানোর অসারত্ব বিদ্যাসাগর বিলক্ষণ বুঝতেন।

শেষে ঈশ্বর প্রশ্নে বিদ্যাসাগরকে রামকৃষ্ণ সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা তোমার কী ভাব?’ বিদ্যাসাগর প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা, সে কথা আপনাকে একলা একলা একদিন বলব।’

যাওয়ার সময় হলে রামকৃষ্ণ আসল কথা পাড়লেন। বিদ্যাসাগরকে এবার ‘আপনি’ করে সম্বোধন করে বললেন,

রামকৃষ্ণ: ‘একবার বাগান দেখতে যাবেন? রাসমণির বাগান? ভারি চমৎকার জায়গা!’

লক্ষণীয় যে তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন না। রাসমণির বাগানে যেতে বলেছেন, যেখানে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। কারণ, বিদ্যাসাগর কোনো মন্দিরে যান না, পূজা-আর্চা করেন না, উদারহস্তে দান-দক্ষিণার জন্য বিখ্যাত হলেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এক পয়সা দেন না—এসব হয়তো তাঁর জানা ছিল।

রামকৃষ্ণের অনুরোধের জবাবে সৌজন্যের খাতিরে বিদ্যাসাগর বললেন, ‘যাব বই কি। আপনি এলেন আর আমি যাব না।’  

রামকৃষ্ণ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বিদ্যাসাগর আগে আগে বাতি দেখিয়ে নিয়ে যান। এক ফাঁকে মহেন্দ্রনাথকে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করেন, গাড়িভাড়া দিয়ে দেবেন কি না। উত্তরে মহেন্দ্রনাথ জানান, সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

রামকৃষ্ণ গাড়িতে ওঠার পর শ্রীম-এর ভাষায়, ‘বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য সকলে ঠাকুরকে প্রণাম করেন।’ বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিত্ব এবং সাধু-ধর্মপ্রচারকদের প্রতি তাঁর মনোভাব সম্পর্কে যাঁরা সামান্য অবহিত, তাঁরা জানেন সাধু রামকৃষ্ণকে পদস্পর্শ করে প্রণাম করা কতটুকু অসম্ভাব্য ছিল। পরবর্তীকালে কোনো কোনো লেখক বলেছেন, বিদ্যাসাগর হয়তো রামকৃষ্ণকে নমস্কার করেছিলেন।

চার.
সেদিন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রামকৃষ্ণের কৌতূহল মেটেনি। নিজের সীমিত ও একমুখী সরল চিন্তা দিয়ে তিনি বুঝতে পারেননি বিদ্যাসাগরের মতো এত বড় পণ্ডিত এত দান-দক্ষিণা করা একজন লোক কীভাবে ঈশ্বরচিন্তাবিমুক্ত থাকতে পারেন। তাই এই সাক্ষাতের পর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, আরও দু-একবার তাঁর বিদ্যাসাগকে দেখা দরকার। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। তবে রামকৃষ্ণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন বিদ্যাসাগরের দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার। কিন্তু সৌজন্যের খাতিরে যাবেন বললেও, যৌক্তিক কারণেই মুক্তচিন্তার আধুনিক মানুষ বিদ্যাসাগর একজন কালীসাধকের কাছে যাওয়ার কোনো আগ্রহ বোধ করেননি। অপেক্ষা করে করে রামকৃষ্ণ অধৈর্য হয়ে মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর সত্য কথা কয় না কেন?...সেদিন বলেছিল আসবে কিন্তু এলো না।...পণ্ডিত আর সাধুতে অনেক তফাত।’

১৮৮৬ সালের পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের শ্যামাপুকুর শাখার পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হলে অসন্তুষ্ট বিদ্যাসাগর ইঙ্গিতে হেডমাস্টার মহেন্দ্রনাথকে এই বার্তা দেন যে স্কুলের দায়িত্বে অবহেলা করে ‘পরমহংসদেবের’ দরবারে এত আনাগোনা তিনি অনুমোদন করেন না। এই কথা শুনে মহেন্দ্রনাথ চাকরিতে ইস্তফা দেন। তত দিনে বিদ্যাসাগরকে জয় করার সব আশা রামকৃষ্ণ ছেড়ে দিয়েছেন।

বিদ্যাসাগর সম্পর্কে  তিনি নানা মন্তব্য করতে শুরু করেছেন, যা খুব সৌজন্যমূলক নয়। মহেন্দ্রনাথ মাস্টার বিদ্যাসাগরের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন শুনে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘বেশ করেছ, বেশ করেছ, বেশ করেছ।’
বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সেদিনের সাক্ষাতের পর রামকৃষ্ণ চার বছর বেঁচে ছিলেন, বিদ্যাসাগর বেঁচে ছিলেন প্রায় ৯ বছর। কিন্তু ‘রাসমণির চমৎকার বাগানে’ বেড়াতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন বিদ্যাসাগর অনুভব করেননি। রামকৃষ্ণ সম্পর্কে এর পর তিনি কোনো আগ্রহও দেখাননি, তাঁর সম্পর্কে কখনো কোনো মন্তব্যও করেননি।

কিন্তু বিদ্যাসাগর-রামকৃষ্ণের এই সাক্ষাতের ঘটনা শ্রীম নানা পর্বে ভাগ করে যেসব শিরোনাম দিয়েছেন, তাতে মনে হয় রামকৃষ্ণের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর ভক্তিযোগের ক্লাস করছেন এবং দীর্ঘ ধর্মোপদেশের সেশন শেষে বিদ্যাসাগর অনেকটা ‘ঠাকুরের’ ভক্তের পর্যায়ে নেমে এসেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীম-এর বর্ণনায় যথেচ্ছ রং চড়ানো, মিথ্যার মিশেল দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ইউটিউবে ছড়ানো ‘রামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগর’ নামের তিন পর্বের এক তথ্যচিত্রে রামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিতে স্বয়ং ভগবান বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যাসাগরের বাড়ি থেকে রামকৃষ্ণের বিদায় নেওয়ার শেষ দৃশ্যের বর্ণনায় বলা হচ্ছে:
‘বিদ্যাসাগর (ঘোড়ার গাড়ির) দরজায় এগিয়ে গেলেন। তাঁর হাতে বাতিটি ধরা। বাতির অল্প আলোয় ঠাকুরের মুখটি দেখলেন। তাঁর সমস্ত অন্তর লুটিয়ে পড়ল শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে। শ্রীরামকৃষ্ণের গাড়িটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে। তিনি একা ঠাকুরের সেই চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁর মনে হলো, ভগবান এসেছিলেন। একঝলক দেখা দিয়ে চলে গেলেন।

তারই আশীর্বাদ হয়ে যেন স্বর্গ থেকে নেমে এল ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বৃষ্টির জলে নিভে গেল বিদ্যাসাগরের হাতের বাতি। অন্ধকারে একা বিদ্যাসাগর। রামকৃষ্ণ ধারায় কত দিন পরে এমনভাবে প্রাণ জুড়াচ্ছে তাঁর।’

এসব মিথ্যাচারের উদ্দেশ্য যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগরকে ও সাধু রামকৃষ্ণকে একই ফ্রেমে বন্দী করে উপস্থাপন করে রামকৃষ্ণের ভক্তিবাদের মাহাত্ম্য কীর্তন। অবশ্য যাঁরা রামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগর দুজনকে নিয়েই চলতে চান, তাঁদের কাছে এ ধরনের মিথ একটি স্বস্তির ব্যাপার। তাই আশীষ লাহিড়ী লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদ আর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তিবাদ একই মোহনায় এসে মিশেছিল, এই গল্পটি চালু করে দিতে পারলে আমাদের দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার নীতিবোধ পরম স্বস্তি লাভ করবে।’ (আশীষ লাহিড়ী: শ্রীরামকৃষ্ণের আকুতি, বিদ্যাসাগরের উপেক্ষা। জন্মদ্বিশতবর্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আনন্দ পাবলিশার্স।)  

বিদ্যাসাগর এ দেশের মানুষকে সব রকমের কুসংস্কার, আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতা থেকে মুক্ত করে ইহজাগতিক ও মানবিক যুক্তিবাদী করে তুলতে চেয়েছিলেন। আর বিদ্যাসাগর মানুষকে যা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, রামকৃষ্ণ মানুষকে সেদিকেই টেনেছিলেন। তিনি তাঁর ভক্তদের ভক্তিবাদের নামে আধ্যাত্মিকতা, অলৌকিকতার ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তায় মজিয়ে ছিলেন। তাঁদের দুজনকে এক পাল্লায় তোলার কোনো উপায় নেই।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ: প্রাবন্ধিক
mufad.dhaka@gmail.com  
(বিদ্যাসাগর ও রামকৃষ্ণের সাক্ষাতের বর্ণনা ও কথোপকথন শ্রীম-রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ থেকে নেওয়া হয়েছে।)