অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

কেমন ছিল সেকালে বাংলার কোরবানির ঈদ

বিশ শতকের আগে বাংলা অঞ্চলে ঈদুল আজহা আজকের মতো বড় উৎসব ছিল না। কেমন ছিল তখনকার বাংলার কোরবানির ঈদ? বিভিন্নজনের আত্মস্মৃতি ও স্মৃতিকথায় ধরা আছে সে সময়ের ঈদের টুকরো ছবি।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কোরবানী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ অর্থাৎ কোরবানি কোনোভাবেই রসনাতৃপ্তি কিংবা জাগতিক প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে বাছবিচারহীন পশু হত্যার উৎসব নয়, এর মর্মমূলে রয়েছে সত্যানুসন্ধান ও মানবিক শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান। আরেকটি কবিতা ‘শহীদী ঈদ’–এ বিষয়টি আরও খোলাসা করেছেন নজরুল, ‘মনের পশুরে করো জবাই, পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।’

বাংলায় কোরবানির ঈদের উৎস সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বিবরণ পাওয়া যায় না। বিশ শতকের আগে ঈদুল ফিতর যেমন কোনো বড় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়নি, তেমনি হয়নি ঈদুল আজহাও। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর বাংলাদেশের উৎসব (১৯৯৪) বইয়ে লিখেছেন, ‘আজকে আমরা যে ধুমধামের সঙ্গে ঈদ-উল আজহা পালন করি, তা চল্লিশ–পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্যমাত্র।’ দেড় শ-দু শ বছর আগে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ তেমনভাবে উদ্‌যাপিত না হওয়ার কারণ ছিল দারিদ্র্য ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। দুটি ঈদেরই প্রধান আনুষ্ঠানিকতা ছিল মাঠে গিয়ে নামাজ পড়া এবং খাওয়াদাওয়া। গরু কোরবানি দেওয়া কিংবা সাড়ম্বরে মাংস বিতরণ করার ব্যাপারটি তখন একরকম দুর্লভ ঘটনা ছিল। কারণ, হিন্দু জমিদার–অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডে গরু কোরবানি দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এ জন্য অনেকে গরুর বদলে বকরি কোরবানি দিত, সেই থেকে ঈদুল আজহার আরেক নাম দাঁড়ায় বকরি ঈদ। তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে এই বৈরী আবহাওয়া কাটতে শুরু করে। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনী আত্মকথায় লিখেছেন, ‘মোহররম পর্বে আমাদের বাড়িতে এত ধুমধাড়াক্কা হইলেও দুই ঈদে কিন্তু অমন কিছু হইত না। বকরী ঈদে প্রথম প্রথম দুই–তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানী হইত।’

ঈদুল ফিতরের মতো বকরি ঈদে মাসব্যাপী প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপার নেই। এই ঈদের মুখ্য বিষয় হচ্ছে, কোরবানির জন্য গরু-ছাগল কেনা। সেকালে অনেকে গৃহপালিত পশু কোরবানি দিতেন, অনেকে কৃষকের থেকে কিনতেন। যেহেতু প্রিয় বস্তু কোরবানি করা উত্তম, সেহেতু কেনা পশুটির যত্নআত্তির কমতি ছিল না। কেউ কেউ মাসখানেক আগে থেকেই পশু কিনে নিজের সন্তানের মতো দেখভাল করতেন। দারিদ্র্যের কারণে যাঁরা কোরবানি দিতে পারতেন না, তাঁদের বাড়িতে মাংস পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ত্রিশের দশকে মফস্‌সলের সম্পন্ন পরিবারে কীভাবে কোরবানির ঈদ উদ্‌যাপিত হতো, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় জাহানারা ইমামের অন্য জীবন বইটিতে। তিনি কোরবানির ঈদের খুঁটিনাটি তুলে ধরে লিখেছেন, ‘কোরবানীর সময় দেশের বাড়িতে যে চমকপ্রদ উৎসবটা হ’ত, সেটা ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নিঃসন্দেহে বিরাট আকর্ষণের ব্যাপার। কোরবানীর সময় তিনটে গরু, গোটা পাঁচ-ছয় ছাগল/খাসী কোরবানী দেওয়া হ’ত। এত বেশি পরিমাণে পশু কোরবানীর কারণ হ’ল গোষ্ঠীর লোকসংখ্যার বহর...কোরবানীর সময় আমাদের বাড়িতে চালের আটার রুটি বানানো হ’ত—সে একটা দেখবার মতো জিনিস। রসুনের খোসার মতো পাতলা রুটি। ধবধবে সাদা এবং সুগোল। বাড়ির মেয়েরা আগের রাত বারোটা–একটার সময় দহলিজের সামনের সেই যে কাজীর পুকুর, সেই পুকুরটায় গোসল করে আসতেন। কাজী পুকুরের শানবাঁধানো ঘাট ছিল, চারকোনা পুকুরটির পাড়গুলি উঁচু ছিল, পানি ছিল পরিষ্কার টলটলে। রাতদুপুরে পর্দার হানি হবে না বলেই বোধ হয় দাদাজানের অমত ছিল না বাড়ির বউঝিদের পুকুরে গোসল করতে যেতে দিতে। গোসল করে বাড়িতে এসে নতুন শাড়ি পরে বউ-বিবিরা ওজু করে বিসমিল্লা বলে কোরবানীর রুটি বানাতে বসতেন। আগের দিনই ঢেঁকিতে আটা কোটানো হয়েছে। রুটি বানানো হত দু’শো তিন’শো! সেই জন্যই বোধকরি আগের রাত থেকে শুরু হ’ত এই ম্যারাথন রুটি বানানো।’

সেকালে রুটি ও মাংসই ছিল কোরবানির ঈদের প্রধান খাবার। আত্মীয়স্বজন শুধু নয়, পাড়া-প্রতিবেশী আর অভাবী লোকদেরও রুটি ও মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।

তখনকার মানুষেরা খাওয়ার দিক থেকে যেমন ছিলেন বেহিসাবি, তেমন আয়োজনের দিক থেকেও অকৃপণ। এক বসাতেই এক কেজি মাংস ও ২০টি রুটি পেটে চালান করে দিয়েছেন—এমন খাদকের সংখ্যা ছিল অঢেল। পশু জবাইয়ের আগে যে বিষাদঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, পরবর্তীকালে তা এসব খাবারদাবারের উৎসাহের ভেতর দিয়ে পুরোপুরি তলিয়ে যেত। আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী কাল নিরবধিতে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘বকরিদে আমরা প্রতিবছর কুরবানি দিতাম না, মাঝে মাঝে তা বাদ পড়ত ভক্তির অভাবে অতটা নয়, যতটা সামর্থ্যের অভাবে। বড়রা চেষ্টা করতেন, পশু জবাই থেকে আমাদের আড়াল করতে। আমরা ছোটরা ততোধিক উৎসাহে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে জবাই দেখে ফেলতাম। দেখার পরে কিন্তু অনেকক্ষণ বিষাদে মন ছেয়ে যেত। তবে শেষ পর্যন্ত এই বিষণ্নতা পেছনে ফেলে দেখা দিত কুরবানির গোশত খাওয়ার উৎসাহ।’

তবে খাবারের বাহুল্য সত্ত্বেও কারও মনের গহিনে প্রিয় পশুটি হারানোর ক্ষত দীর্ঘদিন পর্যন্ত লেগে থাকত। ষাটের দশকে রংপুরের এক কৃষক পরিবারে কোরবানির ঈদের দিন এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল। লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খানের একটি লেখা থেকে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে একটি গরুকে বড় করেছিলেন ফজল মিয়া নামের এক ব্যক্তি।

তবে কোরবানি ঈদের ঠিক আগে আগে সন্তানের মতো বড় করে তোলা গরুটি বিক্রি করে যখন তিনি বাড়ি ফিরলেন, তখন তাঁর অবস্থা মৃতপ্রায়। কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছিলেন না প্রিয় গরুটির স্মৃতি! অবশেষে ঈদের দিন সেই গরু কোরবানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও চিরবিদায় নেন!

অতটা জোরালো না হলেও কবি জসীমউদ্‌দীনের গরুপ্রীতি নিয়েও মর্মভেদী গল্প আছে। তাঁর স্ত্রী মমতাজ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সেই কীর্তিকাণ্ডের কথা: তখন গ্রীষ্মকাল।

কোরবানির ঈদের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। প্রতিবেশীরা সাধ্যানুযায়ী গরু অথবা খাসি কিনে বাড়ি ফিরছে। কবির ছেলেমেয়েদেরও খুব শখ যে তাদের বাড়িতেও গরু অথবা খাসি কোরবানি হোক। তাই তারা বাবাকে বারবার অনুরোধ করে যাচ্ছে যেন একটি গরু কেনা হয়। ছেলেমেয়ের কথায় কবি একচোট হেসে বললেন, ‘আমার ঘরে তোরা কেমন নিষ্ঠুর ছেলেমেয়েরে যে সবাই গরু জবাই করে বলে আমরাও করব। আজ যদি আমরা একটা গরু বাঁচাই, তাহলে কেমন হয়? আমার খুব ইচ্ছা কোরবানির জন্য যত গরু হাটে আসে সবগুলিই কিনে এনে আমি পুষি। কিন্তু আমার যে এত টাকা নেই! তবে একটি কাজ তো অনায়াসে করতে পারি, জবাই না করে অন্তত একটি গরু বাঁচাতে পারি। তোদের মার সঞ্চিত টাকা থেকে যদি আমাকে কিছু টাকা গরু কেনার জন্য ধার দেয় তাহলে ভালো হয়।’

কাছেই ছিলেন কবিপত্নী। কবি আসলে কথাগুলো এমনভাবে বলছিলেন যাতে তাঁর পত্নীর কাছ থেকে এ ব্যাপারে সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো সাড়া না পাওয়ায় কবি বললেন, ‘আমাকে যদি সাহায্য কর, এতে তোমারও অনেক পুণ্যি হবে।’ কবিপত্নী তখন হেসেই অস্থির। তিনি মজা করার জন্য গোপনে জমানো টাকা থেকে মাত্র ১১০ টাকা কবির হাতে তুলে দিলেন। তিনি জানতেন, এই টাকা দিয়ে বড়জোর একটা বাছুর কেনা যেতে পারে।

কিন্তু কবি সেই টাকা নিয়েই ছুটলেন গাবতলীর হাটে। কবিপত্নী ভেবেছিলেন কবি কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে বাড়ি ফিরবেন। বেলা গড়াতে লাগল। সন্ধ্যার আগে ছেলেমেয়েরা হইচই করে সামনের বাগানের দিকে ছুটল। কবিপত্নীও ওদের পিছু পিছু পা বাড়ালেন। হঠাৎ দেখলেন গেট খুলে মালি রশি ধরে একটি সাদা গরু টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসছে। একই সময় কবি একটি বেবিট্যাক্সি থেকে নামলেন এবং গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাড়িতে ঢুকলেন। কবি তাঁর পত্নীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘আজ আমার ভাগ্যি ভালো, হাটে যেয়ে অনেক গরু দেখে এই গরুটাই পছন্দ হয়েছে। যদিও একটু শুকনা আর কাঠি-কাঠি ভাব আছে, তবে কিছুদিন যত্নআত্তি করলে এবং ঘাস-ভুসি খাওয়ালে শীঘ্রই মোটাতাজা হয়ে উঠবে।’ কবির কথা শুনে এবং হাড়জিরজিরে গরুর চেহারা দেখে কবিপত্নী হাসবেন না কাঁদবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। তিনি কড়া গলায় বললেন, ‘আমার জন্য একটা ল্যাংড়া আধমরা গরু নিয়ে এসেছ, তা–ও আবার আমার জমানো টাকায় কেনা। আমি হলে আধপয়সা দিয়েও এমন গরু কিনতাম না। দাও এক্ষুনি আমার সব টাকা ফেরত দাও।’ কবি হেসে বললেন, ‘তুমি এত রেগে গেলে কেন? দেখো, গরুটির কাছে এসে গায়ে হাত দিলে কেমন গলা উঁচু করে আদর চায়।’ এ কথা শুনে কবিপত্নীর রাগ আরও বেড়ে যায়।

তিনি আরও কড়া গলায় বললেন, ‘তোমার আদরের নিকুচি করি। আমি চললাম আমার বাপের বাড়ি।’ আসলেই সেবার তিনি তাঁর বাপের বাড়ি চলে গেলেন। ফিরলেন দুদিন পর। ফিরেই দেখলেন এলাহি কাণ্ড। ডাক্তার, বৈদ্য, ওষুধপথ্যি, গরম পানি, তুলা, ব্যান্ডেজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। যেন নাওয়াখাওয়ার সময় নেই। কবি তাঁর পত্নীকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘দুই দিনেই গায়ের খুব উন্নতি হয়েছে, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। ওর নাম রেখেছি গৌরী।’

গৌরী আসলেই সেরে উঠল। একে একে গোলগাল তিনটি বাচ্চা দিল সে। কিন্তু একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেল। দাঁড়াতে পারে না, খেতে পারে না, বাচ্চাকে দুধ দেয় না। ডাক্তার এল। চিকিৎসা হলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। গৌরীর রোগমুক্তির জন্য কবি বাড়িতে মুর্শিদা গানের আসর বসালেন। গানের সুরে সুরে জিকির করলেন। শেষ রাতে আকুল প্রার্থনা ও চিৎকার করে মোনাজাত করতে লাগলেন। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। কবির প্রিয় গৌরী চলে গেল চিরতরে। আর কবি কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলেন। কবির এই অবস্থা দেখে তখন কেউ হাসছিলেন আবার কেউ কাঁদছিলেন।

বাঙালির ঘরে ঘরে অনুসন্ধান করলে এমন আরও অসংখ্য গল্প মিলবে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে। এখন কোরবানির পশুর বাজার আরও প্রসারিত হয়েছে। বড় বড় হাট বসে পথে পথে। হৃষ্টপুষ্ট গরুর গলায় ঝোলানো হয় বাহারি মালা। নাটক, বিজ্ঞাপন ও অনলাইনের মিম কালচারেও গরুর জয়জয়কার। গরুর নাম দেওয়া হয় তারকাদের নামে—শাকিব খান, জায়েদ খান, পরীমনি, বুবলী ইত্যাদি! বিত্তবানেরা এসব গরু লাখ লাখ টাকায় কিনে নেন। কোথাও কোথাও গরু কেনার ধুন্ধুমার প্রতিযোগিতাও লেগে যায়। এত সব আড়ম্বরের মধ্যে একটি প্রশ্ন তাড়া করে ফেরে, আমরা আমাদের মনের পশুকে ঠিকঠাক জবাই করতে পারি কি?