অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

গরম কত রকমের

গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রাণ যখন অতিষ্ঠ, তখন আকাশে জমতে শুরু করেছে কালবৈশাখীর মেঘ। ঝড়ের আগে আগে এই গরমে গরম নিয়ে আরেকটু মাতা যাক। গরম কত রকমের হতে পারে, বাংলায় গরমের রূপ কেমন?

গরমে ঘাম হয়। এই ‘ঘাম’ শব্দের ব্যুৎপত্তি ধরা হয় সংস্কৃত ‘ঘর্ম’। এমনকি ‘গরম’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিও মনে করা হয় ‘ঘর্ম’। তাহলে সংস্কৃত ভাষায় গরমে আর ঘামে কোনো পার্থক্য নেই। ‘গরম’ শব্দটি প্রায় একই উচ্চারণে হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি ভাষাতেও আছে। ভারতবর্ষ পার হয়ে আরেকটু পশ্চিমে যান, ফারসি ভাষাতেও শব্দটি আছে। তবে উচ্চারণ আরও খানিক বদলে হয়েছে ‘গর্ম্’। প্রাচীন আবেস্তায় শব্দটি আছে ‘গারেমা’ হিসেবে। পারস্য থেকে আরও পশ্চিমে ইংল্যান্ডে ‘গরম’ অনেকখানি উচ্চারণ বদলে হয়েছে ‘ওয়ার্ম’। আর প্রাচীন গ্রিক ভাষায় শব্দটি ছিল ‘থার্মাস’, যেখান থেকে তাপ মাপার যন্ত্রের নাম হয়েছে থার্মোমিটার। 

দেখা যাচ্ছে, ভারত থেকে ইউরোপ পর্যন্ত প্রায় একইভাবে ‘গরম’ ছিল। গরম যখন ছিল, তখন ধারণা করা যায়, এর যন্ত্রণাও ছিল। প্রথম যন্ত্রণা—ঘামাচি। গরমে পিঠে ঘামাচি ওঠে। এই ‘ঘামাচি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ঘর্মচর্চিকা’ থেকে। এখন সংস্কৃতে ‘ঘর্ম’ মানে যদি একই সঙ্গে গরমও হয়, ঘামও হয়, তবে ঘামাচির কারণ গরম না ঘাম—এই নিয়ে অকারণ তর্ক হতেই পারে। তবে ঘুরেফিরে কিন্তু কথা একই। গরম থেকে ঘাম হয়, ঘাম থেকে ঘামাচি হয়। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, ঘামের কারণ গরম, আর গরমের ফল ঘামাচি। এই ঘামাচির যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে চার-পাঁচ দশক আগেও মানুষ বৃষ্টিজলের ওপর ভরসা করত। মানে, গ্রীষ্মের পরে প্রথম যে বর্ষণ হতো, সেই বৃষ্টিতে গা ভিজিয়ে ঘামাচি মারত মানুষ। তারপর যখন ট্যালকম পাউডার এল, তখন গায়ে-পিঠে মাখা শুরু হলো ঘামাচি থেকে বাঁচার জন্য। ট্যালক হলো ম্যাগনেশিয়াম সিলিকেট নামের একরকম খনিজের গুঁড়া, যা ত্বক পিচ্ছিল করে এবং ঘাম আটকে দেয়। সুতরাং পাউডারে ঘামাচি দূর না হোক, অন্তত স্বস্তি মিলল। 

এরপরও গ্রীষ্ম অস্বস্তির কাল। আর ইংরেজদের জন্য গ্রীষ্ম তো রীতিমতো ভয়াবহ ঋতু। ইংরেজরা গরমকে সহ্য করতে পারত না বলে মাস-দুমাস স্কুল বন্ধ রাখত। স্বাধীন বাংলাদেশেও আশির দশক পর্যন্ত এক মাসের গরমের ছুটির দেখা মিলত। গরমে স্বস্তি পেতে ইংরেজরা বিদ্যুৎবিহীন ভারতে হাতে টানা পাখার ব্যবস্থা করে। এসব পাখা বা পাংখা তৈরি হতো হালকা বেত বা পাতলা কাঠ দিয়ে। একেকটি পাখা ১০ ফুট থেকে শুরু করে ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো। তার সঙ্গে কাপড়ের ঝালর বা নকশা জুড়ে দিয়ে করা হতো দৃষ্টিনন্দন। তবে ঘরের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া এসব পাংখা টানার জন্য যাঁদের দায়িত্ব থাকত, তাঁরা থাকতেন দৃষ্টির আড়ালে। ঘরের বাইরে পাংখাওয়ালারা দড়ি ধরে পাখা টানতেন—কখনো বসে হাত দিয়ে, কখনো শুয়ে পা দিয়ে। 

মোগল বাদশাহরা অবশ্য ভিন্ন কৌশলে গরমকে বশ করেছিলেন। তাঁরা গ্রীষ্মকালে থাকতেন এক বাড়িতে, আর শীতকালে থাকতেন অন্য বাড়িতে। এর মানে, তাঁদের শীত আর গ্রীষ্মের থাকার জন্য আলাদা ঘর ছিল। আর সেসব ঘর তো যে-সে ঘর নয়, রীতিমতো বাদশাহর ঘর! তাই মোগল স্থাপত্যবিদদের ভাবতে হয়েছে কীভাবে ঘরগুলোকে ঠান্ডা বা গরম রাখা যায়। যেমন গ্রীষ্ম-বাড়ির ঘরের দেয়াল পাশাপাশি দুই সারিতে গাঁথা হতো, যাতে দুই দেয়ালের মাঝখানে ঠান্ডা পানি ঢেলে রাখা যায়। আর ঘরের ভেতরে বায়ু শীতল করে প্রবাহিত করার জন্য বিশেষ কায়দায় ঘুলঘুলি বানানো হতো।

সুলতান-বাদশাহদের মতো সাধারণ বাঙালির বাস্তুভিটা ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকার সুযোগ ছিল না। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় তাকে একই ঘরে কাটাতে হতো। এই অবস্থায় ঘরের সামনে গাছের গোড়ায় সে বাঁশের চটা বেঁধে বেঞ্চির মতো বানিয়েছে। দিনে-রাতে যখনই গরমে অস্থির হয়েছে, সেখানে বসে হাতপাখা ঘুরিয়েছে। এই হাতপাখা তৈরি হতো তালের পাতা দিয়ে কিংবা বেত বা কাপড়-সুতা দিয়ে। কাঠফাটা রোদে মানুষ যখন দরদর করে ঘামত, তখন সব কাজ ফেলে গাছের ছায়ায় শুয়ে–বসে বিশ্রাম নিত। গ্রীষ্মের দুপুরগুলো বিষণ্ন করে তুলত দূর থেকে ভেসে আসা ঘুঘুর ডাক। তবে চাষের ওপর নির্ভর করত যাদের জীবিকা, তাদের বিষণ্নতা বাড়িয়ে দিত গ্রীষ্মের স্থায়িত্ব। কারণ, আউশ ধানের চারা রোপণ করা হয়ে যেত এর মধ্যেই। তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে হতো বৃষ্টির।

প্রকৃতির এই ‘গরম’ মুখের কথার প্রয়োগে বিচিত্র রূপ লাভ করেছে। যেমন ধরুন, গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। মানে প্রচণ্ড দাবদাহে বুকের ভেতর থাকা প্রাণ বেরিয়ে ঠোঁটে এসে বসে! আবার ধরুন, গরম থাক আর না–ই থাক, মেজাজ বা মাথা গরম হতে সময় লাগে না। তরুণদের আবার রক্ত গরম থাকে—ভালো কথাও অনেক সময় তাদের গায়ে সয় না। সন্তান কথা না শুনলে মায়েদের আবার চোখ গরম করতে হয়। কারও কারও আছে টাকার গরম। দুই বেলা যার ঠিকমতো খাবারই জুটত না, কিছু টাকাপয়সা হলে সেও টাকার গরম দেখায়। আবার ধরুন নিত্যপণ্যের দাম যখন বেড়ে যায়, তখন বলি বাজার গরম। কোনো জিনিসেই তখন আর হাত দেওয়া যায় না। এদিকে হাত দিয়ে তাপ বুঝতে পারবেন না, তবু কিছু মসলাকে আমরা বলি গরমমসলা, কিছু কাপড়কে বলি গরম কাপড়। কিংবা ধরুন, গুরুর চেয়ে শিষ্য যদি বেশি মেজাজি হয়, তখন বলা হয় ‘সূর্যের চেয়ে বালি গরম’। 

বাংলা সাহিত্যে গরম চিত্রিত হয়েছে নানাভাবে। চর্যাপদে গ্রীষ্মের দাবদাহ ও কালবৈশাখীর সম্ভাবনার একটি দারুণ বর্ণনা আছে মহীধরপার লেখা ১৬ সংখ্যক চর্যায়, ‘খররবি-কিরণ-সন্তাপে রে গগন-গঙ্গা গই পইঠা’। এর মানে হলো প্রখর সূর্যকিরণের তাপে আকাশ-নদীতে গিয়ে পৌঁছালাম। একই চর্যায় লিখেছেন, ‘মাতেল চীঅ গয়েন্দা ধাবই।/ নিরন্তর গঅণন্ত তুসে ঘোলই’ এবং ‘কসন ঘন গাজই’। অর্থাৎ, তৃষিত মন মত্ত হাতির মতো আকাশে ঘুরে বেড়ায় এবং এই অবস্থায় কালো মেঘের গর্জন শোনা যায়। 

গ্রীষ্মের অবসানে বর্ষা আসে। কিন্তু গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত কোনো ঋতুই দরিদ্র বাঙালির জন্য সুখের ছিল না। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল–এ আছে, কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরা বলছে: 

‘পাও পোড়ে খরতর রবির কিরণ। 

শিরে দিতে নাহি আটে খুঁয়ার বসন’। 

তার মানে, সাধারণ বাঙালি একসময় খালি পায়েই হাঁটত। আর তার পরনের কাপড়ও এত দীর্ঘ হতো না, যা দিয়ে রৌদ্রতাপ থেকে বাঁচার জন্য মাথা পর্যন্ত টেনে দেওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও খানিক পরিবর্তন আসত। ব্যাধপত্নী ফুল্লরা বলছে, 

‘বৈশাখ হইল বিষ বৈশাখ হইল বিষ। 

মাংস নাহি খায় লোকে করে নিরামিষ।’ 

গ্রীষ্মকালে শাক আর ডাল ছিল প্রধান আহার্য। খনার বচনে আছে, ‘শাক, অম্বল, পান্তা—তিন ওষুধের হন্তা’। গ্রীষ্মে এসব খাদ্য শরীর সুস্থ রাখে। আরেকটি বচনে খনা বলেছেন, ‘উচ্ছের কচি, পটলের বিচি, শাকের ছা, মাছের মা—এইগুলো বেছে খা।’ কচি করলা, পাকা পটোল, ছোট শাক আর বড় মাছ দেখে খেতে বলেছেন খনা। এগুলো গ্রীষ্মকালেই ভালো পাওয়া যায়। তবে কাঁচা-পাকা ফল ছাড়া এ সময় মুখে রোচার মতো খাবার নেই বললেই চলে। 

গ্রীষ্মের দাবদাহ শুধু প্রকৃতিতে নয়, হৃদয়েও দহন তৈরি করে। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ‘ছত্রখণ্ডে’ আছে: ‘দুই পহর হইল নগর বিশালে।/ পরান বিকল হএ রবিকরজালে।।/ বড়য়ী কোঁঅলী মোএঁ রৌদ্র পরবলে।/ তে কারণে দেহ মোর ঘামে তোলবলে।।/ আন্তর পোড়এ মোর আর সব গাএ।/ সত্যে বড়ায়ি চলিতে নারো এখো পাএ।।’ রাধা বলছে: বেলা দুপুর হলো। সূর্যকিরণের জ্বালায় প্রাণ বিকল। আমি বড়ই কোমলাঙ্গী। এদিকে রোদও প্রবল, সে জন্য আমার দেহ ঘামে আপ্লুত। আমার দেহ-মন সব পুড়ে যাচ্ছে। সত্যি বলছি, বড়ায়ি, এক পা–ও আর চলতে পারছি না।

গ্রীষ্মের প্রকৃতির নিবিড় বর্ণনা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যে। জমিদারি দেখাশোনার কাজে তিনি এক দশক পূর্ব বাংলায় ছিলেন। সোনার তরী, চিত্রার মতো চৈতালি কাব্যটিও বাংলাদেশে বসে লেখা। চৈতালি কাব্যের সূচনায় লিখেছেন, ‘পতিসরের নাগর নদী নিতান্তই গ্রাম্য। ... কোনো-এক গ্রীষ্মকাল এইখানে আমি বোট বেঁধে কাটিয়েছি। দুঃসহ গরম। মন দিয়ে বই পড়বার মতো অবস্থা নয়। বোটের জানালা বন্ধ করে খড়খড়ি খুলে সেই ফাঁকে দেখছি বাইরের দিকে চেয়ে।’

এই কাব্যের ‘মধ্যাহ্ন’ কবিতায় রৌদ্রতপ্ত দুপুরের স্কেচ আছে, ‘শান্তনেত্রে মুখ তুলে/ মহিষ রয়েছে জলে ডুবি। নদীকূলে/ জনহীন নৌকা বাঁধা। শূন্য ঘাটতলে/ রৌদ্রতপ্ত দাঁড়কাক স্নান করে জলে/ পাখা ঝটপটি।’ এর সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু মিলে ‘মধ্যাহ্নের অব্যক্ত করুণ একতান’ তৈরি হয়েছে। ঘর্মক্লান্ত কবি এই কাব্যেই মেঘদূত–এর কবি কালিদাসকে স্মরণ করে লিখেছেন, ‘কোথা সেই উজ্জয়িনী—কোথা গেল আজ/ প্রভু তব, কালিদাস, রাজ-অধিরাজ।’ 

গ্রীষ্মকে পরাস্ত করতে বর্ষার জুড়ি নেই। তবে তার আগেই কালভৈরবের বেশে আসে কালবৈশাখী। কাজী নজরুল ইসলাম সেই ঝড়ের ধ্বংসলীলার মধ্যে নতুনের আগমনবার্তা শুনতে পান, ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখীর ঝড়!’ কিন্তু কালবৈশাখী কাব্যে প্রাণ-উন্মাদনার প্রতীক হতে পারে, বাস্তবে এর তাণ্ডব বিপর্যয় নিয়ে আসে। তবে গ্রীষ্মের চূড়ান্ত অবসানে ঝরঝর মধুর বর্ষণ নিয়ে বর্ষা আসে, তপ্ত মাঠঘাট ও শুষ্ক গাছপালা জলে সিক্ত হয়ে প্রাণ ফিরে পায়। এখানেই শেষ হলে কোনো কথা ছিল না। বর্ষার শেষে তালপাকা গরম নিয়ে আসে ভাদ্র মাস।