
আমাদের সোনার ছেলেরা অনেক কিছু করে। তারা যখন খুশি হল দখল করে। টেন্ডারের জন্য আবেদন করে। পদ্মা সেতুর নামে চাঁদা আদায় করে। পরীক্ষা না দিয়ে পরীক্ষায় পাস করে। এবার দেখছি তারা আমের দোকানদারিতেও নেমেছে। সোনার ছেলেরা সব কাজই করেন, শুধু লেখাপড়াটা বাদে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ঢাকার গুলশান-২ মার্কেটে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী একটি আমের দোকান দিয়েছিলেন। অনুমতি নিয়েই নাকি সেই দোকান দেওয়া হয়েছিল। সপ্তাহ দুয়েক আগে সে দোকানের মালিকদের একজন উল্টো দিকে নিজের গাড়ি ঢোকানোর চেষ্টা করলে নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেন। ব্যস, আর যায় কোথায়। মুহূর্তের মধ্যে কয়েক গাড়ি আম ব্যবসায়ী এসে হাজির। নিরাপত্তাকর্মীদের তাঁরা তো পেটালেনই, মার্কেটের ১৫টির মতো দোকান ভাঙচুর করে মুহূর্তে তাণ্ডব করে ছাড়লেন। ঘটনাটা যে সত্যি, গুলশান থানার ওসি তা স্বীকার করেছেন। এমনকি স্থানীয় ছাত্রলীগের সভাপতি বলেছেন, হ্যাঁ, গন্ডগোল হয়েছে, কিন্তু আমাদের দোকান নিয়ে ঝামেলা তো মার্কেটের মালিকপক্ষ আগেই করেছিল। তার প্রতিবাদেই না আমার দলের সদস্যরা কিছু ভাঙচুর করেছে।
ভাবুন একবার, সরকারি দলের সমর্থক, তাদের আমের ছালায় হাত দেয়, এমন সাহস কার!
আমি যেসব সোনার ছেলের কথা বলছি তাঁরা কেবল নামেই ছাত্র। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ‘স্টুডেন্ট ফ্রন্ট’ হিসেবে তাঁদের কাজ যার যার দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমর্থন জোগানো। ফলে সব বাস্তবিক অর্থে এই দলগুলো রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া অন্য কিছু নয়, যদিও রাজনৈতিক দল হিসেবে এরা কেউ নিবন্ধীকৃত নয়। আজ যাঁরা ছাত্র আগামীকাল তাঁরা নেতা। অতএব, এই দলগুলোকে বলা যায় নেতা বানানোর কারখানা। লক্ষ্য হিসেবে খুব মহৎ কিছু না হলেও মানতে হবে আমাদের মতো উঠতি গণতন্ত্রের দেশে এমন কারখানার দরকার আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লালনের চেয়ে এসব ছাত্রসংগঠন প্রধান রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করতেই অধিক আগ্রহী। যাঁরা এসব দলের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পান, তাঁরা অনেকটা গল্পের সেই আদু ভাইয়ের মতো। বছরের পর বছর গড়ায়, কিন্তু এঁদের ছাত্রত্ব আর শেষ হয় না।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় কাজ হলো ছাত্রদের নিজের মতো করে, স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখা। শুধু ক্লাসের পঠন-পাঠনই নয়, যে পৃথিবীতে তাঁদের বাস, তার সব বিষয়ে ছাত্ররা আগ্রহী হবেন, তা নিয়ে ভাববেন ও যখন সম্ভব সে বিষয়ে ব্যক্তিগত অথবা সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কোনো দলের লেজুড় হয়ে এমন কাজ করা অসম্ভব। তা ছাড়া কোনো বিষয়ে স্বাধীনভাবে, নিজেদের মতো করে ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগও এঁদের নেই। তাঁদের হয়ে ভাবনা-চিন্তার সব কাজ তো ‘আপা’ ও ‘ম্যাডামরাই’ করে রেখেছেন। আমরা জানি ছাত্ররা শিক্ষিত হোক, এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য অর্জনে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ নেই। তাদের একটাই লক্ষ্য: দল হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণে ছাত্রদের বাড়তি জোগানদার হিসেবে ব্যবহার। পুরস্কার হিসেবে রয়েছে কখনো চাঁদার বখরা, টেন্ডারের ছিটেফোঁটা, বেআইনি জায়গা দখল ইত্যাদি তোফা ব্যবস্থা।
রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে ছাত্রদের সম্পৃক্তির একটি দ্বিমাত্রিক সম্পর্কের সমীকরণ রয়েছে। এই সমীকরণে একজন পেট্রন, অন্যজন ক্লায়েন্ট। একজন হাত পেতে বসে থাকেন, অন্যজন তাতে মাঝেমধ্যে দু-চার টুকরো আধখাওয়া হাড্ডি ছুড়ে মারেন। সে হাড্ডি যাঁরা খুবলে নেন, তাঁদের অধস্তনদের মধ্যে তার ভাগাভাগি নিয়ে চলে নতুন লড়াই।
অতএব, ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যদি কোনো কথা বলতে হয় তো তা বলতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর পরিকাঠামোর ভেতরে, তার বাইরে নয়। কারণ, এই পরিকাঠামোর বাইরে ছাত্র সংগঠনগুলোর আলাদা কোনো কার্যকর অস্তিত্ব নেই। দলের সভাপতি কে হবেন, তা ঠিক করে দেন ‘আপা’ অথবা ‘ম্যাডাম’। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিটি কমিটির কে কোন পদ পাবেন, ওপর তলা থেকে গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত কুটোটিও নড়ে না। টাকার ব্যবস্থাও করেন তাঁরাই। ফলে বর্তমান বখরার রাজনীতির কাঠামোর ভেতরে থেকে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে যদি কিছু করতেই হয় তো তা করতে হবে সেই ‘আপা’ ও ‘ম্যাডামদের’ হাত ধরেই।
একসময় ছাত্ররাজনীতির কথা বললে আমাদের বুক গর্বে ভরে উঠত। আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা বলতাম, বলতাম উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের কথা। একাত্তরের আগে রাজনৈতিক লড়াইয়ের চরিত্র কার্যত শাসক-শাসিত এই ঔপনিবেশিক ডাইকোটমি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। যেহেতু শত্রু বহিরাগত, তার ব্যবহারও ঔপনিবেশিক প্রভুর মতো। প্রজাদের বাগে আনার একটা কৌশলই সে জানে—লাঠির বাড়ি ও বন্দুকের গুলি, অতএব তার বিরুদ্ধে পাল্টা শক্তি ব্যবহারে কোনো নৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেনি। ছাত্ররাও শক্তি ব্যবহারের সেই সমীকরণে অতি সহজে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের রাজনীতির চেহারা আমূল বদলে যায়। এই সময় থেকে শত্রু অথবা প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কেউই বহিরাগত নয়। এত দিন বহিরাগত শক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে উতরে গেছি, কিন্তু একাত্তরের পর দেশেই বাইরে কারও ঘাড়ে দোষ চাপানোর সুযোগ আর নেই। মজার ব্যাপার হলো, একাত্তরের পর আমাদের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলায় বটে, কিন্তু রাজনীতির এই মৌল চরিত্রের আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। বহিরাগত শত্রুর বদলে আমরা দেশের ভেতরেই নিজস্ব শত্রু আবিষ্কার করে নিই। যেহেতু এই সময় থেকে রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে ক্ষমতা অর্জন ও যেকোনো মূল্যে সে ক্ষমতা ধরে রাখা, রাজনৈতিক দলগুলোর সম্প্রসারণ বা এক্সটেনশন হিসেবে ছাত্রসংগঠনগুলোও সে লক্ষ্য অর্জনে খেলার ঘুঁটি হয়ে ওঠে। একইভাবে খেলার ঘুঁটি হয়ে ওঠে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলো, এমনকি সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো।
৪০ বছর ধরে এক অবিভাজ্য সম্পর্কের মতো এই সমীকরণ টিকে আছে, সম্ভবত টিকে থাকবে অনন্তকাল, যদি না আমরা তার পরিবর্তন চাই।
পরিবর্তনের দাবিটা আসতে হবে আমাদের—অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। যাঁরা ক্ষমতাধর তাঁদের কেউ অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হোক তা চান না। কেনই বা চাইবেন, এই ‘স্ট্যাটাস কো’ টিকিয়ে রেখেই তো তাঁরা বেশ চড়িয়ে খাচ্ছেন! কিন্তু আমরা যারা বাইরে থেকে হাঁ হয়ে এই খেলা দেখি, তাদের এই জগদ্দল পাথর মেনে নেওয়ার কারণ নেই। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা কেউ ক্ষমতার রাজনীতির অংশীদার নই, সেখান থেকে আমাদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ারও কিছু নেই। ঠিক সে কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহূত হোক, আমরা তার বিরুদ্ধে। তার মানে এই নয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ছেলেমেয়েরা রাজনীতি করবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নে তাদের অভিমত জানাবে, দাবি উত্থাপন করবে, মিটিং-মিছিল করবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক রাজনীতি প্রকাশিত হবে রাজনৈতিক দলের নির্দেশের বাইরে।
প্রত্যেক শিক্ষার্থী সম্ভাবনার অর্থে একেকজন বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাদের একটা বড় কাজই হলো ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ, সাধারণ ও বৃহত্তর স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে আঘাত করা।
যত দিন না তারা হালুয়া-রুটির রাজনীতি ও আম বিক্রির পথ থেকে সরে আসছে, ছাত্রদের পক্ষে তাদের সেই অমিত সম্ভাবনার পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব হবে না।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
l হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলামলেখক।