ঘোষণা করা হয়েছে, এখন নির্বাচনের কাল। তফসিলও হয়েছে প্রজ্ঞাপিত। আর খবরের কাগজে শীর্ষ সংবাদ—‘নিষিদ্ধ বিএনপি অফিস। ভোররাতে তছনছ। মুখপাত্র রিজভী কারাগারে।’ যে লোকটা কয়েক সপ্তাহ ধরে এ অফিসের কক্ষে মূলত অন্তরীণই ছিলেন, র্যাব-পুলিশের কড়া নজরদারিতে, তাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগ। রাজপথে বাস পোড়ানো, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি দুষ্কর্মের হোতা হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার। এবং এই সুযোগে অফিস, কাগজপত্র, সরঞ্জাম—সব তছনছ আর নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
শেষ রাতে ওই অফিসে এ ধরনের অভিযান চালানোর কথাই নয়। ওখানে অজানা অস্ত্রসম্ভার রাখার বা পলায়নের কোনো পথ নেই, তা-ও পুলিশের জানা। মই দিয়ে উঠে গেট-দরজা ভেঙে সব কক্ষ লন্ডভন্ড করা, অফিসের যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, কাগজপত্র—সব বিনষ্ট। ফার্নিচার ভাঙাচোরা। এমনকি কদাচিৎ ব্যবহূত চেয়ারপারসনের সরকারি অফিস লন্ডভন্ড। টেনেহিঁচড়ে অপ্রস্তুত রিজভীকে বিছানা থেকে উঠিয়ে প্রিজন ভ্যানে। সঙ্গে স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁর নিত্যসঙ্গী লাঠিও নিতে দেওয়া হলো না।
এসব করার উদ্দেশ্য একটাই, পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটা ভীতিকর আশঙ্কার সৃষ্টি করা। নতুন ঘোষিত মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদের বাড়িতেও তল্লাশি। তফসিল ঘোষণার পরও দুই জ্যেষ্ঠ নেতা হান্নান শাহ ও মীর নাছির গ্রেপ্তার। এর আগেও করা হয়েছিল শীর্ষতম স্থায়ী কমিটির দুজন, উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য এবং দেশনেত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীকে আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার। আরও হাজার হাজার (এক পরিসংখ্যানে প্রায় ৭০ হাজার) নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ। গুম, চোরাগোপ্তা হত্যা ইত্যাদি; সবল আকারে চলেছে হামলা, মামলা, হয়রানি। লক্ষাধিকের ওপরে জারি করা হুলিয়া, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সভা-সমিতি, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মানববন্ধন এমনকি অভ্যন্তরীণ সভা—সবই নিষিদ্ধ। যেখানে রাজনীতির কর্মকাণ্ড জোরদার হওয়ার কথা, সেখানে এসব প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডে একটা সত্যই প্রতিভাত হচ্ছে, সরকারি দল মোটেই নির্বাচনকালীন সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে রাজি নয়। তারা বরং সংলাপের লোক দেখানো কথা বলে বিএনপিকে আরও অপ্রস্তুত রাখতে চাইছে। তারপর বশংবদ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল। সরকারি দল গো-হারা পরাজয়ের ভয়ে ছলে-বলে-কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে।
প্রতিবাদে বিএনপি ও ১৮ দল হরতাল-অবরোধ পালন করছে। সহিংসতা হচ্ছে, জনদুর্ভোগের শেষ নেই। বহু ঘরেই আজ আহাজারি আর মাতম। চরম অনভিপ্রেত, পরম দুঃখজনক। ধিক্কৃত ও লজ্জাকর। প্রথম আলোর ৩০ নভেম্বরের অনলাইন ভোটে দেখা যায়, ৮২ শতাংশ ভোটে পাঠকেরা বলেছেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে, সরকার এর দায় এড়াতে পারবে না। শাহবাগে বাসে আগুন দিয়ে ১৯ জনকে দগ্ধ করার মর্মন্তুদ ঘটনার প্রক্রিয়া অনেকের মনেই প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ঘটনাটি কি সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় হয়েছে? নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এ ব্যাপারে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। হাটে-বাটে-রেলে আরও অনেক সহিংস ঘটনা মর্মন্তুদ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। জনমনে এ সম্পর্কে সমবেদনা ও সচেতনতা জানানোর জন্য নাগরিক ঐক্য করেছে সাদা পতাকার মিছিল, যোগ দিয়েছেন গণফোরামসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। নৃশংসতা পরিহার করে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। তবে সরকার যদি প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং নির্বাচন থেকে বিএনপিকে দূরে রাখার জন্য রুহুল কবির রিজভী ও অন্য শীর্ষ নেতাদের মতো দৃশ্যমান নিরপরাধ লোকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়, তাহলে তো আসল অপরাধীরা কখনো ধরা পড়বে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার সেটাই চায়।
এই সংকটময় পরিস্থিতি দেশে-বিদেশে প্রচুর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। সুধী সমাজ ও সচেতন জনগণ একবাক্যে বলছেন—সর্বদলের গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন চাই। ‘আজাওজা’র নির্বাচন নয়। প্রস্তাবিত সরকারদলীয় নির্বাচনকে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সৈয়দ আবুল মকসুদ নাম দিয়েছেন ‘আজাওজা’—আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (আত্মস্বীকৃত বেইমান), ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ (ইনু)। বস্তুত, এটা তো সরকারের মহাজোটেরই নামান্তর। ওদের একপেশে খালি মাঠের নির্বাচন কেউ চায় না। যুক্তরাষ্ট্র, ইইসি, ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তো তাদের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইকে পাঠাল, রাষ্ট্রদূত মজীনাও বহু যোগাযোগ করছেন। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের এশীয় প্যাসিফিক এলাকার পররাষ্ট্রবিষয়ক সাব-কমিটি বিশেষ সভা করেছে—আলোচ্য বিষয় Bangladesh in Turmuil, a nation on the Brink। স্টিভ স্যাবটের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় একটি সুষ্ঠু সর্বদল অংশগ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোরালো মতামত প্রকাশ করেছেন।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট একটি বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করে বর্তমানে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিহার করে সমঝোতার মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ-নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছে। জার্মানির রাষ্ট্রদূত বিএনপির নেতৃস্থানীয় কারাবন্দীদের মুক্তির দাবিই করে বসেছেন। ব্রিটেন তাদের একজন মন্ত্রীকে আবার পাঠাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংও ৪ ডিসেম্বর আসছেন। এই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত থেকে দেশকে বাঁচিয়ে যেতে হবে বলে চীন আশা প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ তো একাধিক প্রচেষ্টা করেছে—মহাসচিব বান কি মুন দুবার কড়া চিঠি দিয়েছেন, বিশেষ দূত পাঠিয়েছেন—সংলাপের মাধ্যমে আশু সমস্যার সমাধানের জন্য। মধ্যস্থতা করতে তাঁরা ইচ্ছুক বলে জানিয়েছেন। যেহেতু বাংলাদেশ প্রচুর শান্তিসেনা বিদেশে পাঠায় জাতিসংঘের উদ্যোগে, সে জন্য বোধ করি জাতিসংঘ বিশেষ করে চায় বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন হোক। জাতিসংঘের বিশেষ দূত আসবেন এ সপ্তাহেই। সম্ভবত এটাই হবে বহির্দেশীয় মধ্যস্থতার শেষ সুযোগ।
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ১৮ দলের প্রতিনিধি সমভিব্যাহারে মান্যবর রাষ্ট্রপতি সকাশে উপস্থিত হয়ে তাঁর মধ্যস্থতা ও অভিভাবকত্বে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানান। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সুধী সমাজের প্রতিনিধিরাও তা-ই করেছিলেন। সম্ভবত রাষ্ট্রপতি খবরগুলো সরকারকে সরকারিভাবে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না বা করছেন না। তিনি আবার স্বাস্থ্য উদ্ধারে কয়েক দিনের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এমতাবস্থায় মনে হচ্ছে, জাতিসংঘের বিশেষ দূতের আগমন ও মধ্যস্থতা যদি সরকারি দলকে তাদের দমন-পীড়নমূলক ব্যবস্থা ছেড়ে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন করতে উদ্বুদ্ধ করাতে পারে, তাতেই হবে আমাদের সমস্যার সমাধান।
এমতাবস্থায়, দুই পক্ষকেই দিতে হবে ছাড় এবং তা অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ নির্বাচনী সংকট নিরসনে একটি সুসংহত প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট সবার অবগতি ও বিবেচনার জন্য দিন দশেক আগে পেশ করেছিলেন। সেখানে তিনি ক্ষমতাসীন প্রধান দলের, প্রধান বিরোধী দলের ও নাগরিক সমাজের কী করণীয় হতে পারে, তা বিবৃত করেছিলেন। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, প্রথম দৃশ্যমান উদ্যোগ ক্ষমতাসীন দলকেই নিতে হবে। যেমন বিরোধীদের ওপর থেকে মামলা-হামলা উঠিয়ে নেওয়া, জনপ্রশাসনে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের কারও বিরুদ্ধে দলীয় রাজনীতির অভিযোগ থাকলে তা পরিবর্তন করা, নির্বাচন কমিশনকে আংশিক বা সম্পূর্ণ পুনর্গঠিত করা এবং প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব নির্বাহী ক্ষমতা কাটছাঁট করা অথবা নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অন্য কারও ওপর ন্যস্ত করা। বিরোধী দল নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে।
সাংবাদিক সোহরাব হাসান ‘তবু বিএনপি নির্বাচনে আসুক’ শীর্ষক নিবন্ধে (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর) বিভিন্ন জরিপের সূত্র ধরে বলেছেন, ‘এবার নির্বাচনে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা আছে।’ আমরা সবাই জানি, শুধু ‘সম্ভাবনা’ নয়, নিশ্চিত সম্ভাবনা। বিশ্লেষণমূলক এ রচনার উপসংহারে তাঁর মন্তব্য হচ্ছে, ‘সরকার চাইছে না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হোক। তাদের এই না চাওয়ার মোক্ষম জবাব হতে পারে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া। জয়ের যে সম্ভাবনা তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তা হেলায় হারানো ঠিক হবে না।’ তাঁর এই বাস্তবধর্মী পরামর্শ খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
তবে এটা দুঃখজনক, ক্ষমতাসীন দল প্রতিদিনই উগ্রতর মূর্তি ধারণ করছে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতা সম্পর্কে অনেক অযাচিত ও ভ্রান্ত কথাবার্তা বলে চলেছেন। এদিকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় বেড়েই চলেছে। শীর্ষ বর্ষীয়ান নেতাদের অহেতুক রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। লালবাগ থানা বিএনপির সহসভাপতি সাহাবুদ্দিন কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। ডিবির হেফাজতে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মীর শরাফত আলী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিএনপির প্রায় সব নেতা হয় অবরুদ্ধ, না হয় হুলিয়ার আসামি। সবাইকেই কিছুটা আত্মগোপন করে থাকতে হচ্ছে—রাস্তায় বের হলেই যে মানুষখেকো বাঘ বা মত্ত হাতি। এমনকি বেগম খালেদা জিয়াকেও ‘হুকুমের আসামি’ করার ভয় দেখানো হচ্ছে। বিএনপির কার্যালয় বন্ধ, কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় আইনবিদ অধ্যাপক শাহদীন মালিক ঠাট্টাচ্ছলেই বলেছেন—‘দেশে যে অবস্থা চলছে, তাতে বলা যায়—যাক, নির্বাচন অবাধই হবে। বাধা দেওয়ার কাউকেই তো নির্বাচনী মাঠে থাকতে দেওয়া হবে না।’
বস্তুতপক্ষে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদি এই ভ্রান্ত পথে চলে, তাহলে দেশের এবং নিজেদের জন্যও চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই চলমান সপ্তাহই এ প্রসঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: উপদেষ্টা, বিএনপির চেয়ারপারসন।