Thank you for trying Sticky AMP!!

ক্ষুদ্ররা নগণ্য থাকবে, না অগ্রগণ্য হবে?

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

ক্ষুদ্র বা নগণ্যদের গোনার তোড়জোড় এখন দেশে চলছে। যদিও প্রশ্ন থেকে যায়, যে ধরনের গোনার কাজ হচ্ছে, তা দিয়ে কতটা গোনায় নেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের? অভিধানে ‘ক্ষুদ্র’ বলতে বোঝায় ছোট, নীচ, সামান্য, অল্প ইত্যাদি যেগুলোর সমগোত্রীয় হলো ‘নগণ্য’, যার অর্থ গণনার অযোগ্য, তুচ্ছ, সামান্য, উপেক্ষা করার মতো ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সরকারিভাবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটির ব্যবহার শুরু হয় ২০১০ সালে প্রণীত একটি আইনের মাধ্যমে, যা পরের বছর সংবিধানেও ঢোকানো হয় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পরিচয়ের জন্য বরাদ্দ অন্যান্য শব্দের মধ্যে রয়েছে সরকারি ছাপযুক্ত ‘উপজাতি’ এবং ইদানীং বিতর্কিত হয়ে ওঠা ‘আদিবাসী’, যা নাকি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পদটি সৃষ্টির পেছনে একটা যুক্তি হয়তো বা ছিল এই যে এ নামে অভিহিতরা জনসংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশের মানদণ্ডে আসলেই ‘ক্ষুদ্র’। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে ২৭টি, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী যাদের মিলিত জনসংখ্যা ১৬ লাখের মতো। এদের মধ্যে জনসংখ্যা লাখের ঘরে হিসাব করা যায় মাত্র পাঁচটির মতো জনগোষ্ঠীর, বাকিদের গুনতে হয় হাজারের ঘরে এবং কিছু ক্ষেত্রে শয়ের কোঠায়। এদিকে বেসরকারিভাবে দেশে আদিবাসী জাতির সংখ্যা অন্তত ৪৫ এবং তাদের জনসংখ্যাও সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি হবে। তবে প্রকৃত জনসংখ্যা যা-ই হোক, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আপেক্ষিক অর্থে সেটিকে ‘ক্ষুদ্র’ই বলতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সংখ্যাল্পতা কি জনগণের একাংশকে সরকারিভাবে, সাংবিধানিকভাবে, বিশেষায়িত করার প্রধান মাপকাঠি হতে পারে বা হওয়া উচিত? আর ‘নৃগোষ্ঠী’ মানেই বা কী? এটা কি স্রেফ ‘উপজাতি’ শব্দের বিকল্প, যেভাবে আইন করে ‘উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের’ নাম ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ করা হয়েছিল? ‘উপজাতি’র নেতিবাচক ব্যঞ্জনা এড়ানোর লক্ষ্যে যদি ‘নৃগোষ্ঠী’ চালু করা হয়, তাহলে সংবিধানে দুটিকেই পাশাপাশি রেখে দেওয়া হলো কেন? সেখানে যে ‘জাতিসত্তা’ শব্দটিও রাখা হয়েছে, যার সরকারি ইংরেজি গোলমেলেভাবে করা হয়েছে ‘রেস’, সেটির কাজ কী? উপজাতি, জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী—এগুলো কি সমার্থক? এসব মৌলিক প্রশ্নের কোনো উত্তর সংবিধানে নেই এবং সরকারি ব্যাখ্যাও নেই। অথচ এ অবস্থাতেই চলছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের তালিকা প্রণয়নসহ তাদের ওপর জরিপ চালানোর একাধিক উদ্যোগ। যেমন সরকারিভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সংশোধিত তালিকা প্রণয়ন; ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক জরিপ’; ইউএনডিপির ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্ষমতা উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্রতম নৃগোষ্ঠীদের চিহ্নিত করার পরিকল্পনা এবং একই সংস্থার অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ওপর জরিপ।

উল্লিখিত উদ্যোগগুলোর মধ্যে সমন্বয় কতটুকু বা আদৌ আছে কি না, সেটা দেখার বিষয়। তবে অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের কাজ সচরাচর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বা গভীর বিশ্লেষণ ছাড়াই বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবেই করা হয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিচয়ের আওতায় অতীতেও বহুবার বিভিন্ন ধরনের শুমারি ও জরিপ চালানো হয়েছে। যেমন, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পর বড় আকারে বহু জরিপ করেছে এডিবি, কেয়ার, ইউএনডিপি, ব্র্যাক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। মাঝে দেশে দুটি আদমশুমারিও সম্পন্ন হয়েছে, ২০০১ ও ২০১১ সালে, কিন্তু সেই যে ১৯৯১ সালের শুমারিতে ২৭টি ‘উপজাতি’র তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তাতে পরিমাণগত বা গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকারি হিসাবে উপজাতিদের সংখ্যা রয়ে গেছে ২৭টিই এবং গুণগতভাবেও তালিকা রয়ে গেছে আগের মতোই, ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। যেমন কারও নাম এসেছে ভুল বা একাধিকবার, আবার কেউ বা তালিকাতেই নেই, যা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় উপেক্ষার নমুনা মাত্র। আসলে ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যে প্রশ্ন উঠিয়েছিলেন—বাঙালি ছাড়া এ দেশের অন্য জাতিদের পরিচয় ও অধিকারের বিষয়ে—তা তখন যেমন আমলে নেওয়া হয়নি, ৪০ বছর পরেও সেটা উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

লক্ষণীয় যে ‘জাতি’ শব্দটা বাঙালি ছাড়া অন্যদের বেলায় অথবা রাষ্ট্রীয় পরিসরের বাইরে অন্য কোনো গণ্ডিতে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে বাঙালি বিদ্বত্সমাজে যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংকীর্ণতা কাজ করে। সে তুলনায় ‘উপজাতি’ বা আদিম অর্থে ‘আদিবাসী’র ব্যবহার চলে অনেক স্বচ্ছন্দে। তবে ‘উপজাতি’কে ঔপনিবেশিকতার উপসর্গ হিসেবে যাঁরা দেখেন, তাঁদের কাছে ‘জাতিসত্তা’ই শ্রেয়। সম্প্রতি ‘জনজাতি’ শব্দটাও আমদানি করা হয়েছিল, কিন্তু তেমন বাজার পায়নি। এদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাদৃত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের নিজস্ব উদ্ভাবন ‘নৃগোষ্ঠী’, যা চালু করা হয়েছিল ইংরেজি ‘এথনিক (গ্রুপ)’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে। উল্লেখ্য, একই অর্থে ভুলে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ও ব্যবহার করেন অনেকে। যা হোক, নৃগোষ্ঠীর ঈপ্সিত অর্থ যে স্বতঃসিদ্ধ, সবার কাছে সহজে বোধগম্য, তা কিন্তু নয়। বরং শব্দটির কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ দেওয়া না থাকায়, প্রেক্ষিতভেদে যেকোনো গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা শ্রেণী—হোক জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা পেশাভিত্তিক কোনো সম্প্রদায়—অনেককেই ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলা যেতে বা হতে পারে। তা-ই ঘটেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের পাঠানো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মোট সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, যা বেশ আগে খবরে এসেছিল। তো, সেই দুই শতাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যে তালিকা পরীক্ষাধীন রয়েছে, তাতে একই জনগোষ্ঠীর নাম একাধিকবার আসার মতো সমস্যাকে বাদ দিলে অন্য যেসব প্রবণতা লক্ষ করা যায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, হিন্দু সমাজে অন্ত্যজ হিসেবে বিবেচিত অনেক সম্প্রদায়ের নাম চলে আসা, সেটা তাদের নিজেদের আগ্রহে করা হোক বা অন্য যেকোনো কারণে। আসলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কাদের বলা হবে, কীভাবে তাদের চিহ্নিত করা হবে, এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট সরকারি নির্দেশনার অনুপস্থিতিতে কেউ যদি পদটিকে বোঝে ‘ছোট/নিচু (মানুষের) জাত’ অর্থে, তাহলে অন্তত ব্যুত্পত্তিগতভাবে সেটাকে ভুল বলা যাবে না। এমনকি তালিকায় ‘খ্রিষ্টান’ নামও যে পাওয়া যায়, তা আসলে তালিকা প্রস্তুতকারীদের ধ্যান-ধারণার সীমাবদ্ধতা চেয়েও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পদের দ্ব্যর্থবোধকতাকেই বেশি তুলে ধরে। আর ধর্ম যে নৃগোষ্ঠী (এথনিক) পরিচয়ের একটা সূচক হতে পারে না, এ কথা অন্তত নৃবিজ্ঞানে বলা নেই।

স্মর্তব্য, সরকারিভাবে যাদের ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলা হচ্ছে, তাদেরকে একসময় ‘আদিবাসী’ নামেও ডাকা হতো বিশেষ বিতর্ক ছাড়াই। কিন্তু এটিকে ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহারের চল শুরু হওয়ার পর রাষ্ট্রের কর্ণধারদের মধ্যে যখন বিলম্বিত বোধোদয় হয়, আদিম অর্থে যাদের বাংলায় ‘আদিবাসী’ বলা হচ্ছিল, তারা আসলে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কিছু অধিকার—যেমন ভূমি ও ভাষা চায়, তখন বাধল গোল। আদিবাসী ধারণার বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশিত হতে থাকল জাতীয় স্বার্থের ধুয়া তুলে, জাত্যভিমানের আবহে, ‘ভূমি? ভাষা? এই অধিকারগুলো দিলে ওরা তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে!’ বর্ণবাদের সঙ্গতও শোনা যেতে থাকল, ‘ওরা তো অভিবাসী! এ দেশের ওপর “আমাদের” সমান দাবি “ওদের” নেই। বাঙালিরাই প্রকৃত আদিবাসী!’ মজার ব্যাপার হলো, এ ধরনের অবস্থান যাঁদের, যাঁরা মনে করেন ‘উপজাতি’ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু ‘আদিবাসী’ বলা যাবে না, তাঁরা অনেকে জানেনই না যে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালেই আইএলও কনভেনশন ১০৭-এ সই করে “ট্রাইবাল ও ইনডিজেনাস”দের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। সেখানে কিন্তু বলা হয়নি যে ট্রাইবালদের জন্য একধরনের অধিকার, আর ইনডিজেনাসদের জন্য আরেক ধরনের অধিকার। কাজেই আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ‘উপজাতি’দের ‘আদিবাসী’ পরিচয় মেনে নেওয়া হলে জাতীয় স্বার্থহানি হবে বলে যাঁরা যুক্তি দেখান, তাঁরা আসলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বিভিন্ন দুর্বল এবং অনেক ক্ষেত্রে হাস্যকর অজুহাত দেখিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কাজেই সরকারকে উত্সাহ দিয়ে আসছেন।

উল্লেখ্য, সংবিধানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠী নামে অভিহিত বাংলাদেশিদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো সংরক্ষণ ও বিকাশের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো তাদের ‘সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’। লক্ষণীয়, এই সংযোজনী আসলে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’-এরই সংক্ষিপ্তসার। কিন্তু উল্লিখিত জনগোষ্ঠীদের অস্তিত্বের মূল যে ভিত্তি, ভূমি ও বনের ওপর তাদের ঐতিহাসিক অধিকার, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি সংবিধানে। অন্যদিকে জাতীয়তা ও রাষ্ট্রভাষার পরিচয় এমনভাবে দেওয়া হয়েছে, যাতে মনে হয় না যে বাংলাদেশে বাঙালি ও বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কিছু কখনো ছিল বা আছে।

এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য, যাদের ‘ক্ষুদ্র’ বলা হচ্ছে, তাদের নতুন করে গোনাগুনি মাপজোখ করার আগে সত্যিকার অর্থে গোনার ব্যবস্থা করা হোক। তাদের দেখা হোক অগ্রগণ্য হিসেবে, যাতে অনস্তিত্ব ও অন্যতার কিনারা থেকে ফিরে এসে এ দেশের ইতিহাস ও মানচিত্রে তারা খুঁজে নিতে পারে তাদের ঠিকানা।

. আইনুন নাহার: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।

প্রশান্ত ত্রিপুরা: গবেষক ও প্রাক্তন শিক্ষক।