
ফোন এল, আব্বাসী ভাই, মান্না দে খুবই অসুস্থ, তাঁকে নিয়ে এক্ষুনি কিছু লিখুন এবং পাঠিয়ে দিন। বললাম, গান শুনেছি, দেখা হয়নি, কী লিখব? লিখতে পারি মুগ্ধতার কথা। তাঁর বই জীবনের জলসা ঘরে আদ্যোপান্ত মন দিয়ে পড়লাম। দু-তিন দিন পর খবর এল, লিখতে হবে না। উনি এযাত্রা বেঁচে গেছেন। অর্থ, মৃত্যু এলে শিল্পীকে স্মরণ, আগে নয়।
সংগীত যাঁর জীবনের ধ্যান, জ্ঞান, ঈশ্বর ও প্রাণবায়ু, তিনিই মান্না দে, দীর্ঘদিন রোগশায়িত। গাওয়া গানগুলো যখন বাজতে থাকে ভয় জাগে, এই বুঝি তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হবে। বয়স তো কম হলো না, ৯৪। দাপটের সঙ্গে সুরের আবাহনে বয়ে চলেছে জীবন, বৈচিত্র্যের সুরে তাঁর গাওয়া গানগুলো আমাদের সামনে খেলা করতে থাকে। যে যত শুনেছেন, তাঁর তত বেশি মনে পড়বে। যাঁরা আত্মজীবনী পড়েছেন, তাঁরা মিলিয়ে নিতে পারবেন তাঁর গানের সঙ্গে জীবনের সাযুজ্য।
গৌরীপ্রসন্ন তাঁর কিছু সেরা গানের গীতিকার। তাঁর একটি গান ‘ওগো বর্ষা, তুমি ঝরো নাকো অমন করে’। এর মুখোমুখি গজলটি ছিল এমনতর:
‘এ বাদল, তু ইতনা না বরস জো ওয়ো আ না সাকে
ও আ জায়ে তু ইতনা বরস ওয়ো জা না সাকে’
গৌরী লিখলেন:
‘ওগো বর্ষা, তুমি ঝরো নাকো অমন করে
কাছে সে আসবে তবে কেমন করে?
এলে না হয় ঝরো তখন অঝোর ধারে
যাতে সে যেতে চেয়েও যেতে নাহি পারে’
তাঁর গানগুলো যখন গাওয়া হয়, মন চলে যায় পেছন দিকে, যেমন শ্যামলগুপ্তের:
‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাব তরঙ্গে কতই খেলা, বধূ কী কূলেই বসে খেলবে শুধুই সারা বেলা’ গানটি যখনই গাই, মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা। ‘এখনো ডুব না দিলে করবে সিনান হায় গো কবে’ এর অর্থ আমরা জানতাম, কিন্তু সিনানের তখনো সময় হয়নি। তাঁর গাওয়া পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার, যেন অনেক বন্ধুকে এক করেছে’। গৌরীর লেখা: ‘যদি কাগজে লিখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে’ ও পুলকের লেখা: ‘আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে ছিল আমাদের যৌবনের সঙ্গী’ গাইলেই পুরোনো দিন ফিরে আসে।
শোনার সুযোগ যখন এল, তাঁর বয়স হয়ে গেছে। যৌবনের কণ্ঠ ও পরিবেশনা ফিরে পাওয়া অসম্ভব। হেমন্ত এ নিয়ে কোনো অনুযোগ করতেন না, বলতেন, আমার কণ্ঠের যে ঘাটতি তা পূরণ করে দেবে বাণীর গভীরতা। মান্না তা মানতেন না। বলতেন, তাতে আগের স্ফূর্তি ফিরে আসবে কী করে? তাঁর গ্রন্থে যে গানগুলোর প্রথম লাইন লেখা আছে সেগুলো পড়লেও মন ভালো হয়ে যায়। যেমন: ‘তুমি আর ডেকো না’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর’, ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’, ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’, ‘সেই তো আবার কাছে এলে’, ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে’, ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’। গানের পুরো লিস্ট দিতে গেলে পুরো পাতা ভরে যাবে।
অনুলিখন গৌতম রায়ের ভালোই, তবে দুধের স্বাদ ঘোলে উপস্থিত। মান্না দের প্রিয় বিকাশ রায়, যিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা, বলা হতো ‘বিকাশীয়’ বাচনভঙ্গি। কলকাতায় তাঁর বাসায় একদিন গিয়ে উপস্থিত, তখন মৃত্যুপথযাত্রী। তাঁর ড্রয়িংরুমে মান্না দের সঙ্গে তাঁর ছবি। ছবিতে মুখরিত বইটি, সহাস্য মহম্মদ রফি ও কৃষ্ণচন্দ্র দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মুখে সিগারেট জ্বালিয়ে দিচ্ছেন মান্না দে, যে সিগারেট মৃত্যু টেনে এনেছে হেমন্তের। তালাত মাহমুদ, মুকেশ, লতা মঙ্গেশকর ও মহম্মদ রফির ছবি একসঙ্গে। তিনি যাঁদের ভালোবাসতেন, তাঁদের কথা অনেকবার এই বইয়ের মধ্যে, যাঁদের মধ্যে ওস্তাদ দবির খান, ওস্তাদ আমন আলী খান, শচীন দেববর্মন, আশা ভোঁসলে, ওস্তাদ গোলাম মোস্তাফা খান ও উত্তমকুমার। মান্না দের গান হচ্ছে শুনলেই উত্তমকুমার কোত্থেকে উপস্থিত, একেবারে হারমোনিয়ামের সামনে। ব্যস্ত নায়ক, তাঁর সামনে যেন শিশুটি। মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার ও মান্না দে একসঙ্গে অনেক গান করেছেন। সে জলসায় কখনো যেতে পারিনি, সে দুঃখ রয়ে গেল।
স্বপ্নে দেখতে পাই মান্না দের ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দেকে, যিনি বিশাল মহিরুহ। তাঁকে দেখলে সবাই সিগারেট ফেলে দিতেন, অথচ তিনি ছিলেন অন্ধ। তাঁর অন্ধ জগৎ থেকে বের করে আনতেন সুরের কণিকা, সে সুর সমস্ত বাংলাদেশ একদিন আচ্ছন্ন করেছিল। আমার আব্বা আব্বাসউদ্দিন তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন অন্তরঙ্গতার সঙ্গে হাতে হাত রেখে। তাঁর আবক্ষ মূর্তি মান্না দের শোবার ঘরে। প্রত্যেক সংগীতপিপাসু মানুষ কৃষ্ণচন্দ্র দেকে বসিয়েছেন অন্তরের নিভৃত আসনে। কাকার কাছে যখন গান শিখতেন তখন তিনি পরিণত যুবক। কাকা জানতেন, মান্নাই তাঁর উত্তরাধিকারী।
মান্না দের স্ত্রী সুন্দরী। সুলোচনা তাঁকে বিশ্বাস করতেন। মান্না দে লিখেছেন:
‘সুলোচনা আমাকে ভরিয়ে রেখেছে তার ভালোবাসায়, পূর্ণতায়। ভালোবেসে এবং ভালোবাসায় এমনই পূর্ণ থেকেছি সারা জীবন, যে অন্য কোনো রমণীর কাছে কোনো দিন কোনোভাবে খুঁজতে হয়নি কিছু। যার শরীর-মন-প্রাণ ভরে থাকে পূর্ণতার সুগন্ধে, ভালোবাসার নিশ্চিন্ততায়, তার কি অন্য কোনো সুগন্ধে আর মন মাতে’?
প্রতিমার কণ্ঠ ভালো লাগত। একদিন প্রতিমা এসে বললেন, তুমি তো আমাকে প্রতিমা বানিয়েই ছাড়লে পুলকের গান দিয়ে। সমস্ত বাংলায় আমি সবার কাছে প্রতিমার মতো। এই সুর তুমি আমার গলায় এনে দিলে। কীভাবে দেব এর প্রতিদান?
ভালো লাগছে ভাবতে, মান্না দে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আবার তিনি হারমোনিয়ামের সামনে। তাঁর জন্য ১৫০ বছরের দরখাস্ত করলাম। অথচ এর পরও মান্না দে শত শত বছর বেঁচে থাকবেন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net