মাদক পরামর্শ সহায়তা’

ধৈর্য নিয়ে চিকিৎসা করালে মাদকাসক্তরা ভালো হয়

মাদক পরামর্শ সহায়তা
মাদক পরামর্শ সহায়তা

প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের উদ্যোগে ২০ এপ্রিল বিকেল সাড়ে চারটায় পরামর্শ সহায়তা-৩৭-এর আসরটি অনুষ্ঠিত হয় ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে। এ আয়োজনে মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। মনোরোগ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা মাদকাসক্তি নিরাময়ে তাঁদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন। পরামর্শ সহায়তা অনুষ্ঠানের আলোচিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হলোশুরুতে মোহিত কামাল সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, এটি আমাদের ৩৭তম অনুষ্ঠান। দিন দিন আপনাদের উপস্থিতি বাড়ছে। এটা আমাদের উৎসাহিত করে। একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। সেটি সফল হচ্ছে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ আলোচনার সারসংক্ষেপ প্রথম আলোয় ছাপা হয়। পত্রিকায় লেখা পড়েও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা উপকৃত হন। বিভিন্ন জেলা থেকে তাঁরা ফোন করেন। তাঁরা জানতে চান, কীভাবে ভালো থাকা যায়। আমরা ফোনে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে হতাশা বেশি কাজ করে। অনেকে মনে করেন, মাদকাসক্ত রোগীরা ভালো হন না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। হতাশ হলে চলবে না। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। ধৈর্য নিয়ে চিকিৎসা করলে অবশ্যই রোগী ভালো হবে।

প্রশ্ন: আমার এক আত্মীয় মাদকাসক্ত। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ডাক্তার। আত্মীয়কে একধরনের নেশাজাতীয় ওষুধ নিয়ে কাজ করতে হয়। সম্ভবত তিনি সে নেশায় আসক্ত হতে পারেন। ১৯৯২ সাল থেকে পেথিডিনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক নেন। তাঁকে কত দিন চিকিৎসা করাতে হবে?

উত্তর: চিকিৎসার সময় নির্ভর করে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর। প্রথমে দেখতে হবে তিনি কী মাত্রায় মাদক গ্রহণ করছেন। মাদকের ওপর কতটা নির্ভরশীল। তাঁকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনতে পারেন। তাঁর বর্তমান অবস্থা দেখব। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, কত দিন চিকিৎসা লাগবে। ১৯৯২ সাল থেকে মাদকাসক্ত। মনে হয়, আপনার আত্মীয় মাদকের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তাঁকে হয়তো কিছুটা দীর্ঘ সময় চিকিৎসা করাতে হবে। আরও বলেছেন তিনি নেশাজাতীয় ওষুধ নিয়ে কাজ করেন। তাঁকে এ কাজ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। তাঁকে হাসপাতালের অন্য কোনো বিভাগে কাজ করতে হবে। একজন নেশাসক্ত মানুষের কাজের পদ্ধতির সঙ্গে যদি নেশা থাকে, তাহলে তিনি কখনোই নেশা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন না। দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

প্রশ্ন: আমার স্বামী মাদকাসক্ত। আমার ছেলের বয়স ১২ বছর। আজকে এসেছি ছেলের জন্য। এখন ছেলেকে নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। সে জানতে চায় তার বাবার আচরণ এমন কেন? তার বাবা তার বন্ধুর বাবাদের মতো নয় কেন?

উত্তর: বাড়ির বড়দের আচরণ ছোটদের প্রভাবিত করে। বাবা ধূমপান করলে সাধারণত তাঁর সন্তানেরা ধূমপান করে। একইভাবে বড় ভাই ধূমপান করলেও দেখা যায় ছোট ভাইয়েরা ধূমপান করে। যদিও সামনে করে না। কিন্তু এগুলো তাদের প্রভাবিত করে। মা-বাবার আচরণ সন্তানদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। তাই মা-বাবাকে আচার-আচরণে সতর্ক হতে হয়। আপনার সন্তানকে তার বাবা সম্পর্কে কখনো খারাপ ধারণা দেবেন না। তিনি এখন মাদকের ওপর নির্ভরশীল। তাঁর এখনকার আচরণ স্বামী বা পিতার আচরণ নয়। তিনি ভালো মানুষ। এখন কিছুটা অসুস্থ আছেন। চিকিৎসা করালে আবার ভালো হবেন। বাবা তাকে অনেক ভালোবাসেন। একসময় তাকে চকলেট কিনে দিতেন। খেলনা কিনে দিতেন। নতুন জামা কিনে দিতেন। এ কথাগুলো তাকে বলবেন। তাহলে বাবার প্রতি আপনার ছেলের ধারণা ভালো থাকবে। সে বাবাকে চিকিৎসা করে ভালো করার চেষ্টা করবে। তাকে বলবেন, ‘চিকিৎসা করালে বাবা আগের মতো ভালো হবে। আমরা একসঙ্গে অনেক আনন্দ করব।’

প্রশ্ন: আমি মাদকাসক্ত ছিলাম। এখন ভালো আছি। ভবিষ্যতে কীভাবে ভালো থাকতে পারি? সে ব্যাপারে আমার স্ত্রীকে কিছু পরামর্শ দেবেন। যাতে আমার ভালো থাকার ব্যাপারে সে সাহায্য করতে পারে।

উত্তর: আপনি মাদকাসক্ত ছিলেন। এখন ভালো আছেন। আপনার প্রতি আমাদের সবার শুভকামনা রইল। আপনি ভালো থাকার জন্য ভালো হয়েছেন। আপনি নিজ থেকে সব সময় সতর্ক থাকবেন। মাদক যেন আর কখনো আপনাকে তাড়া না করে। মনে করেন, মাদককে চিরদিনের মতো বিদায় করেছেন। আমরা আশা করব, আপনি আর কখনো মাদক গ্রহণ করবেন না। তাহলো আপনার স্ত্রীর কোনো সহযোগিতা লাগবে না। আপনি সাহায্য গ্রহণের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনি আর কখনোই মাদক নেবেন না। তাহলে স্ত্রী কেন, কারও সাহায্যই আপনার লাগবে না। স্ত্রীকে অনুরোধ করব, আপনি সব সময় তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবেন। বিভিন্ন কারণে ঘরে ফিরতে দেরি হতে পারে। দেরি হলেই মাদক গ্রহণ করেছে, এটা ভাবার কারণ নেই। বন্ধুর মতো জানতে চাওয়া যেতে পারে, কেন দেরি হয়েছে। আবার কোনো কারণে আপনার ফিরতে দেরি হলে নিজ থেকেই দেরির কারণ স্ত্রীকে বলুন। যেকোনো কারণে কোনো সমস্যা হলে সেটি স্ত্রীকে বলুন। স্ত্রীর কোনো বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করলে স্বামীর কাছে খোলামেলা জানতে চাইবেন। এভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করে চলবেন। তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না।

প্রশ্ন: দেড় বছর হলো মাদক ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন আমি কিছু মনে রাখতে পারছি না। একটু পরপর সবকিছু ভুলে যাই।

উত্তর: মাদক ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে ভুলে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনার হয়তো কোনো এক সময় বিষণ্নতা ছিল। বা অন্য কোনো মানসিক সমস্যা ও থাকতে পারে। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপনি মাদকাসক্ত হয়েছেন। এখন মাদক ছাড়ার পর বিষণ্নতা আসতে পারে বা অন্য কোনো সমস্যা তৈরি হতে পারে। আপনি হয়তো এখন খুবই বিষণ্নতা অনুভব করছেন। মানসিক অস্থিরতার মধ্যে আছেন। সে কারণে ভুলে যেতে পারেন। বা অন্য কোনো সমস্যা থাকতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত যে মাদক ছাড়ার সঙ্গে ভুলে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু বিষণ্নতা বা অন্য কোনো সমস্যার জন্য মাদক নেবেন না। মাদক নিলে শরীর ও মন ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যা থেকে হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসুন। আমরা আপনাকে ওষুধ দেব। আপনার মানসিক সমস্যা, বিষণ্নতাসহ অন্য কোনো সমস্যা থাকলে সেটা ভালো হবে এবং আপনি ভালো থাকবেন।

প্রশ্ন: আমার স্বামী মাদকাসক্ত। তাঁর আচার-আচরণ, অনিয়মগুলো সন্তানের ওপর এসে পড়েছে। সন্তান সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। সন্তানের মেজাজ খারাপ থাকে। কাউকে সহ্য করতে চায় না। রাগারাগি করে। তার ব্যাপারে আমাদের কী করণীয়?

উত্তর: প্রথমত আপনার স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে হবে। তিনি যেন খারাপ আচরণ থেকে মুক্ত থাকেন। খুব দ্রুত হয়তো স্বামীকে ভালো করা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে আপনি আপনার সন্তানকে বেশি করে সময় দেবেন। তাকে খেলাধুলাসহ কিছুটা বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করবেন। বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবেন। এ ভাবে তার মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে হবে। আপনাদের সন্তান সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তার বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর হবে। এ বয়সটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার ভবিষ্যৎ জীবন নির্মাণের পথ তৈরি হবে এখান থেকে। তাই তাকে সুন্দরভাবে জীবনযাপনের জন্য যা কিছু করা দরকার, সেটা এখন থেকেই করতে হবে। আপনার সন্তানকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে (শ্যামলীর কাছে) জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আনতে পারেন। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত খোলা থাকে। ১০ টাকায় টিকিট করে এখানে চিকিৎসা করানো যায়। আপনি এবং আপনার ছেলে দুজনের জন্য টিকিট করবেন। আমরা আপনাদের দুজনকেই নিয়েই কথা বলব। আপনাদের সমস্যাগুলো বুঝতে চেষ্টা করব। কী করণীয়, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেব। এ প্রক্রিয়ায় আপনারা ভালো থাকবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

প্রশ্ন: আমার ভাগনে ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদক নেয়। মাঝেমধ্যে চিকিৎসা নিতে রাজি হয়। আবার কখনো কখনো একেবারেই রাজি থাকে না। তাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নেব কি না। না যেতে চাইলে জোর করে নেব কি না।

উত্তর: আপনার প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে আমাদের কাছে এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন। মাদকাসক্ত রোগীদের মুহূর্তে মুহূর্তে চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটে। কারণ, তাঁরা মাদকের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। সঠিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কিন্তু মাদকাসক্ত রোগীরা নিজের ইচ্ছায় এলে তাঁদের চিকিৎসা দ্রুত হয় এবং ভালো হয়। জোর করে আনলে সময় বেশি লাগে। কারণ, পরিবেশের সঙ্গে তাঁকে মানিয়ে নিতে অনেকটা সময় চলে যায়। এ জন্য রোগী যখনই রাজি থাকেন, তখনই তাঁকে আনা ভালো। এবং অভিভাবকদের অপেক্ষা করতে হয়। কখন রোগী নিজ থেকে চিকিৎসা নিতে চান। যে সময় তিনি নিজ থেকে চিকিৎসার কথা বলেন, তখন আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করা উচিত। আর একান্তই যদি চিকিৎসাকেন্দ্রে আসতে রাজি না হন, তাহলে তাঁকে জোর করেই ভর্তি করতে হবে। বাসা থেকে রোগীকে জোর করে নিরাময় কেন্দ্রে আনার বিশেষ ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থার সাহায্য নিতে হবে। যেভাবেই হোক হাসপাতালে এনে চিকিৎসা দিতে হবে।

প্রশ্ন: সন্তানেরা মাদকাসক্ত হচ্ছে। এর জন্য মা-বাবা বা অভিভাবকের দায় কতটুকু?

উত্তর: কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকের দায় থেকে যায়। সন্তানেরা কোথায় যায়। কী করে। কখন ফেরে। এ বিষয় অভিভাবকদের খোঁজখবর রাখা জরুরি। কাদের সঙ্গে মেশে, এ বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। অনেক মা-বাবা চাকরি বা অন্য কর্মব্যস্ততার জন্য সন্তানদের দেখাশোনা করেন না বা করতে পারেন না। ফলে সন্তানেরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। অনেক সন্তান বিষণ্নতায় ভোগে। হতাশাগ্রস্ত হয়। এসব কারণে এরা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। পরিবারে মা-বাবার খারাপ সম্পর্কের জন্যও সন্তানেরা মাদকাসক্ত হতে পারে। মা-বাবার উচিত পরিবারের মধ্যে নৈতিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবেশ তৈরি করা। যাতে সন্তানেরা ছোটবেলায় পরিবার থেকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিখতে পারে। পরিবারের শিক্ষা সন্তানদের পরিবারের বাইরের জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। মা-বাবা চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু সন্তানদের জন্য করেন। কিন্তু সন্তানদের যথেষ্ট সময় দেওয়া, সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ করে তোলা সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।

মাদকমুক্ত কয়েকজন তরুণের কথা: সন্তানদের মানসিকতা বুঝতে হবে। তাদের চিন্তাভাবনার মূল্য দিতে হবে। মা-বাবারা অধিকাংশ সময় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সন্তানদের সময় দেওয়া। অনেক মা-বাবাই যেটা করেন না। মা-বাবাকে অবশ্যই সন্তানদের জন্য সময় দিতে হবে। আমাদের বিশেষভাবে যত্ন নিতে হবে। আমাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের জীবন কীভাবে দেখতে চাই, মা-বাবাকে এ বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কোনো ভালো কাজ করলে প্রশংসা করতে হবে। তাহলে আমরা ভালো কাজ করতে আগ্রহী হই। বাবা-মায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে। বাড়ির পরিবেশ ভালো থাকতে হবে।

সঞ্চালনা: ফেরদৌস ফয়সাল l