Thank you for trying Sticky AMP!!

নওয়াজ শরিফের কঠিন সময়

নওয়াজ শরিফ

প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যদি ২০১৪ সালের দিকে তাকান, তাহলে পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র দেখতে পাবেন, যেদিকে তাঁর সরকারকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। যথা: পররাষ্ট্রনীতি, সন্ত্রাসবাদ, অর্থনীতি, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যকার সম্পর্ক এবং সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক। এসব ক্ষেত্রে তাঁর জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা দেখতে পেয়ে তিনি আস্থা বোধ করতে পারেন। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ ও তাঁর বিশ্বস্ত লোকজন দায়িত্বরত আছেন। পররাষ্ট্রনীতির দায়িত্বে আছেন পররাষ্ট্র বিভাগের দুই বর্ষীয়ান কর্মকর্তা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারতাজ আজিজ ও সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক ফাতেমি। অর্থ মন্ত্রণালয় দেখছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার। কার্যত উপপ্রধানমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে জাতীয় নিরাপত্তা/সন্ত্রাসবাদ/আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে নীতিকৌশল ঠিক করছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী জাহিদ হামিদ আর আইনজীবীদের আন্দোলনের সাবেক নেতা অ্যাটর্নি জেনারেল মুনির মালিক দেখছেন আইন। আর শরিফ ভ্রাতৃদ্বয়ের উভয়েই ব্যক্তিগতভাবে সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। গত দুই দশকে দুবারের অ্যাডভেঞ্চারিজমের অনেক তিক্ত ফলের স্বাদও তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু এই পাঁচটি বিষয়ের প্রতিটিই একটি করে বিস্ফোরণোন্মুখ বোমার মতো, দ্রুত নিষ্ক্রিয় করা না হলে সেগুলো বিস্ফোরিত হবে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ভারতের দিক থেকে। এবারই প্রথম সেই জায়গায় এসেছে আফগানিস্তান। আমেরিকান সেনাদের চলে যাওয়া শুরু হলে তালেবানের পুনরুত্থানও শুরু হবে। আফগানিস্তানের জাতীয় সামরিক বাহিনী বেশি সময় তালেবানকে সামলে রাখতে পারবে না। বিশেষত, আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি কারচুপি হয় এবং তালেবানবিরোধী জোটের ভেতরে কোন্দল বাড়ে, তাহলে তালেবানের প্রত্যাবর্তন দ্রুততর হতে পারে। আর আফগানিস্তানে যদি আবার গৃহযুদ্ধ বেধে যায়, তবে পাকিস্তানে তার নেতিবাচক প্রভাব হবে বিরাট। আফগানিস্তান থেকে দলে দলে শরণার্থীরা এসে ঢুকতে থাকবে পাকিস্তানে, বিশেষ করে আফগান সীমান্তের দুটি প্রদেশে। এটা হবে ওই দুটি প্রদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর বাড়তি বোঝা। অন্যদিকে পাকিস্তানি তালেবানও আফগানিস্তানের ভেতরে দীর্ঘ মেয়াদে ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারবে আল-কায়েদা ও আফগান তালেবানের সহযোগিতায়। ফলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার কাজটি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সেগুলো বাস্তবায়নে সাফল্য দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ ও আফগান-পাকিস্তান-তালেবানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় মীমাংসা প্রচেষ্টার মাধ্যমে তালেবানকে নিরস্ত্র করে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে সফল না হলে, এসব প্রক্রিয়ার সুবাদে তালেবান নিজেদের শক্তি বাড়ানোর সময় ও সুযোগ পাবে এবং ক্রমান্বয়ে উভয় দেশেই আধিপত্য বিস্তার করবে। তখন পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও আমেরিকা একজোট হয়েও তালেবানকে পরাস্ত করতে হিমশিম খেতে থাকবে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুতের সংকট আর বেকারত্ব। কিন্তু এই তিনটি ক্ষেত্রেই সরকারি উদ্যোগগুলো দুর্বল ও স্বল্পমেয়াদি। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো খাতে ব্যয়ের জন্য কিংবা জ্বালানি তেলের বকেয়া পাওয়া পরিশোধের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে অর্থঋণ নেওয়া হলে তো মূল্যস্ফীতি বাড়তেই থাকবে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তরের কাজ দীর্ঘায়িত হলে, কিংবা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি ও সরবরাহে বিলম্ব হলে আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সংকট মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। আর বেকার যুবকদের ঋণ দেওয়ার প্রকল্পটিও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বজনিত ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে ব্যর্থ হবে, যদি শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি না পায়। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে কোনো নীতি কিংবা সুপারিশও এ মুহূর্তে সরকারের তরফে প্রকাশ করা হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে যে বহুমুখী সংকট তীব্রতর হয়ে উঠছে, তা দেশকে কী সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা কল্পনা করাও কঠিন।
বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে সরকারের আচরণ কী হবে, সেটাও বিরাট পরীক্ষার বিষয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর বিদায়ের মধ্য দিয়ে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার প্রতি বিচারকদের ঝোঁক বিলুপ্ত হয়নি। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চাইলে বিচার বিভাগের দিক থেকে যে প্রতিরোধ আসবে, তা অবশ্যই একটা সংকটের সৃষ্টি করবে। এ রকম সংকট এড়ানোর ব্যাপারে পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে কোথাও সরকারের কোনো নীতিগত উদ্যোগের আভাস নেই।
সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহ মামলাটি বিতর্কিত। এটি পুনরায় সচল করে তাঁর বিচার করার যে উদ্যোগ শুরু করা হয়েছে, সেটি পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিকে গুরুতর প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একজন রাজনীতিপ্রবণ সেনাপ্রধানের কাছ থেকে একজন অরাজনৈতিক সেনাপ্রধানের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর মোটামুটি সাবলীলভাবে ঘটার পর একজন সাবেক সেনাশাসককে নতুন করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রতিক্রিয়া ভীষণ নেতিবাচক হতে পারে। এর ফলে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ পথভ্রষ্ট হতে পারে এবং এমনকি শেষ পর্যন্ত সরকারের আয়ু কমে যেতে পারে। এটা খুবই স্পষ্ট যে একজন সাবেক সেনাপ্রধানের বিচারের ব্যাপারে সেনাবাহিনী স্পর্শকাতর, কেননা এই বিচারের ধারায় সেনাবাহিনীর আরও অনেক অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত কর্মকর্তা চলে আসতে পারেন। জনগণও জেনারেল মোশাররফের বিচারের দাবিতে চিৎকার করছে না, বরং তাঁর শাসনামলে যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার তুলনামূলক ভালো মান ছিল, জনমনে তার স্মৃতি রয়ে গেছে। মোশাররফের বিচার-প্রক্রিয়া এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমর্থকগোষ্ঠীগুলোও সংগঠিত হতে পারে। তা ছাড়া এই মামলার কিছু ফাঁকফোকরও রয়েছে। এ মামলার বিচারকদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে, প্রশ্ন আছে এ মামলায় সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের ব্যবহার নিয়েও। যেসব বিচারপতি, জেনারেল ও রাজনীতিক ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষেত্রে জেনারেল মোশাররফকে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের নিষ্কৃতি দিয়ে শুধু মোশাররফের বিরুদ্ধে ৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করা নিয়ে বিতর্ক প্রবল।
শরিফ ভ্রাতৃদ্বয়ের জানা উচিত, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারকে অস্থিতিশীল এমনকি উৎখাত করার লক্ষ্যে দেশের ভেতরে ঝড় তুলতে পারে, পারে পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘোর সংকট সৃষ্টি করতে। তাঁদের উপলব্ধি করা উচিত যে সংবিধানের আশ্রয় নিয়ে বা অন্য কোনোভাবে অন্যদের দোষারোপ করার সময় এটা নয়। কাউকে শাস্তি দেওয়ার থেকে অনেক অনেক জরুরি কাজ এ সরকারের সামনে রয়েছে। কারণ, রাষ্ট্র ও সমাজ এ মুহূর্তে নানা রকম সমস্যা-সংকটের মুখোমুখি। ভবিষ্যতের আশা জাগিয়ে রাখার জন্য সেগুলো সমাধান করার প্রয়াসের ক্ষেত্রে আমরা সুসংবাদের অপেক্ষায় আছি।

পাকিস্তানের ইংরেজি সাপ্তাহিক ফ্রাইডে টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাজাম শেঠি: সম্পাদক, ফ্রাইডে টাইমস।