
১৯৭১ সালে একটা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় এবং একটা জাতি রাষ্ট্রের কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যেখানে মানুষ বাংলাদেশের নাম জানে না এবং দেশটি কোথায়, তা বোঝানোর জন্য মানচিত্রের কসরত দেখাতে হয়। পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমার (বার্মা) সে তুলনায় বেশি পরিচিত।
এশীয়া-প্রশান্ত মহাসারগীয় অঞ্চলে ৩০ বছর পর আরেকটা নতুন জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এর জন্ম-ইতিহাস অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। দেশটির নাম বাংলাদেশের অনেকেই জানে না। না জানাটা অবশ্য খুব দোষের নয়। নতুন দেশটির নাম তিমুর-লেস্তে। এটা পূর্ব তিমুর নামেই বেশি পরিচিত।
একটা সময় ছিল, যখন ইন্দোনেশিয়া নামে কোনো দেশ ছিল না। এখানে ছিল হাজার হাজার দ্বীপ। সংখ্যাটা ১২ থেকে ১৭ হাজার। ইউরোপের দেশগুলো তখন সমুদ্রজয়ে ব্যস্ত। সাগর পাড়ি দিয়ে তারা দূরবর্তী দেশগুলোতে যাচ্ছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে ক্রমে উপনিবেশ স্থাপন করে চলেছে। তাদের মধ্যে একটি ছিল ওলন্দাজরা। এরা হল্যান্ডের (নেদারল্যান্ডস) অধিবাসী। এরা ভারতেও এসেছিল। তবে ইংরেজদের তাড়া খেয়ে তারা পুবে চলে যায় এবং একটার পর একটা দ্বীপ দখল করে নতুন উপনিবেশ তৈরি করে। কালক্রমে এর নাম হয় ইন্দোনেশিয়া।
১৬৫১ সালে ওলন্দাজরা তিমুরের পশ্চিমে কুপাং রাজ্যটি দখল করে নেয়। এটা ছিল তিমুর দ্বীপের প্রায় অর্ধেক। তিমুরের পুবের অংশটি তখন পর্তুগিজদের দখলে। পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও ধর্মযাজকেরা ১৫৫১ সালেই সেখানে পৌঁছেছিলেন। ১৮৫৯ সালে পতুর্গালের সঙ্গে ওলান্দাজদের একটা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব তিমুর পর্তুগালের উপনিবেশ হিসেবে থেকে যায়। পশ্চিম তিমুর হয় ইন্দোনেশিয়ার অংশ। ১৯৪৫ সালে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হলে পশ্চিম তিমুর ইন্দোনেশিয়ার অংশ হিসেবেই থেকে যায়।
১৯৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল পর্তুগালে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে। একনায়ক সালাজারের পতন হয়। পর্তুগিজ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা আর উপনিবেশ রাখবে না। পঁচাত্তরের ২৮ নভেম্বর বামঘেঁষা রাজনৈতিক দল ফ্রেতিলিন এবং পূর্ব তিমুরের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার দো আমারাল একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নিকোলাও লোবাতো প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এর ফলে পূর্ব তিমুরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দেশে রাজাকারের অভাব ছিল না, তারা ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। এই সুযোগে ইন্দোনেশিয়া সৈন্য পাঠিয়ে পূর্ব তিমুর দখল করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়াকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেয়। কেননা, নতুন সরকারের ‘মার্ক্সবাদী’ হিসেবে পরিচিতি ছিল। শুরু হয় ফ্রেতিলিনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ নিহত হয়। সংখ্যাটি আড়াই লাখের মতো। স্বাধীনতার জন্য এত চড়া দাম আর কোনো জাতি দিয়েছে কি না, জানি না।
১৯৯৬ সালে পূর্ব তিমুরে মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের অগ্রবর্তী সৈনিক জোসে রামোস হোর্তা এবং রাজধানী দিলির বিশপ জিমেনেস বেলো যৌথভাবে
নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ইন্দোনেশীয় সরকার ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট পূর্ব তিমুরে গণভোটের আয়োজন করে। নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ ভোট দেন। সাড়ে আটাত্তর শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন।
ইন্দোনেশীয় বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। খেতের ফসল জ্বালিয়ে দেয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠায়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০০২ সালের ২০ মে গণপরিষদে নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয় এবং ওই দিনটি পূর্ব তিমুরে ‘স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার দিবস’ হিসেবে গণ্য হয়।
২০১০ সালে পূর্ব তিমুরে আদমশুমারি হয়। সে অনুযায়ী দেশটির লোকসংখ্যা ১০ লাখের মতো। আয়তন প্রায় ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশের প্রায় এক-দশমাংশ, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সমান। দেশটির ভূ-প্রকৃতিও অনেকটা পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। কৃষিকাজ মানুষের প্রধান জীবিকা। প্রধান ফসল ভুট্টা, ফাসাকা, ধান ও কফি। পর্তুগিজরা এসেছিল চন্দন কাঠের লোভে। চন্দনের গাছ এখন প্রায় উধাও।
দেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। মুসলমানের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। হিন্দু-বৌদ্ধ নেই।
স্থানীয় ভাষা ‘জেতুন’। একই সঙ্গে পর্তুগিজ ও ইন্দোনেশীয় ভাষার চল আছে। শহরাঞ্চলে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার আছে।
পূর্ব তিমুরের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশ থেকে বেশি। কিন্তু দারিদ্র্য প্রকট। কেননা, জাতীয় আয় চুঁইয়ে মানুষের দরজায় পৌঁছায় না। তেল-গ্যাস ও কফি রপ্তানি হয়। তেল ও গ্যাসক্ষেত্র সবই অস্ট্রেলিয়া কোম্পানিগুলোর দখলে। তারা যা রয়্যালটি দেয়, তা দিয়েই দেশের আমদানি খরচ মেটানো হয়। বাকি সবকিছুই ঘাটতি। আমদানি হয় সাধারণত ইন্দোনেশিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়া থেকে, এমনকি বোতলজাত পানি পর্যন্ত।
এ দেশে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। দলগুলোর মধ্যে চুলোচুলি লেগেই আছে। তবে আচরণ আমাদের চেয়ে অনেক ভদ্র। গবেষণার কাজে আমি সম্প্রতি পাঁচ সপ্তাহ সেখানে ছিলাম। রাস্তায় কোনো মারামারি, মানুষ পেটানো, গাড়ি ভাঙা ইত্যাদি চোখে পড়েনি। বোঝা যায়, নষ্ট রাজনীতি এখনো পূর্ব তিমুরকে গ্রাস করেনি। আরও একটা দিক দিয়ে পূর্ব তিমুর বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। দেশে স্থানীয় সরকারের কাঠামো তৈরি হয়েছে। আলদিয়া (পাড়া), সুকো (গ্রাম), উপজেলা (সাব-ডিস্ট্রিক্ট) ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার আছে।
মানুষের চেহারা অনেকটাই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মতো। ছোটখাটো গড়ন। আদি অস্ট্রেলীয়, পলিনেশিয়র ও মালয় থেকে আসা মানুষের মিশ্রণ রয়েছে। পার্লামেন্টারি ধাঁচের সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। গণপরিবহনব্যবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। মার্কিন ডলার এ দেশে স্থানীয় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহূত হয়। দিলি শহরের যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো জায়গায় ২৫ সেন্ট ভাড়া দিয়ে যাওয়া যায়। শহরে প্রধান পরিবহন হলো মাইক্রোবাস। ওরা বলে মাইক্রোলেট। ট্যাক্সি আছে প্রচুর। দূরত্বভেদে ভাড়া এক থেকে পাঁচ ডলার।
বাংলাদেশ নামটি পূর্ব তিমুরে বেশ পরিচিত। দিলি শহরে প্রায় সবাই বাংলাদেশের নাম জানে। এখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল ছিল। আমার এক সহকর্মী তাঁদের খণ্ডকালীন ‘ইন্টারপ্রেটর’ হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর কাছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অনেক প্রশংসা শোনলাম। তিনি কয়েকটা বাংলা শব্দও শিখেছেন। যেমন: বন্ধু কেমন আছ, আবার দেখা হবে ইত্যাদি। একটা সময়ে বাংলাদেশের আমিরা হক শান্তিরক্ষী মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দেখলাম বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয়।
একদিন গাড়িতে করে অফিসে যাওয়ার সময় গাড়িচালক অ্যালবেরো আমাকে বললেন, ‘জানো, আমি আমিরা হকের গাড়ি চালাতাম।’ বেশ গর্বের সঙ্গেই তিনি কথাগুলো উচ্চারণ করলেন। বিদেশে বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রশংসা শুনতে খুব ভালো লাগে। আমিরা হক আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। সে জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাই। প্রার্থনা করি, বিদেশে যাঁরা নানা কাজে যান, সবাই যেন এ রকম হন, আচরণ দিয়ে দেশের ভাবমূর্তিটা ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেন।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com