
আজ ২৪ আগস্ট ‘ইয়াসমিন হত্যা দিবস’ বা ‘নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধ দিবস’।
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট হতদরিদ্র কিশোরী ইয়াসমিনকে পুলিশ সদস্যরা জোরপূর্বক পুলিশ ভ্যানে তুলে দিনাজপুরের দশমাইল এলাকায় ধর্ষণের পর হত্যা করেন। এরপর লাশ রাস্তার পাশে ফেলে চলে যান। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দিনাজপুরবাসী। দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে উত্তাল দিনাজপুরে আন্দোলনরত জনতার ওপর গুলি চালায় পুলিশ। এতে সামু, কাদের, সিরাজসহ নাম না জানা সাত ব্যক্তির মৃত্য হয়। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদের এ ঘটনাকে স্মরণীয় করতেই প্রতিবছর ২৪ আগস্ট দিনটি ‘নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে দিনাজপুরের মানুষ দিবসটিকে ইয়াসমিন হত্যা দিবস হিসেবেই পালন করে থাকেন।
দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার রিকশাচালক মৃত এমাজ উদ্দিন ও শরিফা বেগমের একমাত্র কন্যা ইয়াসমিন বেগম। শহরের লালবাগ কোহিনূর স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত সে। বাবা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় কিশোরী ইয়াসমিনের। সংসারে অভাবের তাড়নায় সে মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে ঢাকায় যায়। ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করত সে। যে বাসায় ইয়াসমিন গৃহপরিচারিকার কাজ করত, সেই বাসার মালিকের বাড়িও দিনাজপুরে। টানা তিন বছরে একবারও দিনাজপুরে মায়ের কাছে আসা হয়নি ইয়াসমিনের। তাই বাড়িতে আসার জন্য, বিশেষ করে মাকে দেখার জন্য ভীষণ উতলা ছিল সে। গৃহস্বামী তাকে দুর্গাপূজার ছুটিতে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা ইয়াসমিন সে বাক্যে সান্ত্বনা পায়নি। সম্ভবত এ কারণেই সে ওই বছরের ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। সে উঠে পড়ে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওগামী একটি নৈশ কোচে।
১৯৯৫ সালে ২৪ আগস্ট ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশ কোচ থেকে রাত তিনটার দিকে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে নামে ইয়াসমিন। কোচের সুপারভাইজার দশমাইল মোড়ের পানদোকানি জাবেদ আলী, ওসমান গনি, রহিমসহ স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে কিশোরী ইয়াসমিনকে দিয়ে সকাল হলে মেয়েটিকে দিনাজপুর শহরগামী যেকোনো গাড়িতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু এর কিছুক্ষণের মধ্যে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার টহল পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান সেখানে আসে। তারা মেয়েটির পরিচয় জানতে চায়। একপর্যায়ে শহরের রামনগর এলাকায় বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইয়াসমিনকে পিকআপে তুলে নেয় পুলিশ। এরপর পুলিশের টহল ভ্যানটি দশমাইলের কাছে সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক স্কুলের সামনে এসে থামে।
এ সময় পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে স্কুলের মধ্যে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যা করেন। পরে তাঁরা ইয়াসমিনের লাশ দিনাজপুর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রানীগঞ্জ এলাকার একটি বাড়ির সামনে ফেলে চলে যান।
পরদিন সকালে ইয়াসমিনের লাশ মেলে। ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণ শেষে খুন হয়েছিল দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন। পুলিশের এ পৈশাচিক ঘটনা দিনাজপুরবাসীর মধ্যে জানাজানি হলে তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। হাজারো বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে প্রতিবাদী মিছিল বের করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার পুলিশ বিষয়টি সামাল দেওয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাতপরিচয় যুবতীর লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনা সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা ফাইল করে। পরে লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমান মুফিদুলের মাধ্যমে বালুবাড়ির শেখ জাহাঙ্গীর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
২৫ আগস্ট আগের দিনের ঘটনার পর পুলিশ প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া ও অন্য খাতে সরিয়ে নেওয়ার জন্য যে রহস্যময় আচরণ করে আসছিল, তার অংশ হিসেবে নিহত ইয়াসমিনকে ‘পতিতা বানু’ বানানোর চক্রান্ত চালায়। একজন পরিচিত বালিকাকে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ও ‘পতিতা’ বানানো, তাকে সর্বসমক্ষে বেআবরু করা, গোসল ও জানাজা ছাড়া লাশ দাফন করা, সেই কবরে পাহারার ব্যবস্থা নেওয়া, বানুকে মেরে কবরের লাশ বদলের পাঁয়তারা ইত্যাদি বিষয়সম্পর্কিত পুলিশ ও প্রশাসনের রহস্যময় আচরণ জনমনের কৌতূহল ও বিক্ষোভ শতগুণ জাগিয়ে তোলে।
একপর্যায়ে ২৬ আগস্ট স্থানীয় জনতা কর্তৃক রামনগর মোড়ে বৈঠক আহ্বান করে প্রচারণা চালানোর সময় কোতোয়ালি থানা এলাকায় মাইক ভেঙে দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় আশপাশের এলাকার লোকজন সংগঠিত হন। সন্ধ্যার পর রামনগর মোড়ে ইয়াসমিনের গায়েবি জানাজা শেষে রাত ১০টার দিকে প্রতিবাদী জনতা বিক্ষোভ মিছিলসহকারে কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে অভিযুক্ত তিন পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ, ন্যায়বিচার ও শাস্তি দাবি করেন। হাজারো জনতা এ সময় কোতোয়ালি থানার সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ফেলেন এবং সারা রাত থানা অবরোধ করে রাখেন। এ সময় পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও ফাঁকা গুলি করে। এতে ৮-১০ জন আহত হন।
২৭ আগস্ট শহরে থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই বেলা ১১টার দিকে ঘটনার প্রতিবাদ ও সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে একটি বিশাল মিছিল বের করলে মিছিলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। মুহূর্তেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচার গুলি চালালে সামু, কাদের, সিরাজসহ নাম না জানা সাতজন নিহত হন। আহত হন প্রায় তিন শতাধিক মানুষ। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের চারটি পুলিশ ফাঁড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন। শহরের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা (কারফিউ) জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি)। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এসব ঘটনায় দিনাজপুরবাসীর পক্ষে তিনটি মামলা করা হয়, যার মধ্যে নিরাপত্তার কারণে ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি দিনাজপুর থেকে রংপুরে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মইনুল, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও পিকআপ ভ্যানের চালক অমৃত লাল বর্মণের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান–৯৫-এর–৬(৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন আদালত। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই মইনুলকে আরও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অপর দিকে দণ্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আবদুল মোতালেব, ডা. মহসীন, উপপরিদর্শক (এসআই) মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এএসআই মতিয়ার, এসআই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাঁদের খালাস দেন।
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মামলার অন্যতম আসামি এএসআই মইনুল হক (পিতা জসিমউদ্দীন, গ্রাম বিশ্রামপাড়া, উপজেলা পলাশবাড়ী, জেলা গাইবান্ধা) ও কনস্টেবল আবদুস সাত্তারকে (পিতা এস এম খতিবুর রহমান, গ্রাম চন্দনখানা, উপজেলা ডোমার, জেলা নীলফামারী) রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিটে। অপর আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণকে (পিতা লক্ষ্মীকান্ত বর্মণ, গ্রাম রাজপুর, উপজেলা সদর, জেলা নীলফামারী) রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিটে।
নারী নির্যাতনের এই যুগান্তকারী প্রতিবাদী ঘটনাকে স্মরণীয় করতেই প্রতিবছর ২৪ আগস্ট দিনটি ‘নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে দিনাজপুরের মানুষ দিবসটি ইয়াসমিন হত্যা দিবস হিসেবেই পালন করে থাকেন। ইয়াসমিন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা ও বাস্তবায়িত হলেও আজ পর্যন্ত ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন করে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের হত্যাকারীদের বিচার হয়নি।
*আজিজুর রহমান, শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর