রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের কী হবে?

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

ফরেস্ট ইকোসিস্টেমের ‘সুশাসন’ আর সামাজিক ‘সুশাসন’ এক জিনিস নয়। প্রকৃতিতে সুশাসন মানে মানুষের শাসন না থাকা অথবা কম থাকা। যখনই সেখানে মানুষের শাসন আসে, তখনই দূষণের উপাদান পরিবেশে প্রবেশ করতে থাকে আর প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। সুন্দরবনের পাশে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তে এমনই একটি সমস্যা আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। এটি স্থাপনের ফলে প্রকৃতিতে ক্ষতি সাধিত হলে তার শতকরা ৮০ ভাগের বেশি প্রভাব পড়বে জীববৈচিত্র্যের ওপর।
জীববৈচিত্র্যের তিনটি উপাদান: স্পিসিস ডাইভারসিটি, জেনেটিক ডাইভারসিটি ও ইকোসিস্টেম ডাইভারসিটি। এর মধ্যে ইকোসিস্টেম ডাইভারসিটির ওপরই অন্য দুটি বেশি নির্ভরশীল। ইকোসিস্টেম হলো এমন এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে জৈব-অজৈব শর্তাবলির ভারসাম্যপূর্ণ মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে ও টিকে থাকে। জৈব শর্ত হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী আর অজৈব শর্তগুলো হলো তাপ, আলো, বাতাস, আর্দ্রতা ও বিভিন্ন ধরনের অজৈব রাসায়নিক উপাদান। যেহেতু এগুলোর সম্মিলিত অবস্থাই জীববৈচিত্র্য, তাই কোনো স্থাপনা থেকে যদি এদের ওপর কোনো অস্বাভাবিক প্রভাব পড়ে, তবে আমাদের জানতে হবে সেই অস্বাভাবিকতা বহন করার ক্ষমতা ইকোসিস্টেমের এই দুটি জৈব শর্তের অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে সেখানে পরিবেশের ভারসাম্য দ্রুত হারিয়ে যাবে। এ অবস্থায় জীবজগতের মধ্যে মানুষই সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

 রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক চলছে। কেউ কেউ মনে করেছেন এ কেন্দ্র নির্মাণ করলে অনেক ক্ষতি হবে, আবার অনেকে বলেছেন কোনো ক্ষতি হবে না। এই অবস্থায় প্রকৃতি কী বলছে, সে সম্বন্ধে পরিবেশবিদদের মতামত প্রকাশ করা উচিত।

সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম একটি অভূতপূর্ব, অসাধারণ, অতুলনীয় প্রাকৃতিক বায়োটিক ইউনিট। এটি পৃথিবীর আর দশটি ইকোসিস্টেম থেকে আলাদা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের। এখানে প্রজাতির আধিক্য ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্ট ইকোসিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি নয়, কিন্তু এখানে প্রজাতির সমন্বয় সাধন এত শক্তভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রোথিত যে পৃথিবীর কোথাও তার উদাহরণ নেই। জলজ ও স্থলজ বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থার বৈচিত্র্য সমগ্র সুন্দরবনকে অপরূপভাবে সাজিয়ে রেখেছে। এই বাস্তুতন্ত্রে যেমন সমুদ্রের লোনা পানি আছে, তেমনি আছে নদীর মিঠা পানিও। নদীর পানি এবং সাগরের পানি মিশ্রিত হওয়ার কারণে এখানে নদীমোহনার ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম পাঁচটি বিশিষ্ট ইকোসিস্টেমের সমন্বয় সাধন করেছে: জলজ, স্থলজ, সামুদ্রিক, নদী ও নদী-সমুদ্রের মিলনস্থল বা মোহনার ইকোসিস্টেম। এই সমন্বয়ের ফলে এখানে প্রজাতির আধিক্য বেশি, তার চেয়ে বেশি বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার আন্তক্রিয়াশীলতা। এমন প্রজাতি-বিন্যাসের কারণে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিভিন্ন খাদ্য-ধাপের মাধ্যমে সুন্দরবনে উদ্ভিদ-প্রাণীর সম্পর্ক এমন টেকসই, যার উদাহরণ পৃথিবীর অন্য কোনো ইকোসিস্টেমে আছে কি না, জানা নেই। এই ইকোসিস্টেমে উদ্ভিদের জীবনচক্রের কোনো না কোনো ধাপ তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাণীর জীবনচক্রের কোনো না কোনো দশার সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে শক্তির আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্কিত। এই আদান-প্রদানের সঙ্গে শর্ত হিসেবে যুক্ত থাকে বিভিন্ন অজৈব উপাদান। কোনো দূষণ-উপাদান এই অজৈব শর্তসমূহ নষ্ট করলে ইকোসিস্টেমটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।

পৃথিবীতে সুন্দরবন ছাড়া এমন কোনো ব ন নেই, যার প্রাকৃতিক সম্পদ সেই দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমভাবে অবদান রাখে। আর কোনো দেশের মোট মধু উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি একটি মাত্র বন থেকে আহরিত হয় না। আর কোনো বনের একটি মাত্র পতঙ্গের সঙ্গে নির্দিষ্ট কয়েকটি গাছের নিবিড় আদান-প্রদানের ওপর মধু সৃষ্টি এমনভাবে নির্ভরশীল নয়। সুন্দরবনের ৩৪ প্রজাতির বৃক্ষের ফুল থেকে এপ্রিল থেকে জুন মাসের শেষ সময় পর্যন্ত মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে। প্রশ্ন হলো, এই মধু সংগ্রহের সঙ্গে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের সম্পর্কটি কোথায় এবং এখানে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বই বা কী?

খুলশি, বাইন, কাঁকড়া, গরান, গেওয়া, গর্জন, কেওড়া, পশুর, হারগজা ইত্যাদি গাছ থেকে মৌমাছি বেশি মধু সংগ্রহ করে। সেগুলোর রেণুতে অনেক বেশি প্রোটিন থাকায় ওজনে ভারী হয় এবং বাতাসের দ্বারা বাহিত না হয়ে মৌমাছির মতো পতঙ্গের দ্বারা বাহিত হয়ে পরাগায়ন ঘটায়। অন্য দিকে এই রেণু থেকে মৌমাছি যে প্রোটিন পায় তা একাধারে তাদের খাদ্য এবং লার্ভা ও পিউপার আঙ্গিক বর্ধনের নিয়ামক।

দেখা যাচ্ছে, একটি প্রাকৃতিক নিয়মতান্ত্রিকতার মাধ্যমে ফরেস্ট ইকোসিস্টেমে মধু উৎপাদিত হচ্ছে, অন্যদিকে জিন-ফ্লোর মাধ্যমে গাছের সংখ্যা যথার্থ মাত্রায় থাকছে এবং বৃক্ষরাজি সুস্থ থাকছে। এই বাস্তুতন্ত্র শুরু হয় আণবিক পর্যায়ে এবং কাজ করে আণবিক পর্যায় থেকে কোষ পর্যায়ে, আঙ্গিক পর্যায়ে ও ব্যক্তি পর্যায়ে এবং প্রকাশ পায় গোষ্ঠী ও পপুলেশন পর্যায়ে। এ ক্ষেত্রে রেণুবাহিত হওয়া মানে আণবিক পর্যায়ে জৈবশক্তি নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে স্থানান্তরিত হওয়া। এই ক্রিয়াকে উদ্ভিদকুলে জিন-ফ্লো মেকানিজম বলা হয়। যেকোনো দূষণ-উপাদান প্রথমে এই জিন-ফ্লো মেকানিজমকে আণবিক পর্যায়ে আঘাত হানে এবং শেষ হয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটায় গোষ্ঠী ও পপুলেশন পর্যায়ে।

বড় প্রাণীদের বেলায় বাস্তুতন্ত্রে প্রাণীর খাদ্যধাপ নির্ণয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাণীর দেহে জৈবশক্তি স্থানান্তরের বিষয়টি প্রাণীর অবস্থান উদ্ভিদ থেকে কত দূরে বা নিকটে তার ওপর নির্ভরশীল। বাঘের দুই ধরনের উদ্ভিদের প্রয়োজন: এক ধরনের বৃক্ষ প্রয়োজন তার আবাস এলাকা বাসযোগ্য করার জন্য, আরেক ধরনের উদ্ভিদের প্রয়োজন হয় ঔষধি গাছ হিসেবে। সুন্দরবনে শতাধিক প্রজাতির প্রজাপতি আছে, যারা এসব ঔষধি উদ্ভিদের পাতায় ডিম পাড়ে বলে এদের এ ক্ষেত্রে নির্দেশক প্রাণী বলা হয়। বাঘের মতো হরিণেরও ঔষধি গাছের প্রয়োজন হয়।

বাঘ ও হরিণ দুটিই স্তন্যপায়ী প্রাণী কিন্তু বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থানের দিক থেকে তারা একই খাদ্য-ধাপে অবস্থান করে না। হরিণ ২ নম্বর ধাপে অবস্থান করে এবং তার ধাপটি নির্দিষ্ট। বাঘ ৩, ৪, ৫ নম্বর ধাপেও অবস্থান করতে পারে। কোনো কোনো সময় ২ নম্বর ধাপে অবস্থান করে অর্থাৎ প্রয়োজনে গাছের কিছু অংশ সে খায়। কাজেই বাঘের খাদ্যধাপ নির্দিষ্ট নয়। অতএব, যেকোনো বাস্তুতান্ত্রিক ওলটপালট বা শক্তি স্থানান্তরের ব্যাপারে দূষণ-উপাদান থাকলে তা বাঘের প্রজননের ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতি করবে। একই বাস্তুতন্ত্রে অবস্থান করলেও সব প্রাণী সমভাবে পরিবেশদূষণের শিকার হবে না। ইকোসিস্টেমে দূষণ-উপাদান কোন উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপর কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, তা সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিটি প্রজাতির ওপর আলাদা আলাদা বিশ্লেষণ করতে হবে। 

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও দূষণ-উপাদান নির্গত হওয়ার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। তবে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনার হিসাবে দেখা যায়, প্রতিবছর তা ৩৭ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার টন নাইট্রোজেন অক্সাইড, ৫০০ টন ডাস্ট-কণা, ৭২০ টন কার্বন মনোক্সাইড, ১৭০ টন মারকারি, ২২৫ পা. আর্সেনিক, ১১৪ পা. লেড (সিসা) নির্গত করবে। রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা থাকবে দুই হাজার ৬৪০ মেগাওয়াট। সুতরাং এর দূষণ-উপাদান উৎপাদনের ক্ষমতাও হবে ওপরে উল্লিখিত হিসাবের ৫ দশমিক ২৮ গুণ বেশি। অতএব, অনুমান করা যায় যে কী ভয়াবহ মাত্রার দূষণ-এজেন্ট সুন্দরবনে নির্গত হবে!

সরকারিভাবে বলা হয়, বর্জ্য অপসারণের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু যেসব দূষণ-উপাদান বাতাসে মিশে যাবে, সেগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তাহলে বর্জ্য অপসারণ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা মোটেই পরিষ্কার নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দূষণের প্রভাব জীববৈচিত্র্যের ওপর কোন পর্যায়ে কীভাবে আঘাত হানবে, সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো খবর জনগণের কাছে এখনো আসেনি। দূষণীয় বর্জ্যের প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অগ্রসর হওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। দূষণ-উপাদান কী গতিতে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে আঘাত হানবে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে।

রামসার কনভেনশন সুন্দরবনের মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ওয়েটল্যান্ড ও বনাঞ্চলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দায়িত্ব পালন করে। এই বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানটি রামপাল বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তাদের সদর দপ্তরে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে দুবার চিঠি দিয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলের কাছে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক স্থাপনা নির্মাণে বাংলাদেশ যেন অগ্রসর না হয়, সে ব্যাপারেও তারা উদ্বিগ্ন। কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটির ৪২টি ধারার মধ্যে অনেক ধারা—বিশেষ করে ৮ ও ৯ ধারায় সুন্দরবনের মতো ইকোসিস্টেম রক্ষা ও আরও শক্তিশালী করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববাসীর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে কোনো রাজনীতি বা বিভ্রান্তি চায় না। এটি স্থাপনের আগেই এর বিরূপ প্রভাব বিষয়ে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সেই অনুসারে এই সমস্যাটির আশু সমাধানই কাম্য।

l. এম এ বাশার: অধ্যাপক, প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।