Thank you for trying Sticky AMP!!

অনিশ্চয়তা ও বৈষম্য দূর করার পথ কী


২০২১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্‌যাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার ঠিক আগে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত মানুষের জীবন ও জীবকায় স্মরণকালের ভয়াবহতম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, চলমান অতিমারিসৃষ্ট অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে কী ধরনের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন? যদিও পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, তবে পুনরুদ্ধারের গতিপথের ধরন বা প্রকৃতিসংক্রান্ত বিশ্লেষণ তেমন চোখে পড়ছে না।
পুনরুদ্ধারের ধরন বিশ্লেষণ করতে হলে একাত্তরের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ‘ঘোষণাপত্রে’ উল্লেখিত তিনটি মূলস্তম্ভ—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আলোকে পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি যাচাই সম্ভব। পর্যালোচনা দরকার, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এ তিন স্তম্ভের আলোকে একটি সমতাভিত্তিক, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন, জন-আকাঙ্ক্ষার গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না।

সাম্য
সাম্যের ধারণা, মোটা দাগে নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকারসমূহে সমতা নিশ্চিতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগেই অর্থনীতিতে প্রকট অসমতা বিরাজ করছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত পরিবর্তন না হওয়ায় অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর হচ্ছিল না। তাই একসময় দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমতে শুরু করে। করোনাক্রান্তি সমাজে বিদ্যমান প্রকট অসমতা আরও উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে শহুরে ও গ্রামীণ শ্রমিকের আয় কমেছে যথাক্রমে ৮০ ও ১০ শতাংশ। উন্নয়ন অন্বেষণ হিসাব করে দেখিয়েছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গিনি সহগ দশমিক ৩২ থেকে বেড়ে দশমিক ৫০ এবং পা’মা রেশিও ২ দশমিক ৯৩ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্পদ ওপরের দিকের কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। করোনার আগেই ওপরের দিকের ১০ শতাংশ মানুষের আয় নিচের দিকের ৪০ শতাংশের আয়ের বেশি ছিল।

সরকার ঘোষিত ৫০ লাখ পরিবারকে অর্থসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হলেও অনেক মানুষ এখনো টাকা পাননি। কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়, নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে নেওয়া। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুবিধাভোগী নির্বাচন রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপ জানাচ্ছে, করোনার প্রথম চার মাসেই বেকারত্ব বেড়েছে ১০ গুণ। আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহায়তার ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়েছে। অন্যদিকে, ১১ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখেছে। সরকারি ত্রাণ বা অনুদান পেয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ পরিবার। ২০২০ সালের শুরুতে বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল প্রায় ৩ কোটি ৩৪ লাখ।

বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, কোভিড-১৯ অভিঘাতে নতুন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে ফেরত এলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যেতে পারে। কিন্তু বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো পর্যাপ্ত নয়। সরকার ঘোষিত ৫০ লাখ পরিবারকে অর্থসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হলেও অনেক মানুষ এখনো টাকা পাননি। কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়, নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে নেওয়া। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুবিধাভোগী নির্বাচন রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলেও ২০১০ থেকে ২০১৯ সময়কালে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হারে কমেছে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, করোনাক্রান্তির আগেই দেশের মহানগরগুলোতে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে খাবার না খেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটাতে হয়েছে।

মানবিক মর্যাদা
মানবিক মর্যাদা ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাষ্ট্রকে একটি সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করা মানবিক মর্যাদার অন্যতম দিক। গত ৫০ বছরে দেশে সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম না হয়ে গোষ্ঠীতন্ত্রের মাধ্যমে জোরজবরদস্তি, লুটপাট-লুণ্ঠন করে সম্পদের আদিম সঞ্চয়ন চলেছে। রাষ্ট্রক্ষমতার (অপ) ব্যবহার করে প্রভাবশালী চক্র অঢেল সম্পদের মালিক হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদনশীল কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কিছু লোকের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবন ও কেন্দ্রীকরণ আগেও ছিল, তবে আগে এত বেশি অর্থ পাচার ছিল না। অন্যদিকে ভিন্নমত-পথের ওপর চলছে রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার বারবার বিনষ্ট হয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ফলাফলের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে না পারায় একটি সমতাভিত্তিক (ইগালিটারিয়ান) গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। নাগরিক সক্রিয়তা দিন দিন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ায় জনসম্পদ ব্যবহারে রাষ্ট্রের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়নি। অথচ জবাবদিহির মাধ্যমেই জাতীয় অর্থব্যবস্থা জনগণের হয়ে ওঠে। আদিম কায়দায় সঞ্চয়ন জারি থাকায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ক্ষমতাহীন, দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে।

সামাজিক ন্যায়বিচার
সামাজিক ন্যায়বিচার মূলত ন্যায্য সামাজিক সংহতির এবং সর্বজনের সমাজকে নির্দেশ করে। সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ এবং যেকোনো ধরনের বৈষম্যের বিলোপসাধন সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি। কিন্তু বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রীয় নীতি-কাঠামোগুলো সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। উদাহরণ হিসেবে দেশে প্রচলিত কর-কাঠামোর কথা বলা যায়। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ করদাতা। সামর্থ্যবান মানুষের ৬৮ শতাংশই করের আওতায় নেই। আয়করের পরিধি বাড়ছে না। দেশের সাধারণ করদাতারাই ঋণ শোধ ও উন্নয়নের মূল উৎস হিসেবে কাজ করছেন। মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমেই ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। এ আয়-নিরপেক্ষ ভোগের ওপর ধার্যকৃত করের বোঝা পুরোটাই সাধারণ জনগণের কাঁধে। বিবিএস বলছে, ৬৭ দশমিক ১২ শতাংশ খানা সঞ্চয়ে অক্ষম। বিপরীত দিকে উচ্চবিত্তদের কর পরিহার ও ফাঁকি দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে!
আবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতে ব্যয় নামমাত্র বাড়ছে। বিবিএসের হিসাবে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ ছেলেমেয়ে (১২-১৮) মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকার কথা থাকলেও স্কুলে যাচ্ছে না, ঝরে পড়েছে। করোনায় ৬৮ শতাংশ পরিবার আর্থিক সংকটে পড়েছে। সংকট থেকে উত্তরণে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সবার কর্মসংস্থানের সুরক্ষা, অধিকারের স্বীকৃতি এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায়নি।

টেকসই পুনরুদ্ধার কৌশল
পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি হতে হবে সমতাভিত্তিক ও সর্বজনীন, যাতে সম্পদ এবং অর্থনৈতিক সুফল ও সুযোগ-সুবিধাগুলো গুটিকয়েক গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়ে সর্বজনের কাছে পৌঁছায়। অন্তত সাতটি মূলনীতির আলোকে নীতি-কৌশল নেওয়া গেলে তুলনামূলকভাবে একটি বৈষম্যহীন পুনরুদ্ধার এখনো সম্ভব। প্রথমত, সর্বজনীন প্রাথমিক আয় হিসেবে প্রতিটি নাগরিকের কাছে নগদ অর্থ পৌঁছাতে হবে। দ্বিতীয়ত, গণদ্রব্য—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সর্বজনীন করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, গোষ্ঠীস্বার্থ চিন্তা না করে সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থে নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, উৎপাদন ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে পণ্য এবং বাজারের বৈচিত্র্যকরণে গুরুত্বারোপ করতে হবে। পঞ্চমত, টেকসই ও সবুজ বিকাশের জন্য উৎপাদনব্যবস্থাকে সবুজ এবং পরিবেশবান্ধব হতে হবে। ষষ্ঠত, শুধু মুদ্রানীতিনির্ভর না হয়ে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সমন্বয়ে নতুন বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান তৈরির কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সপ্তমত, কর্মসূচি এবং নীতি নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক হতে হবে, যাতে অর্থনীতিতে গুণক প্রভাবক সৃষ্টিতে সক্ষম খাতে বিনিয়োগ বাড়ে।
জনগণ কখনো হাল ছাড়েনি
সমতাভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে প্রয়োজন নতুন ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল চিন্তা, নীতি ও আইনের সমন্বয় এবং দূরদর্শী রাজনীতি ও সঠিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত, বাংলাদেশের জনগণ কখনো হাল ছাড়েনি। যেকোনো সংকট, বঞ্চনা, অধিকারহীনতা মোকাবিলা করে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটি নাগরিক রাষ্ট্র বিনির্মাণই এ দেশের সাধারণ জনগণের মূল আশার স্থল।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন। rt@du. ac. bd