Thank you for trying Sticky AMP!!

আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ?

বাজার অর্থনীতির সূত্রগুলো বলে, যতই উৎপাদন বাড়বে, বেচাকেনা বাড়বে, ততই জিডিপি বাড়বে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উৎপাদনের চক্রের মধ্যে পড়ে পৃথিবীর মাটি, পানি, জলাশয়, বনভূমি বিপর্যস্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক চিন্তার ধরন পাল্টেছে। 

প্রতিবছর পৃথিবী থেকে ১৮ মিলিয়ন একর বনভূমি উধাও হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন পৃথিবীর ১২ কোটি গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। মহাসাগরগুলোতে প্রতিবছর ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে। সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া মাইক্রোপ্লাস্টিক মাছের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢুকে পড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত পেস্টিসাইডে পৃথিবীর প্রায় ৪০ ভাগ জমির উর্বরতা কমছে, মাটির নিচের অণুজীবগুলো মারা যাচ্ছে। আমেরিকা–ইউরোপের তিন ভাগের এক ভাগ মৌমাছি স্রেফ হারিয়ে গেছে। চীনের শত শত কৃষক প্লাস্টিকের ডিব্বায় পরাগরেণু ভরে হাতে হাতে পরাগায়ন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে টিকবে ধরণি? 

এ বছর জাতিসংঘের বায়োডাইভার্সিটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ৫০টি দেশের বিশেষজ্ঞরা মিলে হাজার পৃষ্ঠার একটি ভীতিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, খুব শিগগিরই বিশ্বের ১০ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ আর প্রাণী হারিয়ে যাবে। এমনকি পৃথিবীর নামীদামি অর্থনৈতিক ফোরামগুলো একসময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জিকির তুললেও আজকে তারা কী বলছে? বেশি বেশি উৎপাদন করুন, শপিং করুন? নাকি বলছে অপচয় বন্ধ করুন, পরিবেশ বাঁচান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করুন। 

আপনি বলবেন, আর্কটিকের পানি গলছে, এই দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশের মানুষ কি উৎপাদন বন্ধ করে দেবে? বাঘ, সিংহ, বেজি, কুমির, পোলার ভালুক বিলুপ্ত হচ্ছে, এতে কি বাংলাদেশের মানুষ বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে না? শিল্পোন্নত দেশগুলো তো একসময় এই পদ্ধতিতেই ‘উন্নয়ন’ করেছে। কয়লা পুড়িয়ে স্টিম ইঞ্জিন চালিয়েছে, লোহা বানিয়েছে। শিল্পবিপ্লবের পরে জীবনযাত্রার মান যখন বেড়েছে, কেবল তখনই পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হয়েছে তারা, কারখানার দূষণ রোধে আইন করেছে। কাজেই এটাই শিল্পায়নের একমাত্র পথ ‘পোলিউট ফার্স্ট, ক্লিন লেটার’। আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ। 

‘বাংলাদেশ একসময় ইউরোপকে ছাড়াবে’ অথবা এটাই উন্নয়ন বা শিল্পায়নের একমাত্র পথ—এমন দাবি যাঁরা করেন, তাঁরা ভুলে যান। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব হয়েছে এশিয়া-আফ্রিকার কলোনিগুলোর সম্পদ আহরণ করে, আমেরিকায় আখ, তামাক আর তুলার শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল আফ্রিকার মানুষকে বিনা মজুরির দাস বানিয়ে। অর্থাৎ, জোরপূর্বক সম্পদ আহরণের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল পশ্চিমের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। অর্থনীতিবিদ উৎসা পাটনায়েক হিসাব করে দেখিয়েছেন, ভারত থেকে ২০০ বছরে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ লুট করেছিল ব্রিটিশ সরকার। ভারতবর্ষ থেকে জাহাজে করে আনা লোহা, কয়লা আর তুলার ওপর ভিত্তি করেই ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের শুরু। এখনকার দিনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে কলোনি করে সম্পদ আহরণ সম্ভব? ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ইউরোপের মতো শিল্পবিপ্লব করতে গেলে, নগরায়ণ করতে গেলে, প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আসবে কোত্থেকে? এর ফলে যে পরিমাণ বনজঙ্গল, নদী, পাহাড়, বক্সাইট, কয়লা, সিসা, লোহা, বালু, পাথর লুট করতে হবে, যে পরিমাণ কৃষককে উচ্ছেদ করতে হবে, তার ফলাফল বহন করতে পারবে ইতিমধ্যেই দূষণের ভারে বিপর্যস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলো? 

শিল্পবিপ্লবের ২০০ বছর পরে আর্কটিক যখন গলছে, মাটির উর্বরতা কমছে, মিঠা পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিক বাড়ছে, সমুদ্রের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে আর মৌমাছিদের কলোনিগুলো ভেঙে পড়ছে; তখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘পলিউট ফার্স্ট, ক্লিন লেটার’ যে গত শতকের একটি বাতিল চিন্তা, এ কথা কে বোঝাবে এ দেশের নীতিনির্ধারকদের। 

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মৌমাছি মরলে আমাদের কী? সমুদ্র গরম হলে অর্থনীতির কী? বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিক, সমস্যা কী? 

সমস্যা কতটা গভীর, বিপর্যয় কতটুকু কাছে, এই নিয়ে সারা পৃথিবীর নীতিনির্ধারণী মহলে তোলপাড় হয়ে গেলেও ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশের নির্লিপ্ততা চোখে পড়ার মতো। 

মাছের ঠিকঠাক প্রজননের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লক্ষ কোটি উপকূলীয় মানুষের জনজীবন, মৎস্য অর্থনীতি আর অসংখ্য হোটেল-রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। বনভূমির গাছ-কাঠ-মধুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অগণিত আদিবাসীর জীবন ও অর্থনীতি। মৌমাছি আর বাঁদুরের বাঁচা–মরার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর ৭৫ ভাগ শস্যের পরাগায়ন; জড়িয়ে আছে, আলু, তুলা, টমেটো, ফুলকপির বিলিয়ন ডলারের সরবরাহ চেইন, সুপার মার্কেট–বাণিজ্য আর অগণিত কর্মসংস্থান। বাতাসে ক্রমে ছড়িয়ে পড়া ক্ষতিকর পার্টিকেলের ওপর নির্ভর করছে নাগরিক জীবনের সুস্থতা, চিকিৎসা খাতের ব্যয় বৃদ্ধি। পৃথিবীর মৌমাছি আর কেঁচোগুলো উধাও হলে, গাছগুলো কেটে ফেললে, মাছগুলো পলিথিন খেলে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলে, আমরাও যে বাঁচি না, অর্থনীতি বাড়ে না; ‘আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ’—এই ধরনের অর্থনৈতিক চিন্তাগুলো সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান মাইকেল ফ্রিডম্যান বা ওয়াল্ট রোস্টোসহ একসময়ের বাজার অর্থনীতির রকস্টার অর্থনীতিবিদেরা। 

বিপর্যস্ত পরিবেশ আর ৪ কোটি বেকারের দেশে একটি স্মার্ট সরকারের উন্নয়ন মাস্টারপ্ল্যানের মূল মনোযোগটি কোথায় হওয়া উচিত ছিল? কয়লা? নিউক্লিয়ার? চতুর্থ শিল্পবিপ্লব? অটোমেশন? ভুল নকশার ফ্লাইওভার? লুটপাট? জিপিএ ফাইভ? নাকি তরুণদের জন্য টেকসই কর্মসংস্থান, গণপরিবহন, বিশুদ্ধ পানি, ফ্রি হাসপাতাল, সৌর-বায়ু-বর্জ্য বিদ্যুৎ, রিসাইকেলিং শিল্প আর পাটকল? 

এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সময়োযোগী পলিসি এবং আর্থিক প্রণোদনার কারণে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অবিশ্বাস্য বিকাশ ঘটেছে। ভারত আর চীন নিজ নিজ দেশের শত শত কয়লা প্ল্যান্ট একে একে বন্ধ করে দিচ্ছে। ভারতে ইতিমধ্যেই ৮২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে শুধু সৌর, বায়ু, আর বায়োগ্যাস থেকে (টার্গেট: ২০২২ সালের মধ্যে ১ লাখ ৭৫ হাজার মেগাওয়াট)! সুইডেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এতটাই এগিয়েছে যে রিসাইক্লিং কারখানাগুলো সচল রাখতে দেশের বাইরে থেকে বিপুল বর্জ্য আমদানি করতে হচ্ছে। ইউরোপ জুড়ে কাগজ, প্লাস্টিক, মেটাল আর গ্লাস রিসাইকেলিং খাতে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে খাদ্য বর্জ্যের (ফুড ওয়েস্ট) প্রায় পুরোটা দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। করাচির মতো শহরেও শুধু বায়োফুয়েল দিয়ে কয়েক শ বাস চালানো হচ্ছে, গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নতির ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমেছে ২৬ শতাংশ। মাইলের পর মাইলজুড়ে সাইকেল লেন, প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়ে খাদ্য সরবরাহ, বাড়ির ছাদে, বিলে–বাঁওড়ে, কৃষিজমিতে খাদ্যশস্যের পাশাপাশি সৌর প্যানেল বসাতে আর্থিক প্রণোদনা, এমন অসংখ্য ‘স্মার্ট’ পলিসির কারণে একদিকে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল প্রযুক্তি আবিষ্কারে পাল্টে যাচ্ছে শিল্পায়নের পুরোনো ধ্যানধারণা। 

সারা পৃথিবীতে প্লাস্টিক/পলিথিনের দূষণ রোধে পাটপণ্যের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে, আর আমরা আমাদের অমূল্য সম্পদ রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলোকে একে একে বন্ধ করেছি। ভারত আয়তনে বাংলাদেশের ২২ গুণ। ভৌগোলিক অবস্থানও এক। সেই হিসাবে বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই ন্যূনতম ৪ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। অথচ সৌর ও বায়ু মিলিয়ে আমাদের উৎপাদন ৫০০ মেগাওয়াটের কম! অন্যদিকে, গত এক দশকে একটি–দুটি নয়, সর্বমোট ২৯টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি করে বসে আছে বাংলাদেশ সরকার! প্রচার চলে, সৌর এবং বায়ুবিদ্যুৎ খরচবহুল। সৌর ব্যয়বহুল, তো কয়লা নয়? নিউক্লিয়ার নয়? কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র যে বিপুল ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হয়, জানেন তো? সৌরবিদ্যুতের দাম কমতে কমতে প্রতি ইউনিট ২-৩ টাকায় নেমে এসেছে জানেন তো? সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে, ভারতে ৫৭৩টি কয়লা প্ল্যান্টের চুক্তি বাতিল করেছে সরকার। এ দেশে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে গত এক দশকে কত লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির খরচ দিন দিন বাড়ছেই। টার্মিনাল নির্মাণ আর এলএনজি আমদানিতে আগামী ১০ বছরে ব্যয় হবে কয়েক লাখ কোটি টাকা। এই সবকিছুই হবে জনগণের পকেট কেটে। জানেন তো? 

পশ্চিমের দেশগুলো অথবা হালের চীন ও ভারত যে পরিমাণ দূষণের মধ্য দিয়ে শিল্পায়ন ঘটিয়েছে, সেটুকু দূষণ করার মতো মাটি, পানি, বনভূমি অক্ষত আছে এই বাংলাদেশে? ২৫ বছরে ৬৫ হাজার হেক্টর বনভূমি গায়েব হয়েছে! স্বাধীনতার পর থেকে ৩০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি কমেছে! স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ফরেস্ট (২০১৬) বলছে, বিশ্বের ১৭টি দেশে কৃষিজমি ও বনভূমি দুই-ই কমেছে মারাত্মক হারে। আর সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম সবার শীর্ষে! 

পরিবেশদূষণে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯! কয়েক বছর ধরে দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর দেশে মারা যাচ্ছে এক লাখ মানুষ। ঢাকার এক–চতুর্থাংশ শিশুর ফুসফুসের সক্ষমতা কমেছে। শিল্প এলাকার মাটিতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে মারাত্মক ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম। ডায়িং কারখানাগুলোতে এক টন কাপড় উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন! রাসায়নিক সারের অতি ব্যবহারে খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় সিসা দূষণের শিকার ৬ লাখ মানুষ! ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের দেহে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটছে! কী ভয়াবহ চিত্র। রোল মডেল বাংলাদেশের খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, ফসলে বিষ; লিভারে, কিডনিতে, ফুসফুসে, পাকস্থলীতে কিলবিল করছে প্রাণঘাতী বিষ। আবার স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের সাধারণ রোগীদের খরচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে! পরিবেশ বাঁচানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অথবা যুগোপযোগী স্মার্ট নীতিমালা তো অনেক দূরের কথা, এই মুহূর্তে উন্নয়ন নামের রঙিন ব্র্যান্ডিংয়ের নিচে আকণ্ঠ দুর্নীতি আর ধ্বংসযজ্ঞে নিমজ্জিত ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশ। 

মাহা মির্জা: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক