হ্যাশট্যাগ

আমরাও হয়রানির শিকার

এসব ব্যক্তির প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ: যৌন হয়রানি। নতুন কোনো ব্যাপার নয়, বিশ্বের সর্বত্র সর্বকালে পুরুষের হাতে মেয়েদের যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ক্ষমতার চাবি পুরুষের হাতে, তারাই আইন বানায়, তারাই বিচার করে। ফলে অভিযোগ করে মেয়েরা কোনোকালেই সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু অবস্থাটা বদলাতে শুরু করেছে, আর এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে মেয়েদের হাতেই।

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে যে ঝড়, তার লক্ষ্য কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান। ক্ষমতাবান পুরুষ ধরেই নেয়, তার অধীনে কাজ করে এমন যেকোনো নারীকে হয়রানি করার অধিকার তার রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ মুখে বলেছেন, তিনি মস্ত তারকা হওয়ায় মেয়েদের সঙ্গে যেমন খুশি ব্যবহার করে পার পেয়ে যান: ‘এমনকি তাঁদের ব্যক্তিগত অঙ্গে হাত দিলেও কোনো সমস্যা নেই।’ হার্ভে ওয়েনস্টিন হলিউডের প্রধান প্রযোজকদের একজন। তাঁর ছবিতে অভিনয় করতে হলে মুখ বুজে তাঁর হয়রানি, নির্যাতন সহ্য করতে হবে। প্রায় একই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন আমাজন স্টুডিওর প্রধান রয় প্রাইস, বিখ্যাত মার্ক হালপেরিন, বিখ্যাত সাংবাদিক ও অভিনেতা কেভিন স্পেসি, চিত্র পরিচালক জেমস টবাক, ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর টম অ্যাশব্রুক ও টিভি হোস্ট চার্লি।

এসবের কোনোটাই নতুন নয়। নতুন শুধু এই যে নারীরা আর এই হায়রানির শিকার হতে প্রস্তুত নন। যৌন হয়রানির ব্যাপারে এত দিন নারীরা অধিকাংশ সময়েই নীরবতা বজায় রেখেছেন। সামাজিক লজ্জা, চাকরি হারানোর ভয়, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা তাঁদের মুখ খুলতে বাধা দিয়েছে। যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের কথায় কেউ কান দেয়নি। কান দেবে কী করে, বেতন আসে যার হাত দিয়ে, তার হাত বাঁধবে কে? এই অবস্থা যে বদলাচ্ছে, তার প্রথম আভাস মিলল গত বছরের ৫ জুন, যখন ফক্স নিউজের অন্যতম হোস্ট এবং একসময়ের মিস ইউএসএ গ্রেচেন কার্লসন নিজ টিভি নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী রজার এলসের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুললেন। বললেন, যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আপত্তি করায় এলস তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন।

সত্যি সত্যি নীরবতার বাঁধ ভেঙে পড়ল ৫ অক্টোবর, যেদিন নিউইয়র্ক টাইমস হলিউডের ‘মোগল’ বলে পরিচিত প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির খবর প্রকাশ করে। এর এক সপ্তাহ পর অভিনেত্রী এলিসা মিলানো বললেন, তিনিও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি মেয়েদের আহ্বান করলেন, ‘আসুন, আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা ভাগাভাগি করে নিই।’ চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই সোয়া কোটি নারী টুইটে জানালেন, তাঁরাও হয়রানির শিকার।

এভাবেই শুরু ‘মি টু’ আন্দোলনের। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপে, মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি ভারতেও। যার যার ভাষায় হ্যাশট্যাগ বেরিয়ে পড়ল। টুইটারে এই হ্যাশট্যাগের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর মেয়েরা হঠাৎ যেন আবিষ্কার করল এক অনিবার্য নিয়তি তাদের এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। এই বাঁধন যদি টুটাতে হয়, তাহলে তাদের সবাইকে এক হয়েই টুটাতে হবে। বাংলায় এখনো কোনো হ্যাশট্যাগ দেখিনি, কিন্তু সে কথা ভাবার সময় এসেছে।

যে দেশে বা সমাজে মেয়েরা যত দুর্বল, তারা তত বেশি যৌন হয়রানির শিকার। আমেরিকায় কর্মজীবী মেয়েদের অন্ততপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ কোনো না কোনো রকম যৌন হয়রানির শিকার। দরিদ্র, কম শিক্ষিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে যৌন হয়রানির মাত্রা আরও অনেক বেশি। শুধু আইনের কাছে গিয়েই তারা কোনো প্রতিকার পায় না তা নয়, নিজ সম্প্রদায়ের ভেতরেই এ নিয়ে মুখ বুজে থাকার প্রবণতা রয়েছে। কেবল কর্মক্ষেত্রে নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও মেয়েদের হয়রানির চিত্রটি অভিন্ন। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি উইমেন জানিয়েছে, এ দেশে প্রতি দশ জনের ছয়জন ছাত্রী সহপাঠী অথবা শিক্ষকের হাতে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছে।

এই যদি অবস্থা হয় আমেরিকার মতো আপাতত অগ্রসর দেশে, তাহলে বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশে মেয়েদের যৌন হয়রানির চিত্রটি কতটা ভয়াবহ, ভাবতে পারেন? অ্যাকশনএইড নামক একটি সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের শহরগুলোতে ৫৪ শতাংশ নারী যৌন সহিংসতার শিকার। যৌন সহিংসতাই যদি এমন ব্যাপক হয়, তাহলে যৌন হয়রানির শিকার কতজন?

নারী নির্যাতন অথবা হয়রানি-এর কোনোটাই আমাদের দেশের পুরুষদের চৈতন্যে বিবমিষার জন্ম দেয় না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ভোলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক বালিকা-নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। সেই অভিযোগ অস্বীকার করে জাতীয় সংসদের এক সদস্য ঠাট্টা করে বলেছিলেন, এমন ঘটনার সুযোগ থাকলে তিনি নিজেও সেই কাজে নেমে পড়তেন। তাঁর সে কথা শুনে সংসদের ভেতরে অনেকেই মজা পাওয়া হাসি হেসেছিলন! কয়েক বছর আগে ইংরেজি নববর্ষের রাতে একটি মেয়ে লাঞ্ছিত হয়েছিল, আর তাকেই ঠাট্টা করে লক্ষ্মীপুরের এক সাংসদ লোক দিয়ে নাটক লিখিয়েছিলেন, সে কথাও অনেকের মনে থাকার কথা। যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রত্যুত্তরে উত্তেজক কাপড় পরার অভিযোগ তো মেয়েদের শুনতে হয় অহরহ। পয়লা বৈশাখে সবার চোখের সামনে যৌন হামলার শিকার হয়েছে মেয়েরা। উল্টো অভিযোগ করা হয়েছে, রাত করে মেয়েরা বাইরে ছিল, সে কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। টিএসসি চত্বর কোনো পুরুষের নিজস্ব পৈতৃক তালুক নয় যে সেখানে যেতে হলেও মেয়েদের ঘড়ির কাঁটা মেপে যেতে হবে।

বাংলাদেশে নারী আন্দোলন রয়েছে বটে, কিন্তু নাগরিক চৈতন্যে তার কোনো প্রভাব পড়েছে, সে কথার কোনো প্রমাণ নেই। প্রতিবেশী ভারতে ছবিটি কিছুটা ভিন্ন। সেখানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মেয়েদের আন্দোলন অনেক দিন আগে থেকেই চলছে, এখন এই আন্দোলন আর শুধু শহুরে শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে সীমিত নেই। অথচ সেখানেও যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে বিচার পেয়েছে, এমন অভিজ্ঞতা হাতে গোনা। যাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই হয় সেই অভিযোগ বাতিল হয়েছে অথবা তাঁরা চাপে পড়ে মিটমাট করে নিজেরাই অভিযোগ তুলে নিয়েছেন।

কয়েক বছর আগে ভারতের মধ্যপ্রদেশের নিম্ন আদালতের এক নারী বিচারক উচ্চ আদালতের এক বিচারকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। সেই বেচারা নারী বিচারক প্রকাশ্য সওয়াল-জবাবে এমন হেনস্তা হয়েছিলেন যে পরে নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আড়ালে চলে যান। বেনারসের হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে ছাত্রীরা বিক্ষোভে অংশ নিলে উপাচার্য পুলিশ ডেকে তাঁদের লাঠিপেটা করেছিলেন। বলেছিলেন, এমন অভিযোগ তুলে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি করেছে। দুই বছর আগে দিল্লিতে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনার পর এক মন্ত্রী যুক্তি দেখিয়েছিলেন, পুরুষদের আর কী দোষ, মেয়েরা উত্তেজক জামাকাপড় পরলে এমন ঘটনা তো ঘটবেই। সে সময় এক মহাসাধু এমন কথাও বলেছিলেন, যৌন হামলার ঘটনার পেছনে গ্রহের ফের রয়েছে।

নারীর যৌন হয়রানি ঠেকাতে হলে ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সেটা ঘটবে না যতক্ষণ না নারীরা নিজেরাই ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু সেই পরিবর্তন যত দিন না হচ্ছে, তত দিন নারীরা কি মুখ বুজে বসে থাকবেন? নারীবাদী লেখক সারাহ সেলজার জবাব দিয়েছেন, মোটেই না। নারীদের প্রতি তাঁর পরামর্শ, ‘চুপ করে থাকবেন না, প্রতিবাদ করুন। সব হয়রানির কথা একে অপরকে জানান। জোট বাঁধুন। সামাজিক তথ্যমাধ্যমে মতবিনিময়ে অংশ নিন।’

নারীরা এককাট্টা হলে কতটা অভাবিত বিজয় অর্জনে সক্ষম, তার এক প্রমাণ আমরা হাতেনাতে পেয়েছি এই সেদিন যুক্তরাষ্ট্রে। অতি রক্ষণশীল আলাবামা অঙ্গরাজ্যের মহা খ্রিষ্টপন্থী রিপাবলিকান সিনেট পদপ্রার্থী রয় মুর পরাজিত হয়েছেন তাঁর স্বল্প পরিচিত ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী ডাগ জোন্সের কাছে। রয় মুর পরাজিত হয়েছেন, কারণ, নারীরা তাঁকে ভোট দেননি। অভিযোগ ছিল, মুরের যখন ৩০-৩২ বছর বয়স, তখন তিনি অল্পবয়সী মেয়েদের লাঞ্ছিত করেছেন। ব্যাপারটা এত দূর পৌঁছায় যে কোনো কোনো শপিং মলে বলে দেওয়া ছিল, রয় মুর এলে তাঁকে যেন ঢুকতে দেওয়া না হয়। পুরুষেরা ঠিকই রয় মুরের বাক্সে ভোট ফেললেন, কিন্তু মেয়েদের সিংহভাগ বললেন, খ্রিষ্টের নাম নিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলা এই লোকটি আসলে একটি ভণ্ড, তাঁকে ভোট দেবেন না তাঁরা।

বস্তুতপক্ষে, নারীরা যখন প্রতিবাদ করতে শেখেন, তখন তাঁদের আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কয়েক বছর আগে ভারতের মণিপুরে মনোরমা নামের এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে সেই রাজ্যের নারীরা সেনাছাউনির বাইরে বিনা পোশাকে দিনের পর দিন বিক্ষোভ করেছেন। এই খবর দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হলে তড়িঘড়ি করে সেই সেনাছাউনি সরিয়ে ফেলা হয়।

এত দিনে আরও একটা জিনিস স্পষ্ট হয়েছে। যৌন হয়রানি অথবা অন্য যেকোনো প্রশ্নে নিজেদের অধিকার আদায় করার এই লড়াইটা নারীদের একাই লড়তে হবে। উদার, আধুনিক পুরুষেরা কবে পুরোনো সংস্কার ঝেড়ে ফেলে নারীদের সঙ্গে হাত মেলাবেন, সেই পরিবর্তনের জন্য যদি অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে দিল্লি দূর হস্ত। নারীদের অধিকার মেনে নেওয়া মানে নিজের অবাধ অধিকার কিছুটা হলেও খর্ব হওয়া, অতি উদার পুরুষও তা বোঝে। ফলে লড়তে হবে নারীদের নিজেদের। নতুন যে লড়াইয়ে নারীরা নেমেছেন, তার লক্ষ্য একদিকে ব্যক্তিগত আত্মসম্মান উদ্ধার, অন্যদিকে সামাজিকভাবে নিজের জায়গা করে নেওয়া। এ কাজে সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁদের সংখ্যার সংহতি।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।