Thank you for trying Sticky AMP!!

উজান-ভাটির চাওয়া-পাওয়ায় ব্যবধান থাকছেই

আসামের গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কনফ্লুয়েন্সের এবারের সম্মেলনের ফোকাস ছিল ‘নদী’। সেখানে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর

আসামের দিক থেকে আসা ঢলের পানিতে সিলেট বেশ ভুগল কয় দিন। ঠিক সে সময়ই ২৮ ও ২৯ মে আসামে এক আলোচনা-উদ্যোগে যেতে হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে। তিনি সিলেটের সন্তান। জন্ম ও নির্বাচনী এলাকা দুটিই তাঁর সিলেটে। এ কারণে তিনি ভালোই জানেন, অপ্রস্তুত অবস্থার হঠাৎ ঢলে সিলেটে অবকাঠামোর কী বিস্তর ক্ষতি হলো। গুয়াহাটি গিয়েই এ কে আব্দুল মোমেন আক্ষেপ করে ভবিষ্যৎ বন্যার আগাম তথ্য চান আসামের কাছে। ২৮ মে আসামে বাণিজ্যমন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারির সঙ্গে বৈঠককালে তিনি এ দাবি জানান বলে স্থানীয় প্রচারমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল।

কাজটা বেশি কঠিন নয়। আসামকে বাংলাদেশ যা দিয়েছে, তার বিপরীতে সিলেটসহ পুরো বাংলাদেশ এ রকম তথ্য চাইতে পারে। কিন্তু সম্পর্কের দশকের পর দশক পরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এটা চাইতে হলো। আসামসহ উজানের বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্য থেকে প্রতিবছর ঢলের আগাম সতর্কবার্তা পেলে বাংলাদেশ অনেক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেত। মানুষ ও প্রাণিসম্পদ নিরাপদ জায়গায় সরানো যায় এ রকম আগাম খবর পাওয়া গেলে। অজ্ঞাত কারণে এসব ন্যূনতম সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না অনেক সময়। অথচ এসব সহযোগিতার অঙ্গীকার ছিল স্বাধীনতার পরপর গঠিত ১৯৭২ সালের যৌথ নদী কমিশনের অনুচ্ছেদ ৪-এ।

আসাম সফরকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স নামের সংস্থার সম্মেলনে যে ভাষণ দিলেন, সেখানে নদ-নদীবিষয়ক সহযোগিতার কথাই বারবার বলেন তিনি। এ নিয়ে তৃতীয়বার এ রকম সম্মেলন হলো। এবারের সম্মেলনের ফোকাস ছিল ‘নদী’, যার নাম দেওয়া হয় ‘রিভার কনক্লেভ’। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও এসেছিলেন সম্মেলনে। সরকারি সম্মেলন না হলেও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছিল এশিয়ান কনফ্লুয়েন্সের আয়োজনে। বিভিন্ন উপস্থাপনা ও বক্তৃতা থেকে বোঝা গেল, উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বার্থ ও সমৃদ্ধিকে সামনে রেখে এ আয়োজন। এ অঞ্চল নিয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ভাবনাগুলো পর্যালোচনার স্পষ্ট ছাপ ছিল উপস্থিত বক্তাদের মতামতে। বিজেপি উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য কী করছে, সেটা জানানোরও একটা আগ্রহ ছিল উপস্থিত অনেকের মধ্যে। বাংলাদেশের বেশ বড় একটা প্রতিনিধিদলকেও গুয়াহাটিতে দেখা গেল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরপর ভাষণ দিলেন এবং সেটাই ছিল সম্মেলনের মূল মনোযোগের বিষয়।

এ সম্মেলনকালে ২৯ মে টাইমস অব ইন্ডিয়া চমৎকার একটা প্রতিবেদন করে, যাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে—এ অঞ্চলে ভারত কী চায়, কীভাবে চায় এবং বাংলাদেশকে কী কী প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যাশার তালিকা বেশ দীর্ঘ:

এক. মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে স্থল যোগাযোগ এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে নৌযোগাযোগের মাধ্যমে ভারত পূর্ব দিকে ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন পর্যন্ত এগোতে ইচ্ছুক। এই উভয় ধারার ভারতীয় অগ্রযাত্রা শুরু হতে পারে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে জয়শঙ্করের ভাষায় ছয়টি আন্তসীমান্ত রেলওয়ে সংযোগের ভেতর দিয়ে। যাতে আছে শাহবাজপুর-করিমগঞ্জ, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি, আখাউড়া-আগরতলা ইত্যাদি রেল সংযোগ।

তারপরও বাংলাদেশ যে উদারভাবে ভারতের ‘কানেক্টিভিটি’র ধারণায় সহযোগিতায় দিয়ে যাচ্ছে, এস জয়শঙ্করের ভাষণ তার প্রামাণ্য এক দলিল হয়ে থাকল অসমিয়াদের সামনে; যদিও তাতে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর স্রোত বেয়ে ভাটির দিকে গ্রীষ্মে প্রয়োজনীয় পানি এবং বর্ষায় ঢলের পূর্বাভাস আসার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। অন্তত ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’-এর ‘রিভার কনক্লেভ’ তেমন কোনো আশা ছড়াতে পারেনি তার এবারের তৃতীয় আসরে।

দুই. এস জয়শঙ্কর এ-ও আশা করেছেন, বাংলাদেশ-ভুটান-নেপালকে নিয়ে বিবিআইএন চুক্তিটিও শিগগির কার্যকর হবে, যা সড়কে ভারতীয় যোগাযোগ বাড়াবে।

তিন. আসামে জয়শঙ্কর এ-ও জানিয়েছেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং তার সীমানা লাগোয়া অন্যত্র প্রত্যাশামতো অগ্রগতির লক্ষ্যে বাংলাদেশের ভেতরে ভারত সড়ককেন্দ্রিক কিছু প্রকল্পে ভূমিকা রাখছে, যার মধ্যে আছে আশুগঞ্জ-আখাউড়া স্থলবন্দর সংযোগ সড়ক, রামগড় থেকে বারইয়ার হাট সড়ক ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি ভারত বিশেষভাবে আশা করছে, ভারতীয় বিভিন্ন বন্দর থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য চলাচল বাড়ানো যাবে।

চার. বাংলাদেশের সঙ্গে এখনকার ‘সীমান্ত হাট’গুলোর পাশাপাশি আরও নয়টি সীমান্ত হাট চালুর কথাও জানালেন জয়শঙ্কর, যার তিনটি হবে মেঘালয়ে, চারটি ত্রিপুরায় এবং দুটি হবে আসামে। ভূমিশুল্ক স্টেশন হবে আরও ২৮টি।

পাঁচ. বাংলাদেশের তরফ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য ইন্টারনেট খাতে পাওয়া সুবিধার কথাও বাদ যায়নি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবরণে।

সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য যতটা ছিল নদীকেন্দ্রিক, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল ততটাই ‘কানেক্টিভিটি’মুখী। সম্মেলন আহ্বানকারীরা এ আয়োজনের থিম করেছিলেন ‘উন্নয়ন ও পারস্পরিক নির্ভরতা’। ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক নির্ভরতার একটা বড় জায়গা অবশ্যই নদীর পানি। সে কারণেই হয়তো বাংলাদেশ থেকে কৌতূহলী অনেকে আশা করেছিলেন, গুয়াহাটিতে হয়তো ভারতীয় ঊর্ধ্বতনদের তরফ থেকে তিস্তার পানি নিয়ে নতুন কোনো আশ্বাস পাবে ভাটির বাংলাদেশ। তিস্তার পাশাপাশি অন্যান্য নদীর পানি নিয়েও কিছু ব্যবহারিক মতামত আসবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে অববাহিকা ধরে ধরে নদী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু বিষয় হিসেবে তিস্তা সম্মেলনে আসা বিশিষ্টজনদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে, এমন বলা যায় না। আলাপ-আলোচনা বেশি হলো রেলসংযোগ, স্থলবন্দর, সীমান্ত হাট, সংযোগ সড়কসহ ভারতীয় যোগাযোগ প্রত্যাশাগুলো নিয়ে।

Also Read: জলবিদ্যুৎ আমদানির স্বার্থে ব্রহ্মপুত্র-যমুনাকে বিসর্জন নয়

জয়শঙ্করের মতামতে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর জন্য বিস্তর আশার আলো ছিল। বাংলাদেশের সহযোগিতার সূত্রে পাওয়া ‘কানেক্টিভিটি’র প্রায় সব প্রকল্পে আসামসহ আশপাশের রাজ্যগুলোর লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। আসামের বিজেপি সরকার এ সম্মেলন থেকে রাজনৈতিকভাবে বেশ প্রচার-উপাদান পাবে বলেই আশা করা যায়। তাতে অবশ্য এ রাজ্যে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা কতটা কমবে, বলা মুশকিল। সম্মেলনের আগের দিনই জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বিষয়ে আসামের রাজ্য সমন্বয়ক হিতেশ দেববর্মা অভিযোগ করলেন, ‘চাপ দিয়ে পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানদের নাম ওঠানো হয়েছে এনআরসিতে।’ তাঁর এই নাটকীয় দাবিতে প্রায় শেষ হতে চলা বিষয়টি আবার অসমিয়াদের সামনে এল।

আসামে তিন থেকে চার দশক ধরে রাজনীতির প্রধান পণ্য ‘অবৈধ বাংলাদেশি’বিরোধী প্রচারণা। ডজন ডজন ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়েছে এ রকম ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের জন্য। হয়েছে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’। ভারতের যেকোনো রাজ্যে অবৈধ নাগরিক খুঁজে পাওয়া ও তার বিচার-আচার সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হওয়ার কথা। কিন্তু আসামে ‘বাংলাভাষী’ কাউকে নাগরিকত্বের কাগজপত্র ছাড়া পাওয়ামাত্র ‘বাংলাদেশি’ তকমা পড়ে যায় তাৎক্ষণিকভাবে। এ রকম প্রচারের ওপর দাঁড়িয়ে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র—দুই উপত্যকাতেই দীর্ঘ সময় ‘বিদেশি খেদা’ আন্দোলন হয়েছে। স্থানীয় বাংলাভাষীদের জন্য এসব আন্দোলন যেমন মানসিক পীড়নতুল্য, বাংলাদেশের জন্যও তা কম অস্বস্তির নয়।

বছরের পর বছর এ রকম প্রচারণা এ কারণেও মেনে নেওয়া অবাস্তব যে আসামের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্পষ্ট ভালো অবস্থানে আছে। আন্তর্জাতিক মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ আসামের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এ ছাড়া আসামে এনআরসিকালে দেখা গেছে, বাংলাদেশ লাগোয়া সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় অবৈধ নাগরিকদের সংখ্যা মধ্য আসামের জেলাগুলোর তুলনায় অনেক কম, যা বাংলাদেশ থেকে সেখানে অবৈধভাবে মানুষের না যাওয়ারই সাক্ষ্য দেয়। তারপরও আসামে নির্বাচন এলেই বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসে। সীমান্তে কাঁটাতারও বসেছে ‘বাংলাদেশের দিক থেকে মানুষ যাওয়া ঠেকাতে’।

তারপরও বাংলাদেশ যে উদারভাবে ভারতের ‘কানেক্টিভিটি’র ধারণায় সহযোগিতায় দিয়ে যাচ্ছে, এস জয়শঙ্করের ভাষণ তার প্রামাণ্য এক দলিল হয়ে থাকল অসমিয়াদের সামনে; যদিও তাতে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর স্রোত বেয়ে ভাটির দিকে গ্রীষ্মে প্রয়োজনীয় পানি এবং বর্ষায় ঢলের পূর্বাভাস আসার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। অন্তত ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’-এর ‘রিভার কনক্লেভ’ তেমন কোনো আশা ছড়াতে পারেনি তার এবারের তৃতীয় আসরে।

আলতাফ পারভেজ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক