এক জিনিসের বহু ব্যবহার ও ভটভটি

এক জিনিস চোদ্দ কাজে লাগানোর বেলায় আমাদের হাত দুটি ভালোই পাকা। আর নবধারা সৃষ্টিতে যে উদ্ভাবনী মেধার প্রয়োজন, তা আমরা জন্মসূত্রেই নিয়ে আসি। কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ইনোভেশনে যে সুদক্ষ ছিলেন, এর প্রমাণ অজস্র।

এক সরষের কথাই ধরা যাক। সেই যে কবে এই খুদে শস্যদানা পিষে ঝাঁজালো আর পিচ্ছিল তেল বের করা হলো, এর নানাবিধ ব্যবহার এখনো সমাজের সর্বস্তরে বিদ্যমান। রান্নায় তেল, ভর্তায় তেল, মাথায় তেল, মালিশে তেল, পায়ে তেল—কিসে নেই? তেলের বর্জ্য খৈলও কি কম কাজে লাগে! গ্রামবাংলায় গোসলে, গা পরিষ্কারে এখনো খার-খৈলের কদর কম নয়। আর গোখাদ্য হিসেবে খৈল তো অতি উপাদেয়।

গোসম্পদের কথা যখন এসেই গেল, এখানেও কিন্তু যুগ যুগ ধরে বহুবিধ ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। বাছুরকে এক আনার বুঝ দিয়ে হাঁড়ি ভরে দুধ নিয়ে আমরা কত মজা করে খাই। এক দুধে কত-কী হয়! টাঙ্গাইলের চমচম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মণ্ডা, কুমিল্লার রসমালাই, বগুড়ার দই—আরও কত-কী! বলে শেষ করা যাবে না। গোঁয়ার ষণ্ডকে বলদে রূপান্তর করে কাঁধে জোয়ালটা চাপিয়ে খেতে লাঙল দিই, মালভরা গাড়ি টানাই। কসাইখানার কাটাকুটি আর চর্মশিল্পে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দিকে আর নাইবা গেলাম।

আর গাছপালা ব্যবহারের কথা যদি বলি, সে এক মচ্ছব! বনবাদাড়ে যত গাছ, ফাঁক পেলেই ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচ ফেলে দাও। কেটে সাইজ করো। মজবুত খুঁটি গাড়ো, তক্তা বানিয়ে ঘরের নানা কাজে লাগাও, লাকড়ি বানিয়ে চুলায় দাও। এর পরেও তো ব্যবহারের শেষ নেই। কয়লা কত কাজে লাগে! গাঁওগেরামে অনগ্রসর সমাজে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজার প্রচলন এখনো রয়েছে। শুধু ওরা কেন, দন্ত পরিচর্যা যাদের কাছে উটকো ঝামেলা, মাজনের খরচাটা বাঁচাতে ওই এক টুকরা কয়লা চিবিয়ে দিব্যি দাঁত মেজে ফেলে। আর কামারের কাজ চলে কী দিয়ে? ওই কয়লা পুড়িয়ে। মজাদার কাবাব আর মোসাল্লামও কয়লায় আগুনে ঝলসে নিলে দারুণ সুস্বাদু হয়।

এই যে এক জিনিসকে এত কাজে লাগানোর কৌশল, এটা কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের উদ্ভাবনী মেধার গুণ। সত্যি বলতে কি, ইনোভেশন বা নবধারার প্রবর্তনের বিষয় আমাদের রক্তে বেশ ভালোভাবেই আছে।

গ্রামে গেরস্তবাড়িতে আগে ধান আহরণে মলন দেওয়া হতো। গরু বা মহিষ দিয়ে মাড়িয়ে গাছ থেকে ধান বের করা হতো। এখন সে কৌশল বদলেছে। কৃষকেরা খালি ড্রামের গায়ে ধামাধাম ধানের আঁটি মেরে ধান বের করে নেন। এ কাজে গৃহিণী বা কিষানিরাও কম যান না। আবার ধান মাড়াইয়ের যান্ত্রিক কৌশলও বের হয়েছে, যা গরু-মহিষকে কায়িক তুফান থেকে খানিকটা রেহাই দিয়েছে।

আগে ডোবা, খাল বা কোনো জলাশয় থেকে কাঠের তৈরি ডোঙায় করে পানি ভরে খেতে সেচ দেওয়া হতো। শ্যালো মেশিন এসে কৃষক বা চাষিকে এই শ্রমসাধ্য কাজ থেকে রেহাই দিয়েছে। কিছু টাকা জোগাড় করে খেতের কোণে শ্যালো মেশিন একটা বসালেই হলো। পানির অভাব নেই। এসব মেশিন কোনোটা চলে বিদ্যুতে, আবার কোনোটা চলে জ্বালানি তেলে। এখানে খয়খরচার একটা বিষয় রয়েছে, যা অনেক সময় গরিব কৃষকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তবে খরচ উশুল করার সুযোগও আছে। শ্যালো মেশিনের মালিক নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে আশপাশের অন্য কৃষকদের খেতেও সেচ দিতে পারেন।

কেবল খেতের কাজ নয়, শ্যালো মেশিন এখন অন্যান্য কাজেও লাগান কৃষক। নৌকায় এ ইঞ্জিন বসালে তা হয়ে যায় যন্ত্রচালিত নৌযান। আর সড়কপথে শ্যালো মেশিনে বিভিন্ন আকারের যে গাড়ি চলে, তা হলো ভটভটি। কোথাও কোথাও এই যন্ত্রযান আলমসাধু বা নছিমন নামেও পরিচিত।

ভটভটি প্রথাসিদ্ধ কোনো যান নয়। সড়কপথে চলার মোটেও উপযুক্ত নয় এই যান। সংগত কারণেই এসব যানের কোনো রুট পারমিট বা লাইসেন্স থাকে না। চালকও সেভাবে প্রশিক্ষিত কেউ নয়। সড়কে যন্ত্রযান চালানোর মতো হিম্মত নিয়ে চালকের আসনে বসে গেলেই সে চালক। আর যাত্রী বহনেরও কোনো মাত্রা নেই এ যানে। চালক যতটা পারে, গাড়ি ভরো ভরো করে যাত্রী তুলে ফেলে। তারপর ছেড়ে দেয় তার তুফান মেইল। এই মেইলে গতি পরিমাপের কোনো মিটার নেই। যথাযথভাবে গতিনিয়ন্ত্রণের হাইড্রলিক ব্রেক নেই। স্রেফ হাওয়ার ওপর দিয়ে চলে। ভটভট করে টালমাটাল হয়ে যেতে থাকে অগস্ত্যযাত্রার মতো। এমন বেসামাল যন্ত্রযানের দুর্ঘটনা ঘটানোর খুবই স্বাভাবিক।

ভটভটির দুর্ঘটনার খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসে। এর ইঞ্জিনে ওড়না পেঁচিয়ে তরুণীর মৃত্যুর খবর আমরা পড়েছি। আর পথচারীকে চাপা দেওয়া এবং চলন্ত কোনো যানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে প্রাণহানি ঘটানো তো অহরহ চলছে। সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায়। গতকাল রোববার সকালে চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর মহাসড়কে ট্রাকের সঙ্গে ভটভটির মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিরা সবাই ভটভটির যাত্রী এবং খেটে খাওয়া মানুষ। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের পরিবারে কর্মক্ষম একজন মানুষ মারা যাওয়া মানে অন্য সদস্যদের মুখের আহারে বাগড়া পড়া। কেবল স্বজনহারানোর শোকেই এ কষ্ট সীমাবদ্ধ থাকে না। দিনযাপনের প্রতি পলে স্বজনকে তা দগ্ধ করে। এ যাতনা কেবল শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যরাই বোঝে।

প্রথম আলোর চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি শাহ আলম আজ প্রকাশিত ‘অবৈধ যানের ছড়াছড়ি, অহরহ দুর্ঘটনা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, চুয়াডাঙ্গায় চলতি মাসে এ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫০টি। এর মধ্যে গতকালের ঘটনাটিসহ ১২টি ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই আছে অবৈধ যান। নছিমন-করিমন-আলমসাধুর মতো অবৈধ ভটভটির সঙ্গে এখন সড়কে যুক্ত হয়েছে ‘ইটভাটার ট্রলি’ আতঙ্ক। চলতি মাসে এই যান ছয়টি ঘটনায় ছয়জনকে সড়কে পিষে মেরেছে।

প্রতিবেদনে শাহ আলম তাঁর জেলায় অবৈধ এসব যানের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা ভয়াবহ। কিন্তু ভটভটির মতো যানে মানুষ চড়ে কেন? কারণ অনেক। যাত্রীর তুলনায় যান কম থাকায় সে স্থান পূরণে এসে ভটভটি ভালোই জেঁকে বসেছে। স্থানীয় যাত্রী পরিবহনে এসব যানের ভাড়া অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম। লোকাল বাস বা থ্রি-হুইলার গাড়িগুলো রাস্তায় বা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রী নামায়। আর ভটভটিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে বাড়ির সামনে নামা যায়। স্বভাবে আমরা আরামপ্রিয়। কাজেই বাড়ির সামনে নামার আয়েশটুকু ছাড়ি কেন? তা সে যানে খানিকটা ঝুঁকি থাকলে থাকবে। আবার যাঁরা এসব যানের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, খয়খরচার বিষয়টি তাঁরা মাথায় রাখেন। একটি থ্রি-হুইলারে যেখানে ছয়-সাত লাখ টাকা নেমে যাচ্ছে, সেখানে একটি ভটভটি লাখ খানেক টাকায় নামানো যায়।

কিছুদিন আগে রাজধানী সফরে আসা এসব অবৈধ যানের এক নিয়মিত যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি—কী রোমাঞ্চ তারা অনুভব করে এই যানে করে যাওয়ায়! তার কথা, ‘আরে ভাই, ভটভট করে যখন ওটা ছোটে না, পুরা রয়েল বেঙ্গল টাইগার! আর পা ঝুলাইয়া বসায় যে মজা, সেইটা তো আপনারা পাইবেন না!’

কাজেই অবৈধ যান হলেও ভটভটি বা এ ধরনের যান নিজগুণে স্থানীয় যাত্রীদের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠেছে। রাজধানীর কথাই ধরি না। বিভিন্ন মহল্লা আর গলিতে অবৈধ যানের তালিকায় থাকা ইজিবাইকগুলো যাত্রী পরিবহনে বেশ জায়গা করে নিয়েছে। টেম্পোর হুড়োহুড়ি আর রিকশাচালকদের লাগামহীন ভাড়া নিয়ে দৌরাত্ম্য এড়াতে অনেকে স্থানীয় যান হিসেবে ইজিবাইকে আরাম বোধ করে থাকেন। যদিও এই বেসামাল যান যেকোনো সময় বিপত্তি বা বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটানোর ঝুঁকিতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপে যখন ইজিবাইক চলা বন্ধ হয়ে যায়, ওই সময় সকালে স্কুলগামী শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও অফিসগামী চাকুরেদের একধরনের হয়রানিতে পড়তে দেখা যায়। হন্যে হয়ে তাঁরা অপ্রতুল রিকশার পেছনে ছোটেন। আর রিকশাচালকদের দাপট তখন দেখে কে!

বাস্তবতা হলো, চাহিদা ও গুরুত্ব আছে বলেই ভটভটির মতো যানগুলো দৈনন্দিন জীবনে যাত্রী বহনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই অবৈধ যান অবশ্যই মানবজীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এসব যানবাহন বন্ধে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আন্দোলনও কম হয়নি। কিন্তু হচ্ছে না। তবে এ বিষয়ের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে যে এসব যানের বিকল্প কী হতে পারে। কিংবা প্রযুক্তিগত ও কারিগির উৎকর্ষের মাধ্যমে এসব যানকেই বৈধভাবে চলার সুযোগ করে দেওয়া যায় কি না, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
sharifrari@gmail.com