Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা হলো ভাইরাস, মহামারির নাম পুঁজিবাদ

করোনায় বাড়ছে বেকার মানুষের সারি। ছবি: প্রথম আলো

করোনায় সারা বিশ্বই থমকে আছে। থমকে যাওয়া অর্থনীতির কারণে একটা প্রশ্ন বেশ জোরেশোরেই উঠেছে, পুঁজিবাদ কি টিকে থাকবে? মহামারিতে নাগরিক চাহিদা পূরণ করতে পারেনি পুঁজিবাদী কাঠামোর ওপর ভর করে থাকা রাষ্ট্রগুলো। পুঁজিবাদ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারছে না। ‘নিও নরমাল’ বা নতুন স্বাভাবিকতা বলে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও আদতে পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, তা কেউ জানে না। করোনার বিস্তার বৃদ্ধির সঙ্গে উৎপাদন ও বণ্টনে বৈষম্য ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রগুলোর অপেক্ষাকৃত কল্যাণমূলক চরিত্র থাকলে করোনা পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। এ অবস্থায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিৎস আবারও প্রগতিশীল পুঁজিবাদের ধারণা দিয়ে করোনা মোকাবিলার যুক্তি দিয়েছেন।

গত মাসে ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন বর্তমানের অন্যতম প্রভাবশালী দুই অর্থনীতিবিদ—কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিগলিৎস, অক্সফোর্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক ও ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ বেয়েটা ইয়াভরচিক। আলোচনায় দুই অর্থনীতিবিদই একমত হয়েছেন, বর্তমানে সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। আটলান্টিকের ওপারে যুক্তরাষ্ট্রে তা আরও বেশি। এপারের ইউরোপীয় দেশগুলোয় হয়তোবা একটু কম। কিন্তু চরম বৈষম্যে উন্নত বিশ্বের সমাজে বিরাজ করছে। এ অবস্থায় করোনার মতো শক্তিশালী মহামারিকে মোকাবিলা করা কঠিনই বটে।

স্টিগলিৎসের মতে ১৯৬০ সালের পর বর্তমানে আমেরিকায় বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। গত ৩০ বছরে ৯০ ভাগেরই বেতন একই জায়গায় থমকে আছে। এমনকি কোথাও কোথাও হ্রাসও পেয়েছে। বিপরীতে জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধি কিন্তু বেড়েছে। ইউরোপের বাজারের দিকে তাকালেও বৈষম্যের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুসারে, ইউরোপের ২০ শতাংশ মানুষ আয়ের দিক থেকে নিচে থাকা ২০ শতাংশ মানুষের ৫ গুণ বেশি আয় করে।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নের সুফল কোথায় যাচ্ছে? নতুন ধরনের পুঁজিবাদ দিয়ে কি করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব? স্টিগলিৎস মনে করেন, অতিরিক্ত ভোগবাদিতার কারণে নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। করোনার সময় এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় বড় বড় পুঁজির মালিক—করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি বাজারের সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকে আরও জনবান্ধব হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার রাশ টেনে ধরতে বলেছিল।

স্টিগলিৎসের প্রগ্রেসিভ ক্যাপিটালিজমের ধারণার সমালোচনা করছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক অর্থনীতিবিদ ম্যাক্স সাউইকি। তিনি মনে করেন, স্টিগলিৎস একধরনের আলোকিত বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন। কিন্তু পুঁজির ওপর সমাজের নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিচ্ছেন না। সাউইকি মনে করেন, প্রগ্রেসিভ ক্যাপিটালিজম দিয়ে বর্তমান সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব না। কারণ, বাজারের মধ্যেই বৈষম্য জায়গা নিয়ে বসে আছে। স্টিগলিৎস সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মতো সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার কথা বলছেন না।

সাউকির আলোচনা ধরে আমাদের দেশের কথাই বিবেচনা করা যাক। এখানেও অর্থনৈতিক বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রই বৈষম্যের পথ সুগম করে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে একটা সংবাদ দেখে বেশ খটকায় পড়লাম। জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার আগেই সরকারি কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছিলেন, ১ আগস্ট ঈদুল আজহা উদ্‌যাপিত হবে। সেই হিসাবে তাঁরা ঈদের বোনাস ৫ শতাংশ বেশি পাবেন। কারণ, জুলাইয়ের পর তাদের বেতনের সঙ্গে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হবে। এটা প্রতিবছরই হয়। কিন্তু ৩১ জুলাই ঈদ উদ্‌যাপিত হলে সরকারি চাকরিজীবীরা নতুন ইনক্রিমেন্ট পাবেন না। সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা নিয়ম মেনে উৎসব ভাতা পাবেন। এ বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু আলাপটা শুরু হয় তখনই, যখন দুর্যোগের মধ্যেই আগাম উৎসবের দিনক্ষণ ধরে নিয়ে ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

রাষ্ট্র নাগরিকদের থেকে দূরে গেলেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই দুর্যোগের সময় সরকারি চাকরিজীবীদের উৎসব ভাতা বাতিল করা প্রয়োজন ছিল। এমনকি বেতনও কমানো যেতে পারত। কারণ, এই মুহূর্তে দেশের কমপক্ষে ৬ কোটি ৫৩ লাখ মানুষের আয় কমে গিয়েছে করোনার প্রভাবে। মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ করোনার কারণে দরিদ্র হয়েছে। এদের আয় সংকুচিত হয়েছে। এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে মাসে ২ হাজার ১০০ টাকা বা ২৫ ডলার করে আর্থিক সহায়তার জন্য সুপারিশ করেছে ইউএনডিপি। অবশ্য সরকার আগেই নগদ সহায়তার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে তা মাত্র ৫০ লাখ মানুষের জন্য—এককালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দিচ্ছে সরকার। চাহিদার তুলনায় ৫০ লাখ মানুষের বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। এ টাকা নিয়ে দুর্নীতিও হয়েছে বিস্তর। ইউএনডিপির হিসাব অনুসারে নগদ সহায়তা দিলে সরকারের ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। সরকারি ব্যয় সংকোচন করে জরুরি ভিত্তিতে নিম্ন আয়ের নাগরিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা সম্ভব ছিল।

সুষম বণ্টনের পরিবর্তে সম্পদ ব্যবসায়ী, ধনিক শ্রেণি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে চলে যাচ্ছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি আয়ের বৈষম্য খুবই চরম আকার ধারণ করেছে। বৈষম্য আগেও ছিল। এখনো আছে। বৈষম্যের দিক বদল হয়েছে কেবল। আগে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কম ছিল। এখন বেসরকারি চাকরিতে বেতন কমেছে। আর এ বৈষম্যের কারণে বেসরকারি খাতে তরুণেরা চাকরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। দলে দলে শিক্ষার্থীরা বিসিএসমুখী হয়েছে।

অতিমাত্রায় বিসিএসের প্রতি আগ্রহই সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি পরিষ্কার করে দেয়। রাষ্ট্র নিজের সুবিধার জন্য সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করছে। আর ওদিকে ছয় কোটি মানুষের চুলায় হাঁড়ি চড়বে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে আদৌ জনবান্ধব হওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই বৈষম্য সহজেই দূর হবে না, যদি না পুঁজিবাদকে বিদায় করা যায়। স্টিগলিৎসের মতো অনেকেই নতুন নতুন ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন। স্টিগলিৎসরা মূলত বর্তমান পুঁজিবাদী কাঠামোকে বজায় রেখেই সমস্যার সমাধান করতে চাইছেন প্রগ্রেসিভ ক্যাপিটালিজমের মোড়কে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্টিগলিৎস বাজারের সক্ষমতাকে জনস্বার্থে ব্যবহারের কথা বলছেন। রাষ্ট্র, বাজার ও নাগরিকের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন সামাজিক চুক্তির মতো দিয়েছেন নোবেলপ্রাপ্ত এই অর্থনীতিবিদ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই হোক আর বাংলাদেশই হোক, কোথাও প্রগতিশীল পুঁজিবাদের ধারণা কাজ করছে না। দেখা যাচ্ছে প্রতিবাদীদের কথাটাই সত্য হলো, ‘করোনা হলো ভাইরাস আর মহামারির নাম হলো পুঁজিবাদ’।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।